শাহীন আখতার
দক্ষিণের সাগর। সাগরে জীবজন্তু আকৃতির ভাসমান অসংখ্য দ্বীপ। কখনো দেখা যায় হালকা নীলের বুকে সবুজপানা কিছু ঘাসের ছিটা – তৃণভোজী প্রাণীর হেলাফেলায় ছড়ানো উচ্ছিষ্ট খাবার যেন।
ঝকঝকে ভূগোলকে চোখ সেঁটে আছে ছোট রোহিঙ্গার। ইচ্ছা হয় গোল জিনিসটাকে কাছে টেনে আনে। বগলদাবা করে গোটা পৃথিবীকে। কিন্তু মাঝখানে সূক্ষ্ম তারের বেড়া আর বেড়ার ওপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্লোবটা তাকে দেখাচ্ছে ম্যাথু। দ্বীপের নাম, দেশের নাম বলে যাচ্ছে গড়গড়িয়ে।
‘সাগরে এত এত দ্বীপ! সবই আবিষ্কার হয়ে গেছে, ম্যাথু?’
‘আবিষ্কার হয়ে গেলেই কি। ক্যাপ্টেন কুকের আগে কম সে কম সাতজন নাবিক অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আবিষ্কার করেছিল। তারা ছিল ডাচ, পর্তুগিজসহ নানা জাতির।’
কিন্তু রোহিঙ্গা জাতির কেউ ছিল না। বিষণ্ন মনে ভাবে ছোট রোহিঙ্গা। তার জাতি কোনো দেশই আবিষ্কার করতে পারে নাই। তারা যদি একটা ক্ষুদ্র দ্বীপও আবিষ্কার করতো, আজ তাদের একটা দেশ থাকতো। নিজের দেশ।
ছোট রোহিঙ্গাকে আনমনা দেখে গ্লোবটা পাশে ঘোরায় ম্যাথু। বলে, ‘এই দ্যাখো তোমার দেশ!’
‘না, আমার কোনো দেশ নাই। ওইটা আমার জন্মস্থান।’ তারের বেড়ায় দু-হাতে থাবা মেরে নিষেধের ভঙ্গিতে বলে ছোট রোহিঙ্গা।
ম্যাথু খুব সতর্ক। আজ সে ছোট রোহিঙ্গাকে গ্লোবটা দেখাবে বলে অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পের পেছনের সীমানা পাঁচিলের ধারে ঘাপটি মেরে বসেছে। তবু সিকিউরিটি গার্ডের নজরে পড়লে ওর সদ্য কেনা জিনিসটা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। সঙ্গে যথারীতি লাঠির বাড়ি। সে চটজলদি ভূগোলক প্যাকেটে পোরে। স্কুলব্যাগটা কাঁধে তুলে দেয়ালের পাশ থেকে লাফিয়ে নেমে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সেই আওয়াজে চমকে ওঠে ছোট রোহিঙ্গা। দেয়ালের নিচের ঝোপঝাড় তখনো তোলপাড়। একটা সবুজ স্রোতযেন ঝোপ-জঙ্গল মিসমার করে তুমুলবেগে ছুটছে – সেদিকে তাকিয়ে বুকটা চুরমার হয়ে যায় ছোট রোহিঙ্গার।
আজ এত তাড়া কেন ম্যাথুর! স্কুল ছুটি হয়েছে, দুজনে গল্প করবে, তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি যাবে। তা না, মার-খাওয়া জন্তুর মতো পালাচ্ছে!
গত কদিন ম্যাথুর পথের দিকে চেয়ে চেয়ে ছোট রোহিঙ্গার দৃষ্টি ক্ষয়ে গেছে। ক্যাম্পের পানির ট্যাঙ্কে উঠে সে নিরিখ করেছে, গাছে চড়ে ম্যাথুর স্কুলে যাওয়া-আসার পথে নজর রেখেছে। ক্যাম্পে পানির ট্যাঙ্ক বা গাছ দৃশমান যা আছে – সবকিছুতেই ডিটেনিরা মোটা করে ‘উই ওয়ান্ট ফ্রিডম’ লিখে রেখেছে। তাই সিকিউরিটি গার্ডদের নজরদারি বেড়েছে খুব। ছোট রোহিঙ্গা অবশ্য তা পরোয়া করে না। বিশেষ করে ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ম্যাথু যখন পাখির গলায় শিস দেয়, সে ঘর ছেড়ে পড়িমরি দৌড়ায়। ঘর বলতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বরাদ্দ একখানা কন্টেইনার। এর থেকে বাইরে এক পা ফেলেছ কি গার্ডের বেতের বাড়ি, নিদেন গালাগাল। ‘নিজের দেশে যাহ্। না হয় গুলি করব। মাদার ফাকার কোন হানের!’
গালিটা খুব গায়ে লাগে ছোট রোহিঙ্গার। সে সাধ করে এখানে আসেনি। ক্যাপ্টেন কুকের আবিষ্কৃত দেশের লোকেরা তাকে সাগরে পাকড়াও করে ভিনদেশের এই দ্বীপে চালান করে দিয়েছে। যে-দ্বীপ তার কল্পনার মানচিত্রে কখনো ছিল না।
আর এটাই বা কেমন যে, বছরের পর বছর তাকে একই গালি নানা জায়গায়, নানা জাতির মানুষের মুখে শুনতে হবে! কথাটা ম্যাথুকে একদিন অভিমানী সুরে বলে সে। আরেকদিন নিজের কাহিনিটা শোনায়।
ছোট রোহিঙ্গা তখনো সিত্তে শহরের কাছাকাছি এক গ্রামে, নিজের বাড়িতে। তখনো তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সাগরপাড়ের ক্যাম্পে তোলেনি জান্তা সরকার। মা শহরের হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে শুনে আসে – ‘যে হারে ওরা বাচ্চা দিচ্ছে, দেশটা দখল করে ফেলবে। সময় থাকতে ঝাড়ে-বংশে খেদাও ওদের।’ স্কুল থেকে ফিরে ছোট রোহিঙ্গা মাকে বলে – ক্লাসের ছেলেরা ওকে ‘কালা’, ‘বাঙালি’ এসব বলে গাল দেয়। ‘এইটা আমাদের দেশ না, মা?’
তারপর তো তার স্কুলের পাট চুকে গেল। জীবন বাঁচাতে সিংহভাগ রোহিঙ্গা ঘোর বর্ষায় উত্তাল নদী পেরিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের রাষ্ট্রে। ছোট রোহিঙ্গার পরিবার নিজের দেশে থেকে গেলেও শুরু হয় তাদের শোচনীয় ক্যাম্পজীবন।
নোংরা, ঘিঞ্জি বস্তির অসহ্য গরমে সে ছুটে যায় সাগরতীরে। সাগরের হাওয়ায় দম নেয়। সাগরতীরে ধীরে ধীরে রাত নামতে দেখে। কখনো ঘুমিয়েও পড়ে সেখানে।
ঘুমে-জাগরণে সাগরের গান শুনতে শুনতে সে নৌকার হাল-বৈঠা মেরামত করে, মাস্তুলে পাল তোলে। নৌকা ভাসায় গভীর সমুদ্রে। ইঞ্জিনহীন, দেশি কাঠের নৌকা তুমুল বেগে ছুটতে থাকে এক অনাবিষ্কৃত দ্বীপের পানে। নিজেদের জন্য নতুন দেশ আবিষ্কারের স্বপ্নে বিভোর এক রোহিঙ্গা বালক।
স্বপ্নটা ভেঙে যায়। গভীর রাত। ধবধবা পূর্ণিমা। ঝাউয়ের কোমল ছায়ায়, সৈকতের সাদা বালুতে একটা পরিত্যক্ত বয়া জড়িয়ে সে শুয়ে আছে। তার মুখের ওপর বাবার কান্না ভেজা মুখ – ‘ওঠ বাবা, যেতে হবে?’ ছোট রোহিঙ্গা স্বপ্নটা চোখে নিয়ে লাফিয়ে ওঠে – ‘কোথায় বাবা? দেশ আবিষ্কারে?’
বাবা ও ছেলে বালুর ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটে। অদূরে জ্যোৎস্নাভাসা বালুর সৈকতে কয়েকটি ছায়াশরীর। কাছে যেতে জটলার একজনকে চিনতে পারে সে। সেই লোকটার হাতে বাবা তাকে সঁপে দেয়। তার হাতে দেয় সাতদিনের আন্দাজ খাবার আর প্লাস্টিকের পানির ক্যান, যা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় বাবার জন্য গুছিয়ে দেন মা। এই বোচকায়ও মায়ের বানানো খাবার। কিন্তু ছেলের বিদায় নেওয়া হয় না মায়ের কাছ থেকে। এ বড় গোপনযাত্রা। জীবনবাজি রেখে মৃত্যুপুরী থেকে নিষ্ক্রান্তের একমাত্র উপায়। ছেলের কোমরের কাইতনে টাকাকড়ির বটুয়া বেঁধে দিয়ে একাই তাকে বিদায় দেন বাবা। গভীর রাতে আদমভর্তি ট্রলারে তুলে দেওয়ার আগে সুরা ফাতেহা পাঠ করে ছেলের বুকে কয়েকবার ফুঁ দেন। ফুঁপিয়ে কান্না করেন।
বঙ্গোপসাগরের পর আন্দামান সমুদ্র ঠিকঠাক পাড়ি দিয়ে মালাক্কা প্রণালিতে এসে ছোট রোহিঙ্গাদের ট্রলারের ইঞ্জিন বিগড়ে যায়। তারপর তাদের বাহন ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে ভাসতে কোন দিকে ধেয়ে যায় – কেউ বুঝতে পারে না। ছোট রোহিঙ্গার মনে হয়, দুলে দুলে দক্ষিণে যাচ্ছে এটি। বা দক্ষিণ-পুবে। এভাবে এগোতে থাকলে সুমাত্রা, জাভা, বালি অতিক্রম করে ওরা যাবে আরো দক্ষিণে – অসংখ্য অনাবিষ্কৃত, নামহীন দ্বীপের রাজ্যে।
এদিকে সবাই নামধারী দেশে পৌঁছার দিন গুনছে। ছোট রোহিঙ্গার মুখে অনির্দেশ চলতে থাকা জাহাজের গল্প কেউ শুনতে চায় না। ‘ছোট মুখে বড় কথা’ বলে একদিন এক জোয়ান আদমি কষে চড় লাগায় ওর মুখে। তখন ঠোঁট ফেটে রক্ত চলে আসে। অপমানে চোখে পানি চলে এলেও ছোট রোহিঙ্গা জিব দিয়ে টেনে টেনে নিজের রক্তের স্বাদ নেয়। পেট ভরাতে চায় নিজের রক্ত পান করে। বহু আগেই তাদের সঙ্গে আনা পানি, খাবারবস্তু ফুরিয়ে গেছে। সাগরের বিস্বাদ নোনা জল খেয়ে পেটে পীড়া, বমি, ডায়রিয়া। এ অবস্থায় মরতে মরতে ভিনদেশি জেলেদের অসীম দয়ায় নৌকার যাত্রীদের জীবন রক্ষা পায়। জেলেরা ছোট ছোট নৌকা বেয়ে দফায় দফায় মুমূর্ষুদের তীরে নামিয়ে আসে। ছোট রোহিঙ্গা বমি করে করে তখন বেহুঁশ। তা না হলে সে বোটেই থেকে যেত।
চালকহীন বোট নিয়ে একা ভাসতে থাকত নিঃসীম সাগরে। এভাবে চলতে চলতে নৌকাটা কোনো একদিন এক অজ্ঞাত দ্বীপের কোনায় নিশ্চয় জোর ধাক্কা খেত!
সে ধাক্কা খেয়ে যখন জেগে ওঠে, সামনে দেখে সিত্তে সৈকতের সেই চেনা লোক। তাকে পানি খেতে ভাত খেতে সাধছে। না হলে সে নাকি বাঁচবে না। তখন তিনি কী জবাব দেবেন ছোট রোহিঙ্গার বাবাকে, যিনি সন্তানকে বাঁচাতে গাঁটের টাকা খরচ করে নুহের নৌকার মতো ট্রলারে তুলে দিয়েছেন? এই বলে চেনা লোকটি হাত তুলে প্রথম জেলেদের জন্য, পরে আচেহ রাজ্যের বন্দরপুলিশের জন্য দোয়া মাঙ্গে। তখন ছোট রোহিঙ্গা বোঝে যে, ওরা মহান হৃদয়ের জেলেদের কাছ থেকে ছিনতাই হয়ে, এখন আছে নিষ্ঠুর বন্দরপুলিশের জিম্মাদারিতে।
শরীরে জোর ফিরতে ছোট রোহিঙ্গা ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখে। একটা মস্তবড় স্টেডিয়ামের শেডের নিচে তাদের গাদাগাদি ঠাঁই। এখনো সিঁড়িতে গড়াগড়ি যাচ্ছে নির্জীব, নির্জুরি অসুস্থ মানুষ। এটাও গরিব দেশ। এত উটকো মানুষের আহার-পথ্য কোথা থেকে জোগাবে? তা বলে তাদের পালিয়ে যেতে বা চড়ে খেতেও দেবে না। স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর পথ দিনরাত আগলে রাখে এক দঙ্গল প্রহরী। দু-দিনের মাথায় ছোট রোহিঙ্গা বোঝে যে, বিস্তর হাঁকডাক ছেড়ে চৌকি বসানো হলেও কার্যত এ ঢিলেঢালা। দুপুরের চিটচিটে আর্দ্রতায় ইউনিফর্মের ভেতর ওরা লতার মতো নেতিয়ে পড়ে। তখন শুধু সিত্তে সৈকতের চেনা লোকটাকে ছোট রোহিঙ্গার চোখে চোখে রাখতে হবে, যাতে তার চোখে ধুলা দিয়ে সে পালাতে পারে। একদিন ভরদুপুরে সেই মওকা মিলে যায়। আচেহে থেকে ছোট রোহিঙ্গা কোথায় যাবে? কোথায় আর, সেই দেশের মানুষের নিঃশব্দ ঢল যেদিকে, রাজধানী জাকার্তায়!
সেই আগুন-ঝরা, বাষ্প-ওড়া মহানগরে ঘুরে ঘুরে ছোট রোহিঙ্গার অর্থহীন দিন গোজার। বন্দর থেকে বন্দরে ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে বহু কষ্টে অবশেষে কেষ্ট মেলে। তাকে নানা খান থেকে সাগরে ভাসার প্রস্তাব দেয় ডজনখানেক পাচারকারী। শুভ দিনক্ষণ দেখে ওরা যাবে খ্রিসমাস আইল্যান্ডে। দ্বীপটা এই সৈকত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ।
তার জন্য কাইতনে বাঁধা বটুয়া খুলে সব টাকা-পয়সা ঢেলে দিতে হয় দালালের কোঁচরে। আগের জার্নির মতো বডি কন্ট্রাক্টের বালাই নেই এবার। আগাম শোধবোধ। তুমি সশরীরে গন্তব্যে পৌঁছবা কি পৌঁছবা না, সে তোমার কপালজোর বা কপালদোষ।
‘কে গন্তব্যে পৌঁছতে চায়!’ ছোট রোহিঙ্গা নিজের পকেট ফাঁকা করতে করতে ভাবে। ‘যে দ্বীপ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, যে দ্বীপে মানুষের বসবাস, সেটা তার গন্তব্য হতে পারে না। সে যাবে দূরে, আরো দূরে, নতুন দেশ আবিষ্কারে।’
খ্রিসমাস দ্বীপের সফরটা ছিল নাটকীয়। আকাশে চাঁদ ছিল না। হাতের তালু দেখা যায় না এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। বকনা বাছুরের মতো তাদের গাদিয়ে ঢুকিয়ে কালো তেরপলে ঢেকে যখন জাহাজখানা চলতে শুরু করে, তখন ছোট রোহিঙ্গার মনে হয়, জলবাহনটা যেন পণ্যবাহী আর ওরা সব মালামাল। তাতে ছোট রোহিঙ্গার চোখ খুলে যায়। এ যুগে পণ্য হলে চলাচলে সুবিধা অনেক। এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় চলে যাওয়া যায়। এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগরে যাওয়া যায় কার্গো জাহাজে।
তেরপলের নিচে রাত শেষ হয়। পুবাকাশে সূর্য ওঠে। নৌকা থামার ঝাঁকুনিতে জেগে ওঠে ছোট রোহিঙ্গা।
ইঞ্জিনের শব্দটা থেমে যেতে কানে আসে পানির কলকল। গাঙচিলের হাঁকডাক। বন্দরের কোলাহল। সমুদ্রের শোঁ-শোঁ গর্জন।
শরীর থেকে তেরপল সরে যায়। বন্দর কোথায়? এ তো মধ্যসমুদ্র! বিশাল এক জাহাজ থেকে স্টিলের মই নামিয়ে ওদের ওপরে তোলা হচ্ছে। যেন সশরীরে স্বর্গে আরোহণ। ছোট রোহিঙ্গা খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বোঝে – এ স্বর্গ নয়, নরকেরও বাড়া একটি টহল জাহাজ অস্ট্রেলিয়ার। টহলদারদের মাথায় সাদাকালো ডোরাকাটা ব্যান্ড।
চোখে কালো সানগ্লাস। গায়ে কলাপাতা-সবুজ জার্সি।
যেন আটক জাহাজের যাত্রীরা সব খুনে অপরাধী, অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছে, সেইভাবে হলুদ লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে জাহাজের সামনের ডেকে লাইন ধরে ওদের বসিয়ে রাখে। সবার আনত মুখ। চোখের সামনে পাহারাদারদের জবরদস্ত বুটের সারি।
ছোট রোহিঙ্গার বয়স কত? সে জানে তার বয়স কত। সিত্তে সৈকত থেকে গোটা সফরে তার যে এক সাল খরচা হয়ে গেছে, সেটি যোগ করলে বর্তমানে চৌদ্দ। কিন্তু এর প্রমাণ দাখিল করার মতো তার হাতে কাগজপত্র কই? রাখাইন রাজ্যের মাটিতে সেসব কাগজ মিশে গেছে বা মহল্লার ঘরে ঘরে ফুঙ্গিদের দেওয়া আগুনে ছাই হয়ে গেছে। তাছাড়া তার জন্মের সন-তারিখের হিসাব থাকার কথা তো আরবি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে।
এসব কথা কে শোনে। মেডিক্যাল পরীক্ষা করে বয়স নিরূপণেরও সুযোগ নেই। খ্রিসমাস আইল্যান্ডে কোনো ডাক্তার জনপ্রতি পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে নারাজ। কারণ ঝাঁকে ঝাঁকে যে রিফিউইজি আসছে, তাদের দুদিনের বেশি এ-দ্বীপে ঠাঁই হয় না। আইন অমান্য করে অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও ত্বরায় চালান করে দেয় দূরের দেশ পাপুয়া নিউগিনি বা ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র নাউরুতে। ছোট রোহিঙ্গা চালান হয় পাপুয়া নিউগিনির মানস আইল্যান্ডে।
পরে একটা ছবি দেখেছে ছোট রোহিঙ্গা। সাদা ও কালো দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী একটা কাগজে সই করে হ্যান্ডশেক করছেন। তাঁদের মুখের ওপর ঘন ঘন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। তারপর দুই রঙের দুটি হাত মাথার ওপর তুলে ধরে সেই সই করা কাগজ, যার বরাতে অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পের রেলওয়াগন-মার্কা ঘরগুলি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে।
‘এই কালোটাই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী।’ ঠা ঠা করে হাসে ম্যাথু। সে কি গর্বিত তার প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে?
‘আরে না।’ বলে ম্যাথু। আর কথা না বাড়িয়ে তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের পিঠ তারের বেড়ায় আড়াআড়ি রাখে। একই ভঙ্গিতে বেড়ার আরেক পাশে হাত রাখতে বলে ছোট রোহিঙ্গাকে। কার গায়ের রং কতখানি গাঢ় – তুলনা করে দেখতে চায়। ছোট রোহিঙ্গা বলে ক্যাম্পে ঢোকার আগে তার গায়ের রং ম্যাথুর মতোই ছিল রোদপোড়া, জলে ভেজা মোলাগুড়ের মতো খয়েরি কালো। ক্যাম্পের কন্টেইনারে থাকতে থাকতে ইটচাপা ঘাসের মতো ম্যাদা মেরে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আগের রং আবার ফিরে পাবে, যখন সে সাগরে নাও ভাসাবে।
‘হ্যাঁ, এবার নতুন দেশ আবিষ্কারে যাবে’, হাসতে হাসতে বেঁকে গিয়ে ম্যাথু বলে, ‘সাদাদের বদলে দুটি কালো ছেলে, হা হা হা।’
এভাবে ছোট রোহিঙ্গার স্বপ্নে বাতাস দিয়ে প্রতিবার হাসতে হাসতে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় ম্যাথু।
দুই
অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পে ছোট রোহিঙ্গার আজ কতদিন? সে রবিনসন ক্রুশোর মতো লাঠিতে দাগ কেটে রাখেনি যে, সংখ্যাটা ঠিকঠাক বলতে পারবে। তবে হিসাবটা নিশ্চয় ক্যাম্পের নথিতে আছে, যদিও সে ওখানে মানুষ না, একটি সংখ্যা মাত্র। সেই সংখ্যাটা ক্যাম্পের সবার মতো তার হাতেবাঁধা ফিতেয় লেখা আছে আর গার্ডরা তাকে এই সংখ্যা নামেই ডাকে। ক্যাম্পের সবার ছোট বলে ডিটেনিরা ডাকে ‘ছোট রোহিঙ্গা’। ডিটেনশন ক্যাম্পে কজন বাঙালি আসার পর এ-নামে ডাকতে থাকলে এটাই তার নাম হয়ে যায়।
তখন প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে ছোট রোহিঙ্গার দেখা হতো কদাচিৎ। উঁচু তারের সীমানার ভেতর আলাদা দুটি মহল্লা।
শুধু ট্রে হাতে দু-বেলা খাবার আনতে যেত সে অপর পাশে। ফিরেও আসত প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। মনে হতো – ওই জায়গায় যত বেশি সময় কাটাবে, বড়রা ততো বেশি ওকে নিরাশ করবে। বরং কন্টেইনারে স্বপ্নঘোরে থাকা ভালো। তার রুমমেট দুজন বয়সে বছরখানেকের বড় হলেও একজন রোগাভোগা, আরেকজন বিছানায় শুয়ে রাতদিন ঘরে ফেরার দিন গোনে; যদিও রুমে একটি পিংপং খেলার টেবিল, রঙিন টেলিভিশন আর কিছু রং পেন্সিল রয়েছে। ছোট রোহিঙ্গা ছবি আঁকে না। রঙিন পেন্সিলে ম্যাপ আঁকে। আর কন্টেইনারের ছাদে উঠে সমুদ্র খোঁজে। এভাবেই একদিন ম্যাথুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ওর।
ম্যাথু স্কুলে যাওয়া-আসার সময় রোজ তারের বেড়ার পাশটিতে দাঁড়িয়ে পড়ত। স্কুলব্যাগ মাটিতে নামিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখত – তার বয়সী একটি ছেলে যেন বিশাল এক খাঁচার ভেতর মাছির মতো নড়াচড়া করছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সহপাঠীরা এগিয়ে যেতে ম্যাথুকে হাতছানি দিয়ে ডাকে ছোট রোহিঙ্গা। নিজেও কন্টেইনারের ছাদ থেকে ছুটে যায় বেড়ার ধারে – ‘এই, স্কুলে তোমাদের আজ কী পড়িয়েছে? দেশ আবিষ্কারের কথা লেখা আছে তোমাদের পাঠ্যবইয়ে?’ এত ব্যাকুল হয়ে প্রশ্নটা করে, যেন পাঠ্যবইয়ে দেশ আবিষ্কারের কথা লেখা থাকলে সে ম্যাথুর স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে মুচকি হাসে ম্যাথু। অনেকটা তার মতোই দেখতে এই বালক। কথাও বলে তার মতো ভুল ইংরেজিতে। দেশ আবিষ্কারেও তার আগ্রহ। ম্যাথুর খুব মজা লাগে। সে বলে – ‘দেশ আবিষ্কার করতে চাইলে তোমাকে নাবিক হতে হবে।’ বেড়ার ওপাশে মাথা নাড়ে ছোট রোহিঙ্গা। ম্যাথুর তাতে কথা বলার জোশ আরো বেড়ে যায় – ‘নাবিকেরা কানে হাঙরের কাঁটার দুল পরে, জানো তো?’ ছোট রোহিঙ্গা এবার দুদিকে মাথা নাড়ে – না, সে জানে না তা।
ম্যাথুর শখ সে আরেকটু বড় হলে নাবিক হয়ে যাবে। সামুদ্রিক পাখি ফ্রিগেটের মতো বাতাস কেটে কেটে এগোবে তার দ্রুতগামী জাহাজ। ‘বড় বড় পালতোলা জাহাজ দেখেছ তো?’ ম্যাথু শুধায়, ‘কুচিদার ফ্রক পরা মেয়ের মতো নাচতে নাচতে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে যায়?’
মেয়েদের প্রসঙ্গ আসতে দুজনে একসঙ্গে হেসে ওঠে।
আচমকা হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে যায় ছোট রোহিঙ্গা। ম্যাথুকে সে বোঝাতে চায় কোনো তকমা, নজরানা বা সোনাদানার লোভে সে দেশ আবিষ্কারের অভিযানে যাচ্ছে না। তা বলে কাজটা নিঃস্বার্থও নয়। ছোট রোহিঙ্গা নতুন দেশ আবিষ্কার করতে চায় তার জাতির জন্য।
জাতির জন্য নতুন দেশ চাওয়া – বুঝতে পারে না ম্যাথু। কিন্তু চেহারা গম্ভীর করে বলে, ‘হুম আমি বুঝতে পারছি, তুমি
এল-ডোরাডো বা স্বর্ণরাজ্য সন্ধানী নও কোনোভাবে।’
বিদায় নেওয়ার আগে সে বারবার মনে করিয়ে দেয় – সবকিছুর আগে ছোট রোহিঙ্গাকে অবশ্য অবশ্য নাবিক হতে হবে। তারপর তার দরকার একটি নতুন ধরনের জাহাজ ও দীর্ঘ সমুদ্রভ্রমণ।
পরদিন তারের বেড়ার ওপাশে জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে বসে ম্যাথু। একটা মলাটহীন বই নাকের ডগায় মেলে ধরে নিচু স্বরে বলে – কলম্বাসের জাহাজের নাম ছিল সান্তা ক্লারা, নিনা, পিন্টা। সব কটাই ছোট ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। এ জাহাজগুলির সাধারণ নাম ছিল ক্যারাভেল। আর জেমস কুকের জাহাজের নাম তো জানোই – এন্ডেভার। তারপর বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে ম্যাথু আতিপাতি কিছু খুঁজতে থাকলে ছোট রোহিঙ্গা বলে – সে জানে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু তার নতুন দেশ আবিষ্কার এদের মতো নয় পুরোপুরি। সে নিজেকে সভ্য বা সভ্য জাতির বলে দাবি করে না। এবং আবিষ্কৃত দেশের মানুষদের ‘অসভ্য’ তকমা দিয়ে কচুকাটাও করতে চায় না।
ছোট রোহিঙ্গার কথায় চমকে উঠে, ঠাস করে দরজা বন্ধ করার মতো বইটা বন্ধ করে ম্যাথু। বলে – সেও নিজেকে সভ্য দাবি করে না। ভাবে সে বর্বর। মবি ডিক-এর হারপুনার কুইকেগের মতোই বর্বর। কিন্তু কুইকেগের মতো বর্বর রাজার ছেলে নয় সে। ম্যাথুর বাবা সামান্য একজন মাছ ব্যবসায়ী। নিজের তৈরি দেশি নৌকা নিয়ে সাগরেও মাছ ধরতে যায়। ছোট রোহিঙ্গা বলে, তার বাবাও সাগরে মাছ ধরেন। তবে খুব গরিব। সপ্তাহে মাত্র দুদিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার অনুমতি মেলে রোহিঙ্গাদের।
সে যাক। ছোট রোহিঙ্গা বলে – সে দেশ আবিষ্কার করতে পারলে নিজে থেকে এর নাম দেবে না। যেমন অভিযাত্রিক বা সফল কোনো বণিক অচেনা দ্বীপে উপনীত হয়ে একটা জবরদস্ত নাম দিয়ে বসে। স্থানীয়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ধার ধারে না। তাছাড়া কোনো অবস্থাতেই ছোট রোহিঙ্গা দ্বীপের মানুষের দিকে গুলি ছুড়বে না।
সে গুলি ছুড়বে কীভাবে? তাদের সঙ্গে বন্দুকই তো থাকবে না – ম্যাথু তাকে সাফ সাফ বলে। কারণ এক দঙ্গল নাবিক নিয়ে ওরা সাগরে ভাসবে না যে, জাহাজে বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকবে।
‘কিন্তু জলদস্যু যদি জাহাজ আক্রমণ করে?’ ছোট রোহিঙ্গা প্রশ্নটা করেই নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে।
অতীতে তিরন্দাজ, ঢালধারী, বন্দুকধারী এসব আবশ্যকীয় জঞ্জাল নিয়েই সাগরে ভাসানো হতো জাহাজ। তারপর জোরে ড্রাম পেটাতে পেটাতে সাগর ছাড়িয়ে মহাসাগর। লুকিয়ে লুকিয়ে তো দেশ আবিষ্কার হয় না!
‘তা হয় না।’ সায় দেয় ম্যাথু।
‘রাজ-রাজার স্পন্সর নাই, ব্যাকিং নাই’, উদাস গলায় বলে ছোট রোহিঙ্গা, ‘আমাদের ভাড়া নৌকা নিয়েই অভিযানে যেতে হবে।’
ছোট রোহিঙ্গার কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ে ম্যাথু। নিজস্ব জাহাজই যদি না থাকে, নাবিক যদি সে না হতে পারে, কানে যদি হাঙরের কাঁটার দুল না-ই পরতে পারে – অভিযানে গিয়ে কি লাভ? ছোট রোহিঙ্গার মতো তার জাতির জন্য নতুন দেশ আবিষ্কারের দরকার নাই। তাদের নিজের দেশ আছে।
ম্যাথুকে আনমনা ও বিষণ্ন দেখে ছোট রোহিঙ্গা বলে – দেশ বা মহাদেশ আবিষ্কারে বেরিয়ে সবাই নরখাদকের গল্প নিয়ে ফেরে।
‘এসব বোগাস,’ ক্ষেপে ওঠে ম্যাথু। তার দেশের মানুষের নামেও নরখাদকের দুর্নাম রটিয়েছিল ভিনদেশি অভিযাত্রীরা। নিজেদের সভ্য প্রমাণ করতে এসব আজগুবি গল্প ফাঁদে ওরা।
ম্যাথুর কথায় সায় দিয়ে ছোট রোহিঙ্গা মৌলিক একটা প্রশ্ন ছোড়ে – ওরা সেসব দেশের আবিষ্কারক হয় কীভাবে, যেখানে আগে থেকেই লোকের বসবাস ছিল!
‘ঠিক।’ ম্যাথুর রাগ তখনো পড়েনি, সে উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘তাদের আসার বহু আগে থেকে আমরা ছিলাম।
আমাদের গান ছিল। ফসলের মাঠ ছিল। পাখি ছিল। ফুল ছিল। হাঁস-মুরগি সব ছিল।’
ছোট রোহিঙ্গা যত দূর জানে, তার জন্মস্থান কোনো বিদেশি আবিষ্কার করেনি। বা আবিষ্কারের দাবি তুলে তাদের সভ্য বানিয়েছে – এমন কিছু জাহির করেনি। সে ম্যাথুর জন্য ব্যথিত হয়ে বলে – দেশ আবিষ্কার করা হয়ে গেলে অচেনা দেশের, অজানা মানুষের নাকে নাক ঘষে ভালোবাসা বিনিময় করবে সে। এই কথায় ম্যাথু সাড়া না দিলে সে প্রতিজ্ঞা করে, ‘আমি সদা সতর্ক থাকব – নতুন আবিষ্কৃত দেশের মানুষ আমার মূর্তি যেন না গড়ে। আমার অজান্তে কেউ বানিয়ে ফেললে ভবিষ্যতের মানুষ যেন সেটা রক্তলাল রঙে না চুবায়। বা দড়িতে বেঁধে উঁচু স্থান থেকে টেনে নামিয়ে না ফেলে।’
‘ঠিকমতো সামাল দিতে পারলে নতুন দেশ আবিষ্কার বেআইনি কিছু নয়।’ শেষমেশ বিড়বিড়িয়ে কথা কটা বলে প্রস্থান করে ম্যাথু।
তিন
রাত্রিবেলা স্বপ্নের মধ্যে ছোট রোহিঙ্গা তার ভাই-বোনের নাম ধরে ডাকে। কোনো সাড়া মেলে না। সে নতুন দেশ আবিষ্কার করে তাদের জন্য জাহাজ পাঠাবে – নৈঃশব্দ্যের অতলে ডুবে থাকা মানুষগুলিকে প্রতিবার এই প্রতিশ্রুতি দেয়। কখনো কান্নাকাটি করে বাবার হাত ধরে, মায়ের গলা জড়িয়ে। নিজের কান্নায় ঘুম ভেঙে গেলে দরজা ঠেলে বাইরে আসে। মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ। অচেনা তারকামণ্ডলী। মনে হয় আকাশটা অনেক বেশি কাছে। আর দ্রুত নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে। ছোট রোহিঙ্গার গা ছমছম করে। মনে তার রোজকেয়ামতের ভয়। ভয় তাড়াতে প্রাপ্তবয়স্কদের মহল্লার দিকে তাকায়, যেখানে তার বাবার বয়সী লোকজনও আটক রয়েছে। দুটি মহল্লার মাঝখানের গেটে তালা। রাতের বেলা এপাশ থেকে ওপাশে কেউ যেতে পারে না। ওখানে প্রতি রাতে নিদ্রাহীন কজন বিচ্ছিন্নভাবে বসে সিগারেট টানে বা পায়চারি করে। ছোট রোহিঙ্গার জন্য সিগারেটের বরাদ্দ নেই।
শেভিং রেজারও নেই তার, হাতের শিরা কাটার। পাশের মহল্লায় হপ্তায় হপ্তায় কেউ না কেউ হাতের শিরা কাটে, গলায় দড়ি দেয়। এক জায়গায় অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে থাকতে ওরা পাগল হয়ে গেছে।
ডিটেনশন ক্যাম্প যেন কবর। এখানে ঢোকার রাস্তা আছে, বেরোনোর পথ নেই। টিনের ছাদ, প্লাস্টিকের পার্টিশন। গরমে ভয়াবহ অবস্থা। তখন চাদরে আপাদমস্তক মুড়ে মাঠে ঘুমায় কিছু ডিটেনি। একদিন রাতশেষের পাতলা আঁধারে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে তাদের লাশ ভেবে ভীষণ ভয় পেয়েছিল ছোট রোহিঙ্গা। তার ঘুমভাঙা চোখে এক রাজ্যের বিভ্রান্তি। সে কি অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পে, না সিত্তে টাউনের পাশের গ্রামটিতে? যেখানে থরে থরে লাশ পড়ে ছিল আর দিগন্ত জুড়ে কালো ধোঁয়া উড়ছিল আকাশের চাঁদি অবধি। পরদিন সকালে সে খাবারের ট্রে হাতে যেতে যেতে দেখে সেই মাঠে কজন বসে ইমিগ্রেশন অফিসার বরাবর দরখাস্ত লিখছে, ফরম ফিলাপ করছে দিস্তা দিস্তা। সবই ফলস। তবু লিখে যায়। ছিঁড়ে ফেলে। কারণ তারাও পাগল হয়ে গেছে।
ছোট রোহিঙ্গার যে রুমমেট দেশে ফেরার দিন গুনত, সে নিজের নাম-ধাম ভুলে গেছে। কোথায় বাড়ি কোথায় ঘর জিজ্ঞেস করলে উল্টাপাল্টা দেশের নাম বলে। খেয়ে বলে খায় নাই। না-খেয়ে বলে খেয়েছি। ডিটেনশন ক্যাম্পে বছরের পর বছর একই রুটিনে থাকতে থাকতে স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে, অথবা ব্যথানাশক পেনাডল ট্যাবলেট খেয়ে খেয়ে এ দশা হতে পারে – প্রাপ্তবয়স্ক এক ডিটেনি ওর নাড়ি টিপে বলে একদিন। তা বলে নিজের নাম ভুলে যাবে? ছোট রোহিঙ্গা হাতে চিমটি কাটে – তার স্মৃতি যদি লোপ পায় কীভাবে নতুন দেশ আবিষ্কারে যাবে? ভুলপথে জাহাজ চালিয়ে উপনীত হবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রাখাইন রাজ্যে, যেখানে মৃত্যু ওঁৎ পেতে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, স্মৃতিই যদি না থাকে, তার দেশ আবিষ্কারের ইচ্ছাই তো অজানা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
এক রাতে ডিটেনিরা রান্নাঘরের সরঞ্জামাদি নিয়ে মারামারি জুড়ে দিলে, রায়ট পুলিশ সাইরেন বাজিয়ে ক্যাম্পে ঢোকে। তাদের পেছনে হাট করে খোলা ফটক, টিমটিমে বাতি। ফটকের বাইরে এক পা ফেলেই ছোট রোহিঙ্গা বোঝে যে, তার চরম ভুল হয়ে গেছে। সিকিউরিটির লোকগুলি পিঁপড়ার মতো বেরোচ্ছে কন্টেইনারের পেছন থেকে, গহিন অরণ্য থেকে, সাগরের তল থেকে। তখনই উল্টা দৌড়ে ঢুকতে চায় সে ক্যাম্পে। কিন্তু কিছুতেই পারে না। ঘাড়ের ওপর আড়াআড়ি ছুরির পোচ পড়ায় গেটের পাশেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। স্বাধীন হতে চাওয়ার খেসারতস্বরূপ তার বরাতে জোটে – ঘাড়ে ব্যান্ডেজ আর বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছোঁয়াচে রোগীদের জন্য তৈরি একখানা নির্জন সেল।
রাতদিন ছোট রোহিঙ্গার মাথার ওপর ক্ষীণ আলোর বাল্ব জ্বলে। খাটিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যায় পিঁপড়ার স্রোত।
সে পিঁপড়া গোনে কিছুদিন। তারপর দেয়ালে দাগ কেটে দিনরাতের হিসাব রাখতে মেঝে থেকে পাথরকুচি কুড়িয়ে নেয়। কিন্তু কী ভেবে দেয়ালে দাগ কাটে না, নতুন দেশ আবিষ্কারের আকাক্সক্ষা ধরে রাখতে ছবি আঁকে। টিনের বেড়ায় পাথরকণা টেনে সাগরের ঢেউ তুলে সেই তরঙ্গমালায় জাহাজ ভাসায়। এভাবে ছোট রোহিঙ্গা মেজো রোহিঙ্গায় পরিণত হয়। তারপর সেল থেকে ছাড়া পায় একদিন।
বাইরে এসে ছোট রোহিঙ্গার মনে হয়, উঁচু তারের বেড়ার অনেকগুলি চোখ। ওদের হাগা-মোতা-মাস্টারবেশন সব চেয়ে চেয়ে দেখে এই চোখগুলি। আয়নায় চেহারা দেখতেও ওর ভয়। সাদা চুল-দাড়ির, তোবড়ানো গালের কাউকে যদি আর্শিতে দেখতে পায়!
বা যদি দেখে এমন কাউকে, যার চাপার দাঁত নেই, মাছের মতো সামনের সারির দাঁত দিয়ে খাবার চিবায়! কী মহাশক্তিধর ওই দেশ, যে অন্য দেশে ক্যাম্প খুলে বাচ্চাদেরও বুড়ো বানিয়ে দেয়!
‘টাকাও তাদের অনেক’, নিজের সদ্য গজানো পাতলা গোঁফে তা দিতে দিতে ভাঙা গলায় বলে ম্যাথু। ‘এই দ্বীপের চেয়েও অধিক সংখ্যক মানুষ ক্যাম্পে রেখে দ্বিগুণ খরচে ওরা পোষে। গার্ডদের বেতন দেয়। তাদের অস্ত্রপাতি জোগায়।’
‘ওদের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা কি চিরস্থায়ী?’ ছোট রোহিঙ্গা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই।’ ম্যাথু বিজ্ঞের মতো বলে। ‘সবকিছু একই রকম থেকে গেলে সময়ও তো এক জায়গায় স্থির হয়ে যাবে। অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে আলাদা কিছু থাকবে না।’
মাথা নাড়ে ছোট রোহিঙ্গা। সেটাই তার আশা। মানে চিরস্থায়ী বলে কোনো কিছু না থাকা।
দ্বীপের মানুষগুলি এমনিতে খারাপ না। দিনের বেলা বেশ বন্ধুবৎসল। রাত হলে কেমন জানি হয়ে যায়। যারা ড্রিংক করে ওরা, যারা ড্রিংক করে না তারাও। লোকগুলি ক্যাম্পে ঢুকে টাকা চায়। মারামারি করতে চায়। এভাবে উভয়পক্ষে একদিন মারামারি বেধে গেলে, কে বা কারা যেন ক্যাম্পের কারেন্টের মেইন সুইচ অফ করে দেয়।
ছোট রোহিঙ্গা তখন ক্যাম্পের মাঠে, রাতের খাবার নিয়ে রুমে ফিরছে। কোনো এক দাঙ্গাকারীর ধাক্কায় তার হাতের ট্রে ছিটকে পড়ে দূরে। যৎসামান্য এ খাবারটুকু কুড়িয়ে নিতে, মাটিতে প্রণত হয়ে বসতে তার বডি ডিঙিয়ে যায় লোকগুলো। তারপর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে একজন। আর এক দঙ্গল সিকিউরিটি গার্ড পেছন থেকে দ্বীপের লোকদের ধাওয়া করলে সেও বিশাল এক ঢেউয়ের ধাক্কায় বাইরে চলে আসে। হাতটা তখনো তাকে ছাড়ে নাই। অন্ধকারে অনেকটা পথ দৌড়ে এসে একটা নারকেল বাগানের মাঝখানে থামে ওরা। ম্যাথু মোবাইলের বাতি জ্বালায়। ‘অঃ তুমি দেখি আস্ত একটা মানুষ!’
পানরাঙা দুপাটি দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলে ম্যাথু।
সে তারের বেড়ার ওপাশ থেকে ছোট রোহিঙ্গার অবয়বের টুকরা টুকরাই এতদিন দেখেছে শুধু।
চার
নারকেল বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা যখন সাগরতীরে পৌঁছে, ততক্ষণে রাত শেষ। সমুদ্রে ভাটা চলছে। দুজনে মিলে ম্যাথুর কাঠের ডোঙা সৈকতের বালুর ওপর দিয়ে ঠেলে পানিতে নামায়। নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট দেয় ম্যাথু। অচিরেই ভোরের পাতলা কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট্ট সবুজ দ্বীপ। ওটাই তাদের গন্তব্য।
খানকয়েক জেলের বাস এই দ্বীপে। ম্যাথুর বাবারও অস্থায়ী আস্তানা এখানে। তিনি দ্বীপের এই আস্তানায় থেকেই সাগরে মাছ ধরতেন। গত সনে হার্টের অসুখ ধরা পড়ায়, মাছ ধরায় ইস্তফা দিয়ে শহরের ভাড়া বাড়িতে ফিরে গেছেন। ওখানে অন্যের ধরা-মাছ কিনে বাজারে পাইকারি বেচেন। দ্বীপের ডেরা এখন ম্যাথুর। সে স্কুলের পাট চুকিয়ে, দেশি ডোঙা বেয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। তার ভাষায় জাহাজের নাবিক হওয়ার মহড়া দিচ্ছে সে এভাবে।
কাঠের উঁচু পিলারের ওপর বাঁশের বেড়া আর নারকেল পাতার ছানির ঘর ম্যাথুর। ঘরের বেড়া-কাটা জানালায় এক টুকরা
রং-চটা পর্দা সাগরের বাতাসে ওড়ে দিনমান। ঘরের পিছের জোড়া নারকেল গাছে বাঁধা দড়ির দোলনায় দোল খায় পোষা বিড়াল। উঠানের গাছের ডালে ডালে পাখি গান গায়, খুনসুটি করে। রূপকথার রাজকন্যার আবাস যেন। ম্যাথুর ভাবখানাও এমন – রাক্ষসপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করা অসীম সাহসী রাজপুত্র সে।
এখন সুখে-শান্তিতে তারা দিনাতিপাত করবে।
ছোট রোহিঙ্গাও ম্যাথুর সাহসের তারিফ করে। কিন্তু রাজপুত্রের সঙ্গী হয়ে, সুখে একা দিন গোজার করলে তো তার চলবে না! দেশ আবিষ্কারে বেরোতে হবে।
‘সবুর! সবুর!’ চুলা থেকে ম্যাগি নুডলসের পাত্র নামাতে নামাতে বলে ম্যাথু। আপাতত ছোট রোহিঙ্গাকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে, যাতে ক্যাম্পের লোকে ফের পাকড়াও করে খোয়াড়ে না পোরে।
ওরা কুকুরের মতো অনুসরণ করে? নাকি সাপের মতো? ভাবে ছোট রোহিঙ্গা। ম্যাথুর ছোট্ট ডেরায় নোঙর, বড়শি, বর্শা, ছুরি, ফুলহাতা বর্ষাতি, মাছের টোপ রাখার পাত্র, কেরোসিনের বাতি, মাছ শীতল রাখার বরফের ডাব্বা আর একটি খুদে ডিপফ্রিজ। তার মানে সবই মাছ ধরার সরঞ্জাম। ‘একটা স্পাইগ্লাস থাকা দরকার ছিল না, এখানে?’ ছোট রোহিঙ্গা বলে উদ্বিগ্নভাবে।
‘রবিনসন ক্রুশোর মতো?’
‘হ্যাঁ। ডিটেনশন ক্যাম্পের লোক ধরতে এলে যেন আগেভাগে দেখতে পাওয়া যায়!’
এ নিয়ে ভাবনার কিছু নাই। ম্যাথু নুডলস খেতে খেতে উপদেশ দেয় – ছোট রোহিঙ্গার এখন দরকার নিশ্ছিদ্র ছদ্মবেশ।
ত্বরায় তোক-পিসিন ভাষাটা ওর শিখে নিতে হবে। আর লোকালদের মতো পান-সুপুরি খেয়ে দাঁত রাঙাতে হবে।
ছোট রোহিঙ্গা ধীরে ধীরে পান খাওয়া রপ্ত করে ম্যাথুর কাছ থেকে। ম্যাথু নিজের মুখের চাবা-পান জিব দিয়ে ঠেলে ওর মুখে ভরে দেয়, পাখির বাসায় ছানাকে যেভাবে আধার খেতে শেখায় মা, অথবা পাখি দম্পত্তি পরস্পরের সোহাগ জানায় যেভাবে। একদিন পান চাবাতে চাবাতে ম্যাথুকে ইউনুস নবীর মাছের পেটে থাকার গল্পটা বলে ছোট রোহিঙ্গা। ম্যাথুও জানে বাইবেলের জোনার গল্প। ঈশ্বর বিশাল একটা মাছ সৃষ্টি করলেন জোনাকে গিলে ফেলার জন্য। ছোট রোহিঙ্গা বলে – সে জোনা ওরফে ইউনুস নবীর মতো মাছের পেটে বসে দরিয়া থেকে দরিয়া ঘুরতে চায়। আবিষ্কার করতে চায় একটা নতুন দেশ।
‘তুমি মাছের পেটে হজম হয়ে যাবে।’ ছোট রোহিঙ্গাকে হতাশ করে ম্যাথু বলে, ‘কারণ তুমি প্রফেট নও।’
ক্যাম্প থেকে মুক্ত হয়ে ছোট রোহিঙ্গা দিশা পায় না। আজ এটা ভাবে তো কাল অন্য কিছু। এখন তো বসে বসে কল্পনা করার দিন শেষ। তাকে কাজে নামতে হবে। কিন্তু কখন কীভাবে জাহাজ ভাসাবে সাগরে? তা জানতে চাইলে ম্যাথু দিনক্ষণ অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেয়। বলে, ‘তুমি কম বয়সী ছেলেপেলেদের দেখেছ দ্বীপ আবিষ্কারে যেতে? ৩০ থেকে ৪০ – মোক্ষম বয়স দেশ আবিষ্কারের।’
ম্যাথু তা বলতেই পারে। কারণ তার মা-বাবা বা কওমের লোকেরা তো নিজের দেশে ক্যাম্পে বাস করে না! জান্তা সরকার মেরে-কেটে তাদের দেশছাড়াও করেনি!
ছোট রোহিঙ্গার এক ধ্যানেই আজ পাঁচ বছর। ১২ বছর বয়স থেকে শুরু। এখন সে ১৭। দেশ আবিষ্কারে বিভোর ওর মতো কেউ কি ছিল এত ছোটকাল থেকে? সে আলিবাবার মতো সিসিম ফাঁক বা খুলজা সিম সিম বলে ডাকাতের লুটের মালে বড়লোক হতে চায় না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপও না। সে রোহিঙ্গাদের জন্য ছোট্ট একটি দেশ চায়। সাগরে ভাসার মতো একটা শক্তপোক্ত জাহাজের অভাবে তার দীর্ঘদিনের ইচ্ছাটা মাটি হয়ে যাচ্ছে।
ম্যাথু সাগরে মাছ ধরতে গেলে ছোট রোহিঙ্গা একা ঘরে নিজের সঙ্গে কথা বলে। মাথার ওপর কুয়াশার চাঁদোয়া বানিয়ে তিমি মাছ ঘুরে বেড়ায় এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগরে। সে যদি পারত এই রকম মহাসাগর থেকে মহাসাগরে যেতে, ওর নতুন দেশ তালাশের পরিসরটা আরো বড় হতো।
নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছোট রোহিঙ্গা একদিন খেয়াল করে – ঘরে সে একা না, দরজার মুখে একটা টিয়া পাখি ঘাড় কাত করে তার কথা শুনছে। এটা শুভলক্ষণ। রবিনসন ক্রুশোর মতো তার দ্বারেও পাখি। সে খুশিতে লাফিয়ে উঠতে পাখি উড়ে গিয়ে দোলনায় বসে। ছোট রোহিঙ্গা দুয়ারে বসে তার অভিযানের পরিকল্পনা শোনায় পাখিটাকে। দোলনায় দোল খেতে খেতে সেসব কথা শোনে পাখি।
ছোট রোহিঙ্গা তার সমুদ্র অভিযানে কয়েক টিন বিস্কুট নেবে। জিনিসটা অনেকদিন নষ্ট হয় না। তাছাড়া যে-কোনো বিস্কুটই তার খুব প্রিয়। শুধু বিস্কুট খেয়েই দিন কাটাতে পারে সে। জাহাজে আরো নেবে স্কার্ভিরোগ নিরোধক ভিটামিন-সি। তারপর দোলনায় দোল খাওয়া পাখির ওপর বিড়াল হামলা করলে সে বিড়াল তাড়িয়ে পাখিটাকে আগের জায়গায় ফেরানোর কোশিশ করে। দরজার সামনে সামান্য একটু দানা ছিটায়। কলার খোসা ছাড়িয়ে এগিয়ে দেয়। তারপর রবিনসন ক্রুশোর
কিশোর-ভার্সান টেবিল থেকে তুলে এনে এর আষাঢ়ে গল্প পড়ে শোনায় পাখিটাকে।
ক্রুশোদের ঝড়েপড়া জাহাজে মানুষ নাই কিন্তু সব ধরনের খাবার মজুদ। শুধু কি তাই? পোশাক-আশাক, হাতুড়ি-বাটাল। কেবল মাটি কুপিয়ে বীজ বোনার কোদালটা ছিল না বোধ হয়। একটা পরিত্যক্ত জাহাজে দ্বীপে স্যাটেল করার মতো সব আছে। অবিশ^াস্য নয় কি? জাহাজের পালও ক্রুশো পেয়ে যায় হাতের নাগালে।
‘ও হ্যাঁ, পাল নিতে হবে জরুর’, বলে ছোট রোহিঙ্গা বিড়ালটাকে ফের তাড়িয়ে দিয়ে পা ঝুলিয়ে দরজায় বসে।
তাছাড়া নৌ সারণি, অ্যাস্ট্রোল্যাব, কম্পাস বা দিকদর্শন যন্ত্র…
ম্যাথুও সাগর থেকে ফিরে সায় দেয় – নটিক্যাল চার্ট বা নৌ সারণি নাবিকদের জাহাজ চালাতে অতি আবশ্যক। এসব মাপজোকে আরবরা ছিল তুখোড়। তারা এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরের দূরত্ব নির্ণয় করত দিনের হিসাব দিয়ে। তাছাড়া অভিজ্ঞ নাবিক জিহ্বায় পানির স্বাদ চেখেও বলতে পারে স্থলভাগ কতটা দূরে। তারপর ছোট রোহিঙ্গার রান্না করা সাগুর সঙ্গে ভাজা মাছ খেতে খেতে ম্যাথু বলে – ক্রেয়ল ভাষা তোক-পিসিন শেখা হয়ে গেলে ছোট রোহিঙ্গাকে অবশ্যই হিরি মোতু শিখতে হবে। হিরি মোতু শিখতে পারলে পোর্ট মোর্সবিসহ দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চলাচলে অনেক সুবিধা হবে। খুব শিগগির পার্শ্ববর্তী এক দ্বীপে ছোট রোহিঙ্গার পরিচয়পত্র করাতে যাবে ওরা। ওই দ্বীপে ম্যাথুর মামাবাড়ি কি না!
একদিন জেলে সাজিয়ে ছোট রোহিঙ্গাকে নিয়ে সাগরে ভাসে ম্যাথু। কার্যত ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে এই দ্বীপে এসে অবধি ছোট রোহিঙ্গা বন্দিই ছিল। দাঁতে স্থায়ী পানের দাগ পড়ার আগে ঘর থেকে বেরোয়নি মোটে। তোক-পিসিন ভাষায়ও এখন সে সড়গড়। সাগরে নেমে ছোট রোহিঙ্গা মাছ ধরার চেয়ে মুক্তির আনন্দেই উদ্বেল হয় বেশি।
ম্যাথুর মাছ ধরার নৌকাটা আদতে গাছ কেটে বানানো লোকাল ডোঙা, যার সঙ্গে আছে কাঠের দণ্ডে বাঁধা এক ফালি মোটা কাঠ। দূর থেকে মনে হয়, এক জোড়া নৌকা যেন ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে যাচ্ছে। ম্যাথু যখন উবু হয়ে বড়শির সুতো টানে ছোট রোহিঙ্গা তখন নৌকার হাল ধরে। ডোঙার আউটরিগারে উড়ে বসে সামুদ্রিক পাখপাখালি। এরা উড়ে উড়ে ক্লান্ত বা ঝড়ো বাতাসে কাবু। তিরতির ডানা কাঁপে ওদের। উদাস চোখে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে পাখিগুলি। ছোট রোহিঙ্গা ভাবে – তার আজন্মের চেনা সমুদ্র এখান থেকে কত দূর! মাঝখানে আছে সাগর, মহাসাগর। তবু পানিতে পানিতে মেশামেশি, অনায়াস চলাচল। মানুষের চলাচলেই যত বাধা-বিপত্তি।
ম্যাথুর বড়শিতে আজ তেমন মাছ লাগেনি। ওরা অল্প কিছু মাছ নিয়ে সকাল সকাল ফিরে চলে। ঘাটে আসার আগেই নগদ পয়সার বিনিময়ে একটা টুরিস্ট বোটে জ্যান্ত মাছগুলির গতি হয়ে যায়। নৌকা থেকে মাছের ঝাঁকা নেমে গেছে, দুজনের ঝাড়া হাত-পা। ছোট রোহিঙ্গা এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে চায় না। কত দিন পর সাগরের বাতাস আজ গায়ে লাগল! আরো কিছুটা সময় তাদের নৌকা চক্কর খায় সৈকতের কাছাকছি, যেখানে জেলেপল্লির শিশুরা ছোট ছোট ডোঙা নিয়ে পানিতে খেলা করছে। বড়রা বেলাবেলি নৌকা ভাসাচ্ছে সাগরে যাবে বলে। তারা অন্ধকার রাত্রে বিশেষ কায়দায় আলোর টোপ ফেলে মাছ ধরে। ছোট রোহিঙ্গা ভাবে – তার বাবা কি এখনো মাছ ধরতে যায় সাগরে? নৌকার পেছনে হাল ধরে বসা, পিঠ বেঁকা একজন দুঃখী মানুষ।
আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে। যে-কোনো সময় বজ্রবৃষ্টি শুরু হতে পারে। ম্যাথু উল্টো দিকে দাঁড় বায়, নোঙর করে পাশের দ্বীপের একটি অব্যবহৃত ঘাটে। তীরের নারকেল বাগানের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছোট রোহিঙ্গা দ্বীপটা চিনতে পারে। দূর থেকেই দেখতে পায় ক্যাম্পের ধবধবা সেই তারের বেড়া। গেটের সামনের রাস্তা অ্যাসফল্ট, আলকাতরায় মাখামাখি। ওখানে বেশ কিছু ট্রান্সফিল্ড বিহাইকেলের আনাগোনা। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে – অস্ফুট স্বরে বলে ম্যাথু। ক্যাম্প আরো বোঝাই হবে ডিটেনিতে। দুজনে দম আটকানো ধুলা, নুড়ি-পাথরের রাস্তা ছেড়ে একটা চিপাগলিতে ঢোকে। খানিকটা সময় জোরেশোরে চলে বজ্রপতন। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে স্থানীয় শন বা তন্তু ছাওয়া একটা নিচু ছাদের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নেয় দুজন। ঘরের কর্ত্রীর সাজা পান খায়। গালগল্প করে। বজ্রবৃষ্টির পর ঠান্ডা বাতাস গুমোট গরম হটিয়ে দিয়েছে। তারা বগল বাজাতে বাজাতে দ্বীপের কর্দমাক্ত পথ ধরে ঘাটে ফিরে আসে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট রোহিঙ্গার মনে হয় – আকাশ, সমুদ্র, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, ঢেউ কী অপূর্ব সবকিছু! ‘ছোট রোহিঙ্গার ছদ্মবেশ আজ সার্থক’, ম্যাথু হাতে নৌকার বৈঠা তুলে নিতে নিতে বলে।
সত্যি তাকে বিদেশি বলে যে কেউ চিনতে পারে নাই-এ হচ্ছে তাদের আজকের সফরের নিট লাভ।
পাঁচ
একদিন নৌকা নিয়ে দ্বীপের চারপাশ চক্কর দিতে দিতে সমুদ্রের খাঁড়িতে আটকে পড়া ৫০-৬০ বছরের পুরনো একটি ফিশিং বোট ওরা দেখতে পায়। এ বিশালাকার নৌকাটাই হতে পারে তাদের দ্বীপ আবিষ্কারের তরী – ভাবে দুজন। ছোট রোহিঙ্গা সিত্তে বাজারে কিছুদিন স্টিলের ফার্নিচার রং করার কাজ করেছে শিশুশ্রমিক হিসেবে। সে প্রথম নৌকা মেরামতে এগিয়ে যায়। মাছ ধরার ফাঁকে ম্যাথুও এ-কাজে হাত লাগায়। প্রচুর কাজ। টাকাও দরকার দেদার। গাছ কেটে মাস্তুল বানাতে হবে। স্টিয়ারিং, রাডার – এরকম অনেক জিনিস কিনতে হবে। ছোট রোহিঙ্গা মাঝে মাঝে খাঁড়ির পাড়ে উঠে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় জংধরা ভাঙাচোরা নৌকাটার দিকে। আসলেই কি এটি কোনো দিন সাগরে ভাসবে? তার আশা-নিরাশার কথা একমনে শোনে টিয়া পাখি। পাখিটাও সকাল সকাল ছোট রোহিঙ্গার সঙ্গে খাঁড়িতে নামে। ঘরে ফেরে সন্ধ্যা হলে। কোনো কোনো দিন ছোট রোহিঙ্গা একদম খামোশ। পাখিটা তার চারপাশে উড়ে উড়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিলে লাঠি তুলে তাড়িয়ে দেয়। পাখি তাড়ানোর রাতে সে দুঃস্বপ্ন দেখে – জংধরা নৌকাটা ওরা সাগরে ভাসিয়েছে। সামনেই প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপের পাথুরে সৈকতে ধাক্কা লেগে সাধের নাও চুরমার। ঢেউয়ের ওপর ভেসে ওঠে ভাঙা নায়ের কাঠ, রান্নার হাঁড়ি, রঙিন কাপড়, বল, বেলুন ইত্যাদি।
আরেক দিন পাখিটাকে লাঠি দিয়ে তাড়ালেও ম্যাথুর সঙ্গে খোশালাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লে ছোট রোহিঙ্গা স্বপ্ন দেখে – তীরের অনেকখানি চড়ায় একটা সাদা স্পিডবোট নোঙর করা। চকচকে, ফিটফাট। ছোট রোহিঙ্গা বহুৎ খুশি – তার মাজাঘষায় নৌকাটা এমন খুবসুরত ধারণ করেছে। কিন্তু ম্যাথু বলে – না, এক পয়সাঅলা বিদেশির নৌকা এটা। ওরা লম্বা লম্বা ট্যুর করে এসব আইল্যান্ডে। দুজনে কাছের পাহাড় থেকে বোটের দিকে নজর রাখে। ঝরনার পানি আর বিস্বাদ ফলমূল খেয়ে দিন পার করে। বেলা শেষে জল-ডাঙা রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যায়। আকাশে মস্তবড় চাঁদ ওঠে। মরুভূমির বালুকণার মতোই চাঁদের রং –
চোখ-রাঙানো লাল। এই দ্বীপের চাঁদটা এত লাল আর বড় কেন? তারাগুলিও মনে হয় দ্বিগুণ সাইজের! ‘শ-শ’ ম্যাথু ঠোঁটের ওপর তর্জনি তুলে ছোট রোহিঙ্গাকে চুপ থাকতে বলে। কাছেই উঁচু তারের বেড়ার ওপাশে একটা সাদা বাংলো, যেখানে টুরিস্ট পরিবারটা ঠাঁই নিয়েছে। ওরা পাখির জন্য নারকেলের মালায় যে-খাবার রেখেছে, তাতে ভাগ বসায় দুজন। কিন্তু স্পিডবোটের কথা ভোলে না। দেখে বিশাল এক কলার ছড়া মাথার ওপরের মাচায় ঝুলছে। অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে। বাকি সব পাকছে। কলার ছড়াটা নিয়ে সৈকতের মাটি-কাদা-কঙ্কর মাড়িয়ে ওরা বোটে ওঠে। নোঙর খুলে দেয়।
তখনই ইঞ্জিন স্টার্ট দেয় না। ভাটার টানে তীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে ইঞ্জিন চালু করে ম্যাথু।
স্বপ্নটা ভেঙে গেলেও চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছা করে না ছোট রোহিঙ্গার। চোখ বুজে বিছানায় পড়ে থাকে সে নিঃসাড়। আরেকবার ঘুমালে স্বপ্নটা যদি ফিরে আসে! এই রকম স্বপ্ন কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। এমন জীবন্ত আর বাগানের মতো নিখুঁত সাজানো! কখনো কখনো রাতের স্বপ্নে ও আগেবাড়ার দিকনির্দেশনা পায়। ঘুম ভাঙার অল্প পরেই সেটি বাষ্পের মতো মিলিয়ে যায়। কখনো ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো এর টুটাফাটা জুড়ে ম্যাথুকে বললে সে দ্বীপের মানুষের বিশ্বাস ও আচারের আলোকে স্বপ্নটা ব্যাখ্যা করে। ছোট রোহিঙ্গার মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা সমুদ্র বুঝি নতুন দ্বীপের সন্ধান দিতে এগিয়ে আসছে। পানির কলকল ধ্বনি, গাঙচিলের করুণ চিৎকার, সাগরের গর্জন। তাছাড়া বাদবাকি সবই দুঃস্বপ্ন। অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পের শিকল, তালা আর তারের বেড়ার, যেসবের মধ্যে সে তিনটা বছর কাটিয়ে এসেছে।
ছোট রোহিঙ্গার বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকা হয় না। স্বপ্ন তো দূরস্থ। ভোর না হতে ম্যাথুর সাগরে মাছ ধরার সশব্দ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সে হাত-মুখ ধুয়ে টলতে টলতে যায় চুলা ধরাতে। রোজ সাগু, কন্দ, কলা। খাওয়ার পেছনে খরচ করার মতো টাকা কোথায়? ম্যাথুর রোজগারের অর্ধেক যায় ওর বাবার পকেটে, বাকি অর্ধেক টাকায় ভাঙা নৌকার কলকব্জা আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে। ছোট রোহিঙ্গার পরিচয়পত্র করাতেও ঘুষ লাগবে।
অবশেষে ম্যাথুর মামার ফোন আসে। পরিচয়পত্রের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এবার ছোট রোহিঙ্গাকে সশরীরে হাজির হতে হবে। দূরের আইল্যান্ড। ওরা খাবারের পুঁটলি নিয়ে রাত থাকতেই ঘাটে যায়। টিকিট কেটে প্যাসেঞ্জার নৌকায় উঠে বসে। এটা ইঞ্জিনচালিত খোলা নৌকা। ইঞ্জিনের হাতা ধরে আছে চালক। যাত্রীরা পাটাতনে বসে ঢুলছে। তুমুল পানি ছিটিয়ে নৌকা যাচ্ছে দ্রুত। তীরের পাহাড়গুলির পেছন দিক তখনো আবছা অন্ধকার। সাগরের পানিতে রং ধরেছে – নীল সবুজের ওপর বেগুনি, কোথাও সোনালি। পাখিরা ডাকাডাকি করতে করতে খাবারের সন্ধানে ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে পড়েছে। পানি ছুঁয়ে উড়ছে গাঙচিল, বালিহাঁস। আচমকা বিশাল ডানা মেলে একটা দুধসাদা অ্যালবাট্রস ঝড় তুলে দূর দিয়ে উড়ে গেল। ছোট রোহিঙ্গা তারিফ করে বড় পাখিটার।
সঙ্গে ইঞ্জিনচালিত পরিপাটি এই নৌকারও। তবে যুগ যুগ ধরে দ্বীপ আবিষ্কারে যে-ধরনের নৌকা ব্যবহার হয়ে আসছে, অভিযানের জন্য তার পছন্দ তেমন ইঞ্জিনহীন পালতোলা নাও।
তাহলে তো তাদের জার্নিটা অতীতের দিকে ঘুরিয়ে নিতে হবে – না-হেসে বলে ম্যাথু। নৌকার যাত্রী হয়ে আজ তার অবসর মিলেছে, তাই খইয়ের মতো কথা ফুটছে চোখে-মুখে। সেটা ছিল অন্যরকম সময় – ম্যাথু বলে।
ইঞ্জিনহীন পালতোলা নৌকার সময়কে তুমি আজকের তুলনায় ভালো বা মন্দ কিছুই বলতে পারবে না। তখন দ্বীপ আবিষ্কারের নেশায় সাগর তোলপাড়। সাগর-উপসাগরে চষে বেড়াচ্ছে তিমি শিকারির বড় বড় জাহাজ।
ইউরোপীয় বণিকেরা ঝাঁকের কইয়ের মতো আসতে শুরু করেছে। বন্দরে বন্দরে তাদের নোঙর করা গাঢ় গাত্রবর্ণের ক্রীতদাস-ভর্তি ব্ল্যাকবার্ডিংয়ের জাহাজ। ম্যাথুর কওমের কিছু লোক এভাবে হারিয়ে যায়। তাদের কুইন্সল্যান্ড ও স্যামোয়ার আখক্ষেতে, তুলাক্ষেতে খাটাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল – জোরপূর্বক, কখনো-বা প্রতারণা করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে।
ছোট রোহিঙ্গা তাদের অতীত জার্নি নিয়ে ভাবছিল। তখনই সাগরতীরে কয়েকটি ক্যাঙ্গারু চরতে দেখে সে। বনের আলোছায়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাচ্চা নিয়ে খেলছে। দূর থেকে দেখে ছোট রোহিঙ্গা ভেবেছিল হরিণ। ‘না, ক্যাঙ্গারু’, বলে ম্যাথু, ‘যার ছবি তুমি কুকের আবিষ্কৃত দেশের পতাকায় দেখেছ।’ ম্যাথুর নিজের দেশেও ক্যাঙ্গারু আছে, জানে সে। কিন্তু ছোট রোহিঙ্গার জন্য খবরটা নতুন। সে ম্যাথুকে হুঁশিয়ার করে বলে – কুকের আবিষ্কার করা দেশের দিকে কোনোভাবে যাওয়া চলবে না। ওদেশের লোকদের থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই সে নিরাপদ।
‘পরিচয়পত্র হাতে পেলে অবশ্য সে ভয় নেই।’ ছোট রোহিঙ্গাকে অভয় দেয় ম্যাথু।
দিনের আলো নেভার আগে মামাবাড়ির উঠানে পুঁটলি হাতে দাঁড়ায় দুজন। তারপর মামার পাতা-ছাওয়া ঘরের নিচু দরজা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকে। আধুনিক আসবাবপত্রে ঠাসা কামরায় দিনের বেলায় অনেকগুলি মশারি টাঙানো। চাল থেকে দুটি টিমটিমে বাতি ঝুলছে। ঘরের কোণের দিকের একটি ঝকঝকে মশারি দেখিয়ে মামা বলেন, যতদিন খুশি তারা এখানে থাকতে পারে। এর জবাবে দুদিনের কাজ একদিনে সারতে মামাকে তাড়া দেয়
ম্যাথু।
পরদিন ছোট রোহিঙ্গাকে একটি টুরিস্ট স্পটে রেখে নৌকার কিছু জরুরি মালসামান কিনতে যায় ম্যাথু। ছোট রোহিঙ্গা একঠেরে হয়ে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকটি বাচ্চা তার সামনে দিয়ে দৌড়ে যায়। ছোট রোহিঙ্গা পেছন ফিরে দেখে সেই বাচ্চাদের একজন ব্রেক ডান্স করছে, আমেরিকান এক টুরিস্ট বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ফটো তুলছে ওর। ছোট রোহিঙ্গা কিসের এক অমোঘ টানে দলটাকে অনুসরণ করে।
গাছের ছাল-তন্তু থেকে তৈরি কি চমৎকার পোশাক! স্থানীয় কিছু নারী-পুরুষ সেই পোশাকে একটা খোলা জায়গায় জড়ো হয়েছে। টুরিস্টদের দলটা পৌঁছা মাত্র তারা দুলে দুলে নৃত্য শুরু করে, আরেক দল জাদু দেখায়। খানিকটা দূরে সুপারির খোলে পাথর রেখে পানি গরম করে এক মা। তারপর সেই পানিতে তার বাচ্চাকে নাওয়ায়। কাছে লাঞ্চ সাজানো হচ্ছে। ডাবের জল, নারকেলের মালায় নারকেল দিয়ে রান্না সামুদ্রিক মাছ। ছোট রোহিঙ্গার স্বপ্নে দেখা সেই টুরিস্ট পরিবারের কথা মনে পড়ে, যাদের স্পিডবোট ঘাটে বাঁধা ছিল, যে বোট চুরি করে ওরা রওনা দিয়েছিল গহিন সাগরে। সে জোরে জোরে চৌরাস্তার দিকে হাঁটে। ম্যাথুকে জলদি স্বপ্নটার কথা বলতে হবে। নাকি সে একাই যাবে দেখতে যে, সেই সাদা স্পিডবোট সৈকতে নোঙর করা আছে কি না?
পরদিন পরিচয়পত্র হাতে একটি প্যাসেঞ্জার নৌকায় করে দ্বীপে ফিরে চলে দুজন। স্পিডবোটের স্বপ্নটা চুরি হয়ে যাওয়ায় ছোট রোহিঙ্গা খুব মনমরা। গতকাল নারকেল দেওয়া ফিশ কারি খেয়ে টুরিস্টের দলটা সাদা স্পিডবোট হাঁকিয়ে তার নাকের ডগা দিয়ে চলে যায়। নৌকাটা যেন নীলের বুকে সাদা বালিহাঁস, ম্যাথু আর ছোট রোহিঙ্গা একদিন স্বপ্নে যা সাগরে ভাসিয়েছিল। এ দুনিয়ায় টাকা আর ক্ষমতা থাকলে সবই সম্ভব। স্বপ্ন ছিনতাই তো আরো সহজ। ‘আমার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই নাই’, গলায় বিষাদ ঢেলে বলে ছোট রোহিঙ্গা। ‘ইচ্ছাটাই আসল’, সংক্ষিপ্ত জবাব আসে ম্যাথুর কাছ থেকে। জারিক্যান থেকে ইঞ্জিনে তেল ঢালার সময় নৌকাটা থামে। তখন দুলুনি কমে এলে নৌকার পাটাতনে উঠে দাঁড়ায় দুজন। মাঝদরিয়ায় এখন তাদের নাও। ছোট রোহিঙ্গা বলে, ‘সমুদ্রটা কী বিশাল আর ফাঁকা! এর কোথাও কি অনাবিষ্কৃত দ্বীপ থাকবে না?’
‘আছে নিশ্চয়।’ উদাস গলায় বলে ম্যাথু, ‘বড় দ্বীপের লেজ আঁকড়ে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ – মা মাছের পেছনে ঝাঁক-বাঁধা মাছের পোনা যেমন। বা এমন কোনো দ্বীপ, যেখানে ঘন ঘন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে মানুষের বসবাস নেই।’
ছোট রোহিঙ্গা দুশ্চিন্তায় পড়ে। তাদের যাত্রার দিন ঘনিয়ে আসছে। এখনো যদি এত সংশয় থাকে! দিগন্তহীন নীলের দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে অভয় দেয় – সামনে যার নিঃসীম সমুদ্র, সে আশা হারাবে কেন? রাতে বাড়ি ফিরে নেট থেকে ম্যাপ ডাউনলোড করে ম্যাথু। সে তাদের সামুদ্রিক যাত্রাপথের নিশানা ঠিক করছে।
আর সামনে যে দ্বীপ পড়ছে, তার নাম পড়ে যাচ্ছে সরবে – বোগেনভিল, সলোমন, ভানুয়াতু, নিউ ক্যালেডোনিয়া …
‘এ সবগুলিই তো আবিষ্কৃত দ্বীপ!’ তার কথার মাঝখানে বাগড়া দেয় ছোট রোহিঙ্গা।
কথায় বাধা পেয়ে ম্যাথু মাথা নাড়ে। ফের চালু করে তার কথার মেশিন। বোগেনভিল আবিষ্কার করেন ফরাসি সাহেব লুইস অ্যান্টনি ডি বোগেনভিল, ১৭৬৮ সালে। আর নিজের নামটা সেঁটে দেন দ্বীপটার গায়ে। বলে ব্যঙ্গ হাসি হাসে ম্যাথু। ১৫৬৮ সালে স্পেনীয় নাবিক আলভ্যারো ডি মেন্ডানা সলোমন দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করেন। তিনি দ্বীপের গায়ে নিজের নাম না সেঁটে নবী সলোমনের নামে রাখেন দ্বীপের নাম। ম্যাথু মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আজব একটি গল্প শোনায় – রাজা সলোমন নাকি জেরুজালেম মসজিদের সব সোনাদানা এখান থেকে নিয়েছিলেন। তারপর যাওয়ার কালে তার বোতলবন্দি দৈত্যটাকে ছেড়ে দিয়ে যান সলোমন সাগরে।
ভয়ে কেঁপে ওঠে ছোট রোহিঙ্গা, ‘আমরা কি সলোমন সাগরের ওপর দিয়ে নৌকা চালিয়ে যাবো?’
‘হু, ও কারো ক্ষতি করে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের কয়েকটা সাবমেরিন ডুবাইছিল শুধু।’ বলে ম্যাথু মোবাইল ফোনে ঘষা দেয়। বলে – তারপর তাদের পথে পড়বে দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু। এর আবিষ্কারক কে এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই ম্যাথুর। মোবাইল স্ক্রিনে আঙুলের আরেক ঘষায় ও চলে যায় টিকোপিয়া আইল্যান্ড। এবার তাকে বাধা দিয়ে ছোট রোহিঙ্গা একটি নাম প্রস্তাব করে – টোঙ্গা দ্বীপ।
‘কিন্তু তুমি কি টোঙ্গা দ্বীপে তিমির সঙ্গে সাঁতার কাটতে যাবে?’ ম্যাথু তাকে খোঁচা দিলেও, তিমি নিয়ে ইউটিউবে দেখা একটা মুভি মনে মনে ইয়াদ করে সে। তিমিগুলি ছোট বাচ্চা নিয়ে কাঁটাযুক্ত ডানা নেড়ে নেড়ে গহিন সাগরে সাঁতার কাটে। যখন-তখন পানি থেকে মাথা তুলে চিত হয়ে উল্টে পড়ে মহাখুশিতে।
তিমি নিয়ে ভাবতে ভাবতে ম্যাথু এবার কোরাল সাগরে পৌঁছে যায়। দ্বীপের নাম বলে নিউ ক্যালেডোনিয়া। আবিষ্কারক জেমস কুক।
কাছে যেন বাঘ ডেকেছে, ছোট রোহিঙ্গা এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। তাজ্জব হয়ে মোবাইল ফোন চটজলদি বন্ধ করে দেয় ম্যাথু।
বিছানায় শুয়ে দুজন এপাশ-ওপাশ করে। তাদের আসন্ন নৌ-জার্নির ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায় লাটিমের মতো। ম্যাথু জিজ্ঞেস করে – তাদের নৌকার কী নাম হতে পারে? যেন আগে থেকে ছোট রোহিঙ্গা নামখানা ঠিক করে রেখেছিল, সে বলে – ওডিসি। অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্পে এক বিদেশি সাংবাদিকের মুখে শব্দটা শুনেছিল সে।
ছোট রোহিঙ্গার সিত্তে ক্যাম্প থেকে গোটা জার্নির বৃত্তান্ত শুনে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন এই বিদেশি শব্দটা। এর মানে কী জিজ্ঞাস করলে অন্ধকারে মাথা নাড়ে ম্যাথু। বলে, জানে না সে। তবে শিগগির গুগল সার্চ করে এর মানে বের করবে।
সমুদ্র তো নিদারুণ খেয়ালি! কখন কী করবে এর আগামাথা নেই। পথে যদি ঝড় ওঠে বা নৌকা ডোবে? ম্যাথু অন্ধকারে থমথমে গলায় বলে। হুম, ছোট রোহিঙ্গা তা জানে। তার এই ছোট্ট জীবনে সাগরের ভয়াল রূপ সে কম দেখে নাই। সবচেয়ে খারাপ চেহারা দেখেছে মানুষের।
নৌকা হারিয়ে তারা যে-দ্বীপে উঠবে, কিছুদিন ওখানে বিশ্রাম নেবে – কথাটা ছোট রোহিঙ্গার কাছে প্রস্তাবাকারে পেশ করে ম্যাথু। হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলে জন খাটবে ক্ষেতে-খামারে। সিজনের মিষ্টি আলু তোলা, কোকো ফার্মে দিনচুক্তি মজুরি দেওয়া – যেখানে যখন যা। কখনো শহরের রাস্তাঘাট বা দালানকোঠার নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে। পুরোটাই কায়িক শ্রম। যতদিন না আরেকটা নৌকা কেনার টাকা জমে ওদের।
ছোট রোহিঙ্গা নৌকাডুবির কথা ভাবতে পারে না। সে কল্পনায় ওডিসিকে দ্রুতগামী সামুদ্রিক পাখি ফ্রিগেটের মতো ছুটতে দেখে সাগরে। তাদের নৌকার দাঁড়ে উড়ে এসে বসে অচিন পাখি। অদ্ভুত তাদের আচরণ আর ভঙ্গি। ওরা দানা ছড়িয়ে খেতে দেয় পাখিদের।
টিয়া পাখিটাকে কি সঙ্গে নেবে ছোট রোহিঙ্গা? ম্যাথু বলে – তাহলে তার বিড়াল? বিষয়টা তাদের অমীমাংসিতই রয়ে যায়।
ম্যাথু বলে – নৌযাত্রার আগে বাবাকে একটা চিরকুট লিখে যাবে। বলবে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছে সে। ছোট রোহিঙ্গার অনেকদিন চিঠিপত্র লেখা হয় না। এবার সে বাবাকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখবে। চিঠির শেষে থাকবে তাদের ওডিসি নিয়ে সমুদ্র যাত্রার খবর।
ছয়
চিঠিটা কত দিন পর, কত পথ ঘুরে পৌঁছলো এখানে! খামের ওপর সিত্তে ক্যাম্পের ঠিকানা। লিখেছে তার ভাই বাবার কাছে। বাবা নেই আজ তিন বছর। ওরা সিত্তে ক্যাম্প ছেড়েছে বাবা খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন নাফ নদী পেরিয়ে চলে আসে পাশের দেশে। দেশহীন মানুষ। ভিনদেশে আশ্রয়প্রার্থী। এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্প। সম্প্রতি ওরা উঠেছে নতুন জাগা এক ধুধু চরে।
হাতের কোদাল ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে রেখে ছোট রোহিঙ্গার ভাই জাভেদ মিয়া কেওড়া গাছের ঝিরঝিরে ছায়ায় দাঁড়ায়। দ্বীপের নবজাতক গাছ-গাছালি। বিরল সব বৃক্ষের পাতা। কপালে তেরছা হয়ে রোদ পড়ে জাভেদ মিয়ার। এ মরুময় চরে চৈতের
ঠা-ঠা রোদ্দুরে জাহাজ থেকে নামছে দলে দলে শরণার্থী। আজ নয়া চরের ক্যাম্প মনে হয় টইটম্বুর হবে। এ নিয়ে খোশ, না-খোশ কোনোটাই নয় জাভেদ মিয়া। আজকের জাহাজে আসা পয়লা কাফেলাতেই ছিল পরিচিত লোকটা, যে তার হাতে ভাইয়ের চিঠি গছিয়ে ফের কাফেলায় মিশে গেছে। সেই কাফেলাও পৌঁছে গেছে ক্যাম্পের চেকপোস্টে। অথচ চিঠি-ধরা হাতের কাঁপুনি এখনো থামছে না জাভেদ মিয়ার।
যেন চিঠি না, মৃত ভাইয়ের হাত ধরে আছে সে। চার বছর আগে অফশোর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে সর্বশেষ পত্র আসে ভাইজানের। তারপর নিখোঁজ যে নিখোঁজই। ছেলের জন্য শোক করতে করতে জান্তার গুলিতে মরে গেলেন বাবা। কী অদ্ভুত! তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পর পত্র এলো ছেলের!
জাভেদ মিয়া মুঠো আলগা করে চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরে। এবার চিঠির শেষ থেকে পড়া শুরু করে সে। ভাইয়ের নামের নিচে সন-তারিখ। পাক্কা দু-বছর তিন মাস আগের লেখা চিঠি এটি। তারপরই একটা জেলে ডিঙি নিয়ে ভাইজান বেরিয়েছে সাগর-মহাসাগরে দ্বীপ আবিষ্কারে। এখন তার কোথায় ভোর, কোথায় রাত, কোথা থেকে সূর্য ওঠে, কোথায় অস্ত যায়! দিগন্তহীন সাগরের বুকে দৃষ্টি মেলে চলছে তো চলছে …
জাভেদ মিয়ার মাথা ঘুরে ওঠে। সবকিছু গুলিয়ে যায়। সে নতুন চরে মাটি কুপিয়ে ধানিজমি তৈরি করবে কি, কোমরের ট্যাঁকে চিঠি গুঁজে যখন ক্যাম্পের দিকে রওনা দেয়, তখন কোদালের ভার বহন করাও তার দুঃসাধ্য মনে হয়।
ঘরে ঢুকে জাভেদ মিয়া বেতাল। মাকে কী বলবে। নাকি জিরাবে একটুখানি। নিঃশব্দে সে চিঠিটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে। কি না কীসের কাগজ – মা চিঠিটা ভাতের খালি হাঁড়িতে রেখে ছেলের জন্য পানি আনতে যায়।
জাভেদ মিয়া জানে মা নিরক্ষর। সে খানিকটা সুস্থির হয়ে ভাতের হাঁড়ি থেকে তুলে চিঠি পড়তে শুরু করে। মা একবার কান্দে, একবার হাসে – ছেলে তার বেঁচে আছে! আর কত বড় তালেবর! নিপীড়িত কওমের লোকদের নতুন দেশে নিতে জাহাজ পাঠাবে। তোমরা সবাই কই গো, শোননি গো …
মা হইহই করে ঘর থেকে বেরোতে চাইলে জাভেদ মিয়া বাধা দেয়। ছেলে জাহাজ নিয়ে আসতেছে শুনলে, মা-ছাও দুজনকেই মানুষ পাগল ভাববে।
তাই ঘটে। সেদিন সন্ধ্যা নামার আগেই ক্যাম্পের বাচ্চার পাল মায়ের পিছে লেগে যায়। রাতে ঢিল পড়ে সিঁদুররঙা টিনের চালে। পর্দাহীন কাচের জানালায়।
মা-ছেলে ঘরের দরজা লাগিয়ে যুক্তি করে। ধানিজমি তৈরির কাজ ক্ষান্ত। কৃষক না, জাভেদ মিয়া এখন জেলে হবে। ছেলের হাতে জাল, মায়ের হাতে ডুলা। রোজ কাকভোরে ওরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাবে। সাগরতীর ঢুঁড়ে বেড়াবে সকাল থেকে সন্ধ্যা। যতদিন না ছেলের জাহাজ ঘাটে নোঙর করে।
এভাবে তাদের দিন যায়। ছেলে সাগরে জাল ফেলে না। মায়ের ডুলাও শূন্য থাকে। সাগরের রং বদলায়, আকাশেরও বদলায়। ঋতুচক্র ঘুরে আসে। মা ও ছেলে সাগরের দিকে এক ঠায় চেয়ে থাকে।
তারা জানে, দেশ আবিষ্কার চাট্টিখানি কথা নয়। তার জন্য বছরের পর বছর গোজার হয়ে যেতে পারে। আবার অলৌকিকভাবে চোখের পলকেও তা সম্পন্ন হতে পারে। তাই মা ও ছেলের চোখের পলক ফেলতেও ভয়। যদি উদ্ধারকারী জাহাজটা তাদের না দেখে ফিরে যায়! সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সবাই যখন নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, তখন মা ও ছেলে ছোটে সাগরের দিকে। কেউ তাদের রুখতে গেলে মা বলে – ছেলে জন্মের পর থেকে কখনো মিথ্যা বলে নাই। সে লিখেছে – দেশ আবিষ্কারে গেছে। তাদের নিতে ছেলের উদ্ধারকারী জাহাজ অবশ্যই আসবে।