বইয়ের নামঃ পদ্মজা
লেখকঃ ইলমা বেহরোজ
প্রকাশকঃ অন্যধারা
প্রথম প্রকাশঃ একুশে বইমেলা- ২০২৪
একাদশ সংস্করণঃ একুশে বইমেলা- ২০২৪
মুদ্রিত মূল্যঃ ৮০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪১৬
গ্রন্থের প্রকৃতিঃ উপন্যাস
প্রচ্ছদঃ ফাইজা ইসলাম
১
রকমারি ডট কম থেকে প্রতিবছরই গাঁটের পয়সা খরচা করে একুশে বইমেলার আলোচিত বইগুলো পড়ার জন্য সংগ্রহ করি। এবারো সেরকম কিছু বই কেনার অভিপ্রায়ে তাদের প্ল্যাটফর্মে ঢুঁ মারতে গেলে বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে থাকা ‘পদ্মজা’ উপন্যাসটা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জাগায় এবং পড়ার জন্য কিনে ফেলি।
বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার কোন এক প্রত্যন্ত এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নব্বইয়ের দশক থেকে পরবর্তী দু’দশক সময়কাল উপন্যাসের মোট ৪১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী শেকড়ে-বাকলে বিবৃত হয়েছে। দু’এক জায়গায় সময়কালের উল্লেখ এবং বিভিন্ন চরিত্রের মুখে ব্যবহৃত ভাষা থেকে সেরকমই মনেহলো। সেই সমাজে কমবেশি সবাই ধর্মপ্রাণ মুসলিম, তারা প্রবলভাবে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তারা ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে যেমন অভ্যস্ত, তেমনি খুনোখুনিতেও সমানভাবে পারদর্শী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে সেই খুনোখুনির আয়োজন। রিরংসা- হিংসা-জিঘাংশা-হত্যা-ষড়যন্ত্র-রিপুর তাড়না এই সমাজে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। উপন্যাসের পাতায় পাতায় বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ এবং ঘটনার বিবরণ পড়ে মনেহলো সন্তান-পিতা-মাতা-স্বামি-স্ত্রী এসব সম্পর্কের মধ্যে স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ, সম্মান, প্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়গুলো এই সমাজে প্রবলভাবে অনুপস্থিত। তারা একে অপরের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন, তারা একে অপরকে ঘৃণা করে। এই সমাজে বাবা মেয়েকে ঘৃণা করে, মা সন্তানের প্রতি বিরূপ, স্বামী তার স্ত্রীর মর্যাদার প্রতি উদাসীন, সবকিছু মিলে আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো কঠিন একটা অবস্থা! সেই সমাজে ন্যায় নাই, সামাজিক সুবিচার নাই, আইনের বাতাবরণ নাই। এটা আসলে বাংলাদেশের কোন সমাজব্যবস্থা না, এটা সম্ভবত জি- বাংলার সমাজ। বালাজী টেলিফিল্মসের একতা কাপুরের পার্ভার্টেড কলমে (তিনি যুব সমাজকে কলুষিত করেছেন বলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে, বিহারে বেগুরসরাই আদালতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়) ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সোপ অপেরায় আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো যেমন খেলো হয়ে ধরা দেয়, এই উপন্যাসের পাতায় যেন তার খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। বিশেষকরে শেষের দিকের ২৫/৩০ পৃষ্ঠাজুড়ে এটা খুবই প্রকট।
উপন্যাস পড়ে মনেহয়েছে মেধার কি করুণ অপচয়! লেখিকার লেখার হাত বেশ ঝরঝরে কিন্তু এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও ঘটনার বিস্তার সত্যিই বিরক্তিকর। তিনি হয়তো অনেকদূর যাবেন তবে তাকে প্রচুর পড়তে হবে, ভালো লেখার স্বার্থেই। বইটা কিনতে গিয়ে ৮০০/- গচ্চা গেছে তাতে কিছু মনেকরছি না কিন্তু আমার জীবন থেকে যে মূল্যবান সময়টা ভুষিমাল পড়ার জন্য ব্যয় করলাম সেজন্য আফসোস হচ্ছে।
নিব্বা-নিব্বি প্রেমনির্ভর এই উপন্যাসকে কোন জনরায় ফেলবো সেটা নিয়ে আমার খানিকটা দ্বিধা আছে, ‘পদ্মজা’ হতে পারে হালাল প্রেমের উপন্যাস কারণ কাশেম বিন আবু বকরের উপন্যাসের মতো এই উপন্যাসের ধর্মীয় আদব- লেহাজসম্পন্ন বালক-বালিকারা সহীহ ত্বরিকায় শরীয়তসম্মত ভাবে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ফেসবুকের গলি-ঘুপচিতে অনেকে আবার একে থ্রিলার ঘরানায় ফেলতে চেয়েছেন দেখলাম। যারা অল্পে পুলকিত হন তাদের ক্ষেত্রে ‘পদ্মজা’ থ্রিলার বলে মনেহতে পারে, সেক্ষেত্রে ‘পদ্মজা’ হালাল থ্রিলার জনরার হতে পারে।
২
উপন্যাসের প্রচ্ছদ ভালো লাগেনি। বিষয়বস্তুর সাথে তেমন একটা মিল খুঁজে পাইনি। ইশকুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর বাচ্চাদের দিয়ে আঁকানো ইলাস্ট্রেশন, যেগুলো বিভিন্ন পৃষ্ঠায় ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো নিয়ে বলার কিছু নেই। বাচ্চাদের কাজ বাচ্চাদের মতোই হবে, দোয়া করি তাদের মেধার বিকাশ ঘটুক। প্রতি পৃষ্ঠায় সাদা কাগজের উপরে ঘিয়ে রঙের প্রলেপ দিয়ে তাতে আরব্য রজনী বা ঠাকুর মা’র ঝুলি বইয়ের পৃষ্ঠার মতো যে অলঙ্করণ, তাতে লেখিকা কিংবা প্রকাশকের আর্থিকভাবে লাভ হলেও পাঠক হিসেবে আমার বিরক্তির কারণ হয়েছে। কারণ এরকম অলংকরণের জন্য আমার পড়তে যেমন সমস্যা হয়েছে তেমনি কালি বাবদ বাড়তি খরচাটা তো আমাকেই বহন করতে হয়েছে।
৩
২০১২ সালের কথা। তখন যশোর সেনানিবাসে চাকুরি করি। শীতকালীন মহড়ায় রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, শালবরাত এলাকার বিশাল এক জঙ্গলে কিছুদিনের জন্য ঘাঁটি গাড়তে হয়েছিল। সেখানে একজন ডিশের ব্যবসায়ী বলেছিলেন, কোন ডিশ ব্যবসায়ী যদি জি-বাংলা চ্যানেলের সিরিয়াল দেখাতে সক্ষম না হয় তাহলে তার ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলবে। সেখানে একটা দর্শকশ্রেণী যেমন জি-বাংলার পারিবারিক কলহ- ষড়যন্ত্র-হিংসা-দ্বেষ-মারামারি নির্ভর সিরিয়াল দেখতে মরিয়া, তেমনি নিব্বা-নিব্বি অথবা হালাল প্রেমের সহজপাঠ ‘পদ্মজা’ উপন্যাসটাও অনেকের ভাল লাগতেই পারে।
‘পদ্মজা’ উপন্যাস পাঠ করে এর সাহিত্যমূল্যের চেয়েও যে বিষয়টা আমাকে বেশি চমৎকৃত করেছে সেটা হলো এর মার্কেটিং কৌশল। দূর্দান্ত মার্কেটিং কৌশল দিয়ে কি করে বস্তাপচা জিনিসকে মানুষের সামনে উপাদেয় হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এই উপন্যাস। বিবিএ/এমবিএ প্রোগ্রামে মার্কেটিং কৌশলের উদাহরণ হতে পারে এই উপন্যাস। আমার কেন জানিনা এই উপন্যাসের মার্কেটিং কৌশল আলমের ১ নাম্বার পঁচা সাবান বা এরোমেটিক কসমেটিকস লিমিটেড-এর হালাল সাবানের বিজ্ঞাপনের কথা মনে করিয়ে দিল। রকমারি ডট কম-কে ধন্যবাদ এই নেক্সাসে প্রবেশ করে আমাদের মতো পাঠকদের প্রতারিত করার জন্য। রকমারিতে কবি তসলিমা নাসরিনের কাব্যগ্রন্থ খুঁজে পাইনি কিন্তু এরকম ভুষিমাল ঠিকই বেস্ট সেলারের তালিকায় পেয়েছি। তাদেরকে ধন্যবাদ।
আমি কোন রেটিং দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত।
৪
এই উপন্যাসের ভালো দিক তাহলে কি? ভালো দিক কি আসলেই নেই! অবশ্যই আছে। ‘পদ্মজা’ উপন্যাসের বাঁধাই চমৎকার এবং এর ঝকঝকে প্রিন্ট আসলেই প্রশংসার দাবী রাখে।
সবাই ভালো থাকবেন। হ্যাপি রিডিং।
শুভ কামনা নিরন্তর।
সুমন সুবহান।
মুল পোস্ট https://www.facebook.com/share/p/Ei8rMJCFs1c2euxG/?mibextid=oFDknk