আঞ্জুমান রোজী
‘মানুষ’ শব্দটার মধ্যে আছে আত্মসচেতনতা, বিবেকবোধ সম্পন্ন হওয়া, নিজেকে জানার ও বোঝার গভীরতা, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং জ্ঞানগরিমায় নিজেকে বিকশিত করা। এসমস্ত বৈশিষ্ট্য সহযোগে স্বাধীন সত্তা নিয়ে গড়ে উঠে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এজন্য আমরা কথায় কথায় বলি, ‘মানুষ হ’। মানুষ হয়ে গড়ে উঠার বিষয়টি নারীপুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় মানুষ হওয়ার কারিগরি শুধু পুরুষের বেলায় প্রয়োগ হয়। সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে পুরুষকেই শুধু মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার সবরকম সুযোগ-সুবিধার সাথে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। কিন্তু নারীর বেলায় নারী শুধু-ই নারী। কারণ নারীকে চারদেয়ালের মাঝে সামাজিক প্রথা এবং ধর্মীয় অনুশাসনে আটপৌরে জীবনযাপন করতে হয়। নারী অনেকটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়েই একরকম বন্দী জীবন পার করে দেয় যেখানে নারীর কোনো স্বাধীনতাই থাকে না। যেখানে নারীর স্বাধীনতা থাকে না সেখানে মনুষ্যত্বের বিকাশ না ঘটলে মানুষ হওয়াও সম্ভব নয়।
তারপরও কিছু নারী কঠিন প্রচেষ্টায় সামাজিক প্রথা ভেঙে মানুষ সত্তা নিয়ে গড়ে উঠছে, ভেঙ্গে দিচ্ছে সকল বাধার প্রাচীর। এদের সংখ্যা খুবই নগন্য। অধিকাংশ নারীই বেড়াজালের মধ্যে থাকতে ভালোবাসেন। বেড়াজালের মধ্যে থেকেই অনেকে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা করেন। আবার অনেকে স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে লেখালেখির কাজও করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এদের পরনির্ভরশীলতা কমে না, যা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার পথে পরিপন্থী।
যখন একজন নারী ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে না-পারে তখন সেই নারী যতবড় লেখকই হোক না কেন তার কোনো লেখা ততক্ষণ পর্যন্ত আকর্ষণ করবে না যতক্ষন পর্যন্ত তার ব্যক্তিত্বে দৃঢ় প্রত্যয়ী ভাব না ফুটে ওঠে। ঠিক সেভাবে একজন পুরুষ লেখকও যখন ‘মানুষ’ না হয়ে পুরুষ হয়ে থাকেন অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বেশি পোষণ করেন তখন তারও গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে থাকে না। মূলকথা মানুষ সত্তায় বিকশিত না হলে নারীপুরুষ কারোরই সৃষ্টিশীল কাজের গুরুত্ব থাকে না এবং সেখানে নারীপুরুষ বলে কোনো চিহ্নিতকরণ করা হবে না।
প্রাকৃতিক নিয়মে আমি একজন নারী বটে, ঠিক যেভাবে একজন পুরুষের জন্ম। ভেদাভেদটা শুধু শরীরবৃত্তীয়। কিন্তু মননের জায়গায় বা সৃষ্টিশীল জায়গায় নারীপুরুষের কোনো পার্থক্য নেই। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই পার্থক্য অক্ষুণ্ণ রেখে নারীর সৃষ্টিশীল কাজ নারীর আদলেই মূল্যায়ন করে। কিম্বা অনেকসময় গুরুত্বই দিতে চায় না। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তাই সকল ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র পুরুষই, সেহেতু নারীর লেখার মূল্যায়নও হয় অনেকটা হেয় করে। আবার অনেক নারী লেখক পুরুষের এই মানসিকতা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় পুরুষের উপর নির্ভরশীলতার কারণে । অথচ সৃষ্টিশীল মননশীল জায়গায় নারীপুরুষ সব একাকার হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একজন নারী যখন পূর্ণাঙ্গ ‘মানুষ’ হওয়ার অর্থাৎ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অভিপ্রায় রাখেন না তখন তার সৃষ্টিশীল মননশীল কোনো লেখাও স্বতঃস্ফূর্ত পাঠকপ্রিয়তা পায় না। কারণ তার লেখনীতে অধিকাংশ সময় চারদেয়ালের মাঝের ভাবমূর্তিটা ফুটে উঠে বেশি। এই বিষয়টার কারণেও পুরুষের দৃষ্টিতে নারীর লেখা নেতিবাচক অর্থে মূল্যায়ন হয় বলে নারীও একক সত্তায় জেগে উঠতে পারে না। অথচ সৃষ্টিশীল মননশীল কাজের মৌলিক উপাদানই হলো উন্মুক্ততা, দিগন্ত ছোঁয়া মুক্তচিন্তা এবং সব বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে নতুনত্বের সন্ধানে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া যা অনেক নারী লেখকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি এমন নারী লেখক খুঁজে বেড়াই, যার ভেতর ‘মানুষ’ হয়ে বেঁচে থাকার পাশাপাশি মাথা উঁচু করে চলার প্রবণতা প্রবল। আমি তাঁদের কাছেই যাই এবং তাদেরকেই কাছে টানি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন নারী লেখক খুঁজে পাওয়া ভার। একে তো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে লেখালেখির ক্ষেত্রে নারীরা সুযোগ পেয়ে থাকে কম। এক্ষেত্রে নারীদের সবসময় মননের চর্চা করে নিজের ভেতরের শক্তিকে গড়ে তুলতে হবে। তা না-হলে নারী তার অস্তিত্ব সংকটে ভুগতেই থাকবে। যার ফলে ঠিক সেইভাবে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নারীর পক্ষে করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
অনেক নারী লেখক ‘নারীবাদ’ বিষয়টাকে উপেক্ষা করেন। বলেন, এটি একটি ক্লিশে বিষয়। আরো বলেন, নারী নারীর মতো থাকবে, পুরুষ পুরুষের মতো থাকবে। নারীপুরুষে এতো সমান সমানের কি আছে? প্রাকৃতিকভাবে নারী একটা আলাদা সত্তা, তাকে তারমতো করেই থাকা উচিৎ; এমন মানসিকতা নিয়ে অনেক বিখ্যাত নারী লেখক আছেন। তাদের অনেকেই পারিবারিক পরিবেশে পুরুষের আনুকূল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন আদর সোহাগ , এমনকি কেউ কেউ প্রচুর স্বাধীনতাও পেয়েছেন, সেই মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা সাহিত্য রচনা করেছেন বা করে যাচ্ছেন। যার কারণে ‘নারীবাদ’ বিষয়টি তাদের মাথায় আসেনি। নারী জন্মেই যুদ্ধ করে এমন পরিবেশ এসব নারী লেখক কল্পনাই করতে পারেন না। এটা কি তাদের ভাগ্য বলবো নাকি আমি তাদের ভাগ্যকে হিংসে করবো? অথচ আপামর জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশ নারী, যারা বেঁচে থাকার যুদ্ধে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে যাচ্ছে। সেই বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্বকারী হচ্ছেন ঐসব নারী লেখক, যারা পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন। এখন কথা হলো, এই বৃহৎ অংশের নারীরা সবাই কি আদরে আহ্লাদে বড় হচ্ছে! পাচ্ছে কি সামাজিক এবং পারিবারিক মর্যাদা! এমন অনেক প্রশ্ন জাগে মাথায়। আদরে আহ্লাদে বেড়ে উঠা এই নারী লেখকরা কিভাবে বুঝবেন এদের মর্মব্যথা ? বুঝতে পারেন না বলে নারী-পুরুষের বিভেদ দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে লেখালেখির মাধ্যমে এমন নারী লেখক যদি মনুষ্যত্বের বিকাশ ‘মানুষ’ হিসেবে দেখাতে না পারেন, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে কেমন করে?
নারী লেখকদের অনেকসময় প্রশ্ন করা হয়, কেন লেখালেখি করেন কিম্বা এর উদ্দেশ্য কি? অনেকেই উত্তরে বলেন, “ভালো লাগে তাই লেখি। লিখলে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো মনে হয়। একটা কিছু লেখার পর খুব রিলাক্স লাগে।” তারপর? এরপর চুপ করে থাকেন। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি চান না আপনার লেখা অন্যকেউ পড়ুক? “অবশ্যই চাই। তবে কে পড়বে আর না পড়বে, সে আশা করে তো লেখি না! লেখি আর কি!” এক্ষেত্রে এমন নারী লেখকদের বলবো, আপনাদের লেখা ডাইরির মধ্যে বন্দী করে রাখুন। এখানে একটা প্রশ্নও জুড়ে দিতে চাই, শিল্পের সুষমা ছড়ানোর জন্যই কি লেখালেখি! আনন্দ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যই কি সাহিত্য রচনা! তাহলে সেই লেখা সিন্দুকে তুলে রাখুন; বিশেষ করে এধরণের নারী লেখকদের লেখা।
নারীপুরুষ যারাই লেখালেখি করুক না কেন এর একটা প্রভাব সমাজে পড়বেই। পাঠক পড়ামাত্রই নিজ মননের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে। এমতাবস্থায় লেখকদের কী ভাবা উচিৎ? অবশ্যই সব লেখকই চান, তার লেখাটা যেন পড়া হয়। লেখালেখি হলো সমাজের দর্পণ। পাঠকও সেখানে নিজেকে দেখেন, লেখকও সেখানে নিজেকে দেখেন। তাই লেখালেখির উদ্দেশ্যই হলো, অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। এই বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে লেখক সামাজিক সচেতনতায় বিরাট ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে নারী লেখকদের মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা না দেখা গেলে, নারী সমাজের পথ মসৃণ তো হবেই না এমনকি অবুঝ নারী সমাজ বুঝতেও পারবে না তারাও যে ‘মানুষ’।
এমনই অনেক নারী লেখক আছেন, যারা ‘নারীবাদ’ বুঝতে চান না। ‘নারীবাদ’ অর্থ যে নারীর ‘মানুষ’ হওয়ার প্রথম শর্ত। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক নারী লেখক তা মানতেই চান না। নারীপুরুষ ভেদাভেদ গুলিয়ে এসমস্ত নারী লেখক যাই লিখুক না কেন, তারা যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন সে সমাজে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা রাখে না। যদি রাখতই তবে আজকের বাংলাদেশে নারী সমাজের এমন অধঃপতিত রূপ দেখতে হতো না।
বেগম রোকেয়ার সময় থেকে তো অনেক সময় গড়িয়েছে। নারী সমাজের পরিবর্তনের যে ছিটেফোঁটা দেখছি তা পুঁজিবাদী শ্রেণিতে আবদ্ধ। অধিকাংশ নারী লেখক নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য লিখে যাচ্ছেন। আর এজন্য পুরুষের সঙ্গেই তাদের আপোষ করতে হচ্ছে। তাই তারা ‘নারীবাদ’ বিষয়টি লেখাতে আনা তো দূরে থাক, মুখেও আনেননা। তাদের এমন লেখক স্বীকৃতি দিয়ে কি হবে নারী যদি নারীমুক্তির পথ না দেখায়! এসব নিয়ে ভাবি আর অস্থির হই। সেইসাথে নারী হয়ে জন্মানোর শত পাপ মাথায় বয়ে বেড়াই।
অতএব, নারী লেখক যদি মানুষ সত্তায় আবির্ভূত না হতে পারেন তাহলে নারীর সঠিক মূল্যায়ন কখনোই হবে না। এরজন্য নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরনির্ভরশীলতা নারী মুক্তির অন্তরায় বিধায় নারীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ সত্তায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তা না-হলে বেগম রোকেয়া, সিমন দ্যা বুভ্যেয়ার, মহাশ্বেতা দেবীর মতো আরো অনেক নারী লেখক তৈরি হতো এই সমাজে। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছি না।