Homeউপন্যাসঅনুরণন (পর্ব-১০)

অনুরণন (পর্ব-১০)

উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১)অনুরণন (পর্ব-০২)অনুরণন (পর্ব-০৩)অনুরণন (পর্ব-০৪)অনুরণন (পর্ব-০৫),  অনুরণন (পর্ব-০৬)অনুরণন (পর্ব-০৭)অনুরণন (পর্ব-০৮), অনুরণন (পর্ব-০৯)

১৯৪৮ সাল।

ঠিক কখন ভোর হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। মধ্যরাত থেকে বিকট গর্জনে আবারও মেঘ ডাকছে। বিদ্যুতের মুহুর্মুহু ঝলকানি ঘরটির মোটা বাঁশের বেতার দেয়াল ছিন্নভিন্ন করে আচমকা খোকার মুখে উপর এসে পড়ছে। হারিকেনের মৃদু আলোয় হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে খোকার ব্যথিত মুখটা আরও কুঁচকে উঠছে। গতকাল বিকেল থেকে আবারও আকাশের ঘনকালো মেঘ রাক্ষসীর মত চেহারা করে ক্ষণে ক্ষণে খাবলে খেতে আসছে । চারদিকে একবার অন্ধকার রাত নেমে আসছে তো কিছুক্ষণ পরেই আকাশের এক কোণে মৃদু আলোর আভা। আধিভৌতিক আবহ এক নির্মম খেলা শুরু করেছে । বেলা ঠিক কতটা হবে এটা বোঝার কোনো উপায় নাই। আসলে ভোর ঠিক কখন হয়েছে এটা ছেলে কোলে বাড়িটির অল্প বয়েসী বউটি বলতে পারবে না। তার ছ’মাসের ছেলেটি রাত থেকে একটানা কেঁদে যাচ্ছে। শীর্ণ ন্যাতানো দুটি স্তন থেকে শিশুটিকে একদম সরানো যাচ্ছে না । রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত অবসন্ন বউটি যখন দেখলো, আকাশের এই প্রলয়ঙ্করী ঘনঘটা, ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী জমিন কাঁপানো মেঘের হুঙ্কার , বিজলীর তীর্যক ফুলকি দেয়া হঠাৎ চোখ ঝলসানো তীক্ষ্ণ রশ্মি আর এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটি পিতলের কুপি জ্বালিয়ে বিছানার অদুরে রেখে হারিকেন হাতে নিয়ে তার শাশুড়ি বাইরে যাচ্ছেন তখন তার বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। তীব্র হাওয়ার নগ্ন মাতমে কুপির শিখা অস্থিরভাবে এদিক ওদিক চৌদিকে কেঁপে কেঁপে নিভে জ্বলতে লাগলো। বেড়ার দেয়ালে ছায়ার অস্থির কাঁপন দেখে বউটির মনে হলো, ঘরে একশো একটা উলঙ্গ ক্ষ্যাপা ডাইনি উদ্বাহ নৃত্যে মশগুল । ভয়ে, আতঙ্কে সে দুচোখ শক্তভাবে বন্ধ করে ফেললো।

বেশ কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে শাশুড়ি ওযু করে ঘরে ঢুকলেন। নামাজের পাটিটা বিছিয়ে নামাজে বসলেন। তখন বউটি বুঝতে পারলো, ভোর হয়ে গেছে। এখন ফজরের ওয়াক্ত। বউটি পাশ ফিরে আবারও তার শুস্ক স্তন ছেলের মুখে পুরে দিল কিন্তু শিশুটি দুধ না পেয়ে আবারও ছটফট করে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। শাশুড়ি সালাম ফিরিয়ে বললেন, “বউ, একটু মুড়ি চাবায়ে পানি খাও, বুকে দুধ আসবে।” বউটি চুপ করে থাকলো। অমনভাবে মুড়ি পানি রাতে সে দু’বার খেয়েছে। ক্ষিদেয় তার পেটে মোচড় দিচ্ছে। সকালে ভর্তা ভাত রান্না না হওয়া পর্যন্ত তাকে অভুক্ত থাকতে হবে। বউটিকে চুপ থাকতে দেখে শাশুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর নামাজের পাটি গুটিয়ে বেড়ার দেয়ালে শিকের মত হাত খানেক তফাতে দুটো ঝুলন্ত দড়িতে আড়াআড়ি ভাবে ঝুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

রান্নাঘরের ছনের চাল রাতের ঝড়ে অর্ধেক উড়ে গিয়েছে আর অর্ধেক ভেঙে প্রায় দেবে পড়েছে । চারদিকের বেড়ার দেয়ালের দুটি ভেঙে পড়েছে। পানি কাদায় একাকার রান্নাঘরের মাটির মেঝেও কাদায় থকথকে পেছল হয়ে আছে । একটি নড়বড়ে খুটি ধরে প্রৌঢ়া কোনোরকমে কড়াই আর ভাতের হাড়িটা তুলে আনলেন। গত দু’দিন ধরে কালবৈশাখীর তান্ডব শুরু হওয়ার পর থেকেই আটচালা টিনের ঘরের ভেতরেই, একপাশে ছোট্ট মাটির চুলোতে তাদের রান্না হচ্ছে। সেখানেই, চুলোর পাশে চাটাই বিছিয়ে খাওয়া হচ্ছে। গতকাল রাতে বৃষ্টি একটু ধরে এলে রান্নাঘরে থাকা কলসির পানি দিয়ে মেজে রাখা ভাতের হাড়ি, কড়াই ভুল করে রান্নাঘর থেকে আনা হয় নাই। বউটা সারাটা রাত ঘুমোয় না। ছ’মাসের ছেলেটা ক্ষিদেয় বউটাকে সারারাত লেহন করে আর অবশেষে একফোঁটা দুধ না পেয়ে শিশুটি কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে।

এই ঝড়জল, তুফানে গোয়ালাটাও গত দু’দিন দুধ দিতে আসতে পারে নাই। গত পরশু তার শশুর গোয়ালার বাড়িতে গিয়ে দুধ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু গতকালের ভয়াবহ বজ্রপাত, বৃষ্টি আর বিদ্যুতের অবিরাম আগ্রাসী হুমকিতে বউটি নিজেই শশুরকে গোয়ালার বাড়িতে যেতে বারণ করেছে। দুধ ছাড়া সাগুদানা তালমিছড়ি দিয়ে রেঁধে খাওয়াবে ভেবেছিল। রেঁধেছেও। কিন্তু শিশুটি তা মুখে নিয়ে ফেলে দিয়েছে।

প্রৌঢ়া ঘরের একপাশে মাটির চুলোয় শুকনো খড়ি সাজিয়ে নিয়েছেন। সাজানো খড়ির উপর কাঁচের শিশি থেকে কিছুটা কেরোসিন তেল ছিঁটিয়ে দিলেন। তারপর দুটো পাটখড়ি কুপির শিখায় ধরে তাতে আগুন ধরিয়ে চুলোর খড়িতে আগুন দিলেন । চুলো জ্বলে উঠলে মাটির হাড়িতে ধুয়ে রাখা চাল চুলোয় চড়িয়ে দিলেন।

মাটির মালসায় ভাতের চাল ধুয়ে নিয়েছিলেন ইতিমধ্যে। চুলোয় হাড়ি বসিয়ে হাড়িতে দুটো বেগুন, দুটো আলু আর কয়েকটি কাঁচা মরিচ ধুয়ে ছেড়ে দিলেন।

এ বাড়িটি দক্ষিণমুখী আটচালা টিনের ঘর এবং বেশ বড়। সামনে দুটো বারান্দা। একটি নিচু বারান্দা আরেকটি উঁচু বারান্দা। দুটো বারান্দাই কাঠের লম্বা পোক্ত রেলিং দিয়ে ঘেরা। বারান্দা থেকে নিচে নামবার পথগুলোতে রেলিং নাই। নিচু বারান্দার বাইরে, পুর্বপাশে মাটির দেয়াল তবে সে দেয়ালটি অর্ধেক গেঁথে তোলা হয়েছে । নিচু বারান্দার ওই মাটির দেয়াল ঘেষে একটি চৌকি পুর্বপশ্চিমে আড়াআড়িভাবে রাখা থাকে সারাবছর। ভোরের প্রথম সুর্য্যালোক আম, নিম, জারুল, কাঠালের বনবীথির পাতার ফাঁক দিয়ে প্লাবিত করে নিচু বারান্দার মেঝে, চৌকি, বালিশ, নকশি কাঁথা। সে চৌকিতে একটি বালিশ আর প্রৌঢ়ার হাতে সেলাই করা একটি নকশি কাঁথা। বালিশের উপর হাতে ফুলতোলা, চারদিকে ঝালর ঝুলানো নিখুঁত ভাবে সেলাই করা ওয়ার। বউটি যখন প্রথম প্রথম এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল তখনকার সেলাই এগুলো। খোকা হবার পর সে ভীষণ রোগা হয়ে গেছে। কোলের শিশুটি মাকে একদম ছাড়েনা। শাশুড়ি বলেন, “ও বউ, যাও দিকিনি, খোকাকে খাওয়াও। ইদিকটা আমি সামলে নিচ্চি। ওই তো দু,গে ভাত রান্না আর শাকপাতা ভাজি,বাগুন আলু ভর্তা। আমিই সামলে নিচ্চি। তুমি খোকাকে নিয়ে ঘরে যাও মাগো।”

নিচু বারান্দার সেই চৌকিতে প্রৌঢ় দলবল নিয়ে বসে হুক্কায় লম্বা টান দেন। মাঝেমধ্যে ছলছল চোখে রাতের নক্ষত্র ভরা আকাশের দিকে চেয়ে দরদি কন্ঠে পাঁজরের দলাবাঁধা কষ্ট গলায় ঢেলে পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমিকের মত গীত ধরেন।

“শ্যাম দ্যাশের কমেলা রে

ও তোর পেছন মাজা সরু রে এ এ এ

শ্যাম দ্যাশের কমেলা আ আ আ রে,,,”

গান শুনে প্রৌঢ়া মুখ ঝামটা দেন। মেজাজ তিরিক্ষি করে বলেন, “মাগিটার সাথে চলে গেলো না ক্যান বুড়ো?

নলীন মিত্তিরের লেঠেলদের কাছে ওই মাগিটারে নিয়ে একসাথে খুন হলো না ক্যান? সারাটা জেবন আমার হাড় কলজে এভাবে জ্বালায়ে পুড়ায়ে ছাই করে দিল বুড়ো।”

বউ ভয়ে ভয়ে বলে, “ও কি অলক্ষুণে কতা গো মা? এই ভর সন্ধ্যেয় কী যা তা কতা কচ্চেন ?”

প্রৌঢ়া জাতি দিয়ে সুপারী কাটতে কাটতে আরও মারমুখো হয়ে বলেন, “এসব জ্বালার তুমি কি বুঝবা মাগো? আমার বাবু তো তোমারে ওরম দুখ দেয় না। আমার বাবু হলো সুনার ছুয়াল। আমার সাত রাজার ধন এক মানিক। ওরম দামান ক’টা মেয়ের কপালে জুটে গো মা? আঠারো গিরামের মাইনষি আমার বাবুর নামে যদি একটাও কুকতা কতি পারে তো আমি শিয়েলের গু খাবো। যাও খুঁজ নিয়ে দ্যাকো গে, যাও।

বউটি একটু সাহস পেয়ে আবারও ভয়ে ভয়ে বলে , আব্বাজানের নামে আপনিই বা ওরম কুকতা কচ্চেন ক্যানো?”

প্রৌঢ়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস হয়ে কাঁসার চিলুমচিতে পানের পিক ফেলে বলেন, “জমিদারের সঙ্গ দিতি যায়ে জমিদারের বাঈজি মাগিটার সাথে পিরিত করিছিল তুমার শশুর নিমকহারাম। মাগিটারে গীত শুনাতো। জমিদারের কানে কতা গেল। মাগিটার কি হয়সে জানিনে তবে বাড়ির পর আইসে নলীন মিত্তির শাসায়ে গেছিল। ওই যে আড়া বেড়ার দিয়াল দেখতিছো, বেড়ার পাশ দরজা দিয়ে এক্কেবারে রান্নাঘরের সামনে আইসে জমিদার কলো, বউমা, শুধু তুমার জন্যি ওরে ইবার মাফ দিলাম। পরের বার ওর লাশ ভাসাবো রামসিঁদির বিলি। আর আরেক কতা, বাবুর ইস্কুল যেন বন্ধ না কইরে দেয় হারামজাদা । বাবুর পড়ালেখার দায়িত্ব আমার।”

আমি তাড়াহুড়ো কইরে একহাত ঘুমটা টেইনে জড়সড় হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম দিয়ে কইছিলাম, আমার বাবুরে আপনি দেখবেন দাদামশাই। আমার আর কিছুই লাগবে না।

ওই ছেনাল মাগিটার জন্যি বুড়ো পরাণ ফাটায়ে গীত ধরে, ফুঁপায়ে কান্দে, রাইতে উঠোনে হাঁইটে বেড়ায়।

আমি কে এই সংসারে মাগো ?”

বলে প্রৌঢ়া আঁচল মুখে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

তা দেখে বউটির চোখ বিষাদের জলে ভরে যায়।

সেও আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।

উঁচু বারান্দাটির বাইরে পুর্বপাশে মাটির দেয়ালটা টিনের চাল পর্যন্ত গেঁথে উঠানো। আরেক পাশে ও সামনের দিকে বাঁশের শক্ত বেতার বেড়ার দেয়াল। অর্থাৎ, পুর্বদিকে মাটির দেয়াল আর তিনদিকে বাঁশের মোটা বেতার দেয়াল। মাটির দেয়ালের অপর প্রান্তে যে বেতার দেয়াল সেখানে একটি কাঠের দরজা। এই ঘরটিতে আরেকটি চৌকি, বালিশ, কাঁথা পাতানো আছে। ওঘরে বউটির শশুর থাকেন। নামমাত্র থাকা। আদতে প্রৌঢ়র রাত কাটে নিচু বারান্দার চৌকিতে একাকি হুকো টেনে, উঠানে জোনাকিদের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলে আর উত্তরে বারোমাসি কাঠাল গাছটার তলার মাচানে বসে পাতার বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পাতার আবডালে ফালি ফালি আকাশ চোখ ভরে দেখে।

পশ্চিমে একটু পেছনের দিকে ভেতর উঠোন, রান্নাঘর, ঢেঁকি ঘর, যা টিনের আটাচালা ঘরটির পশ্চিম দিকের পাশ সিঁড়ির ওপাশ থেকে মোটা বাঁশের বেতা দিয়ে বানানো বেড়ায় আড়াআড়িভাবে আড়াল করা। প্রায় সাত ফুট উঁচু আড়া বেড়া আটচালা টিনের ঘরের পশ্চিম দিক থেকে পশ্চিমের মাটির ঘরের বারান্দার সামনের কোণা অবধি চলে গেছে। আড়াবেড়ার পশ্চিম দিকে বেড়ার একটি দরজা। যেখান দিয়ে বাইরের উঠান থেকে ভেতর উঠানে প্রবেশ করা যায়। আটচালা টিনের ঘরের পশ্চিম দিকের দরজা খুলে আড়াল করা ওদিকের সিঁড়ি দিয়ে ভেতরের উঠোন, রান্নাঘর, ঢেঁকি ঘরে বাড়ির বউ মেয়েরা যাতায়াত করে। যদিও বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজন ছাড়া বাড়ির নারী সদস্য ওই প্রৌঢ়া একাই ছিলেন বহু বছর। পরে ছেলের বউ এসেছে।

পশ্চিমে পেয়েরা, আম, জাম, তেতুল, বেল,গাব, কাঠাল গাছ আর বাঁশঝাড়ের বনবীথির ছায়াপথে অল্পখানিক হেঁটে গেলে ছবির মত রূপসী এক নদী যার বেলে ঘাটের উপরে গাছের ছায়ায় আরেকটি মাচান। কাকচক্ষু ধারায় সে রূপবতী কাহন কাহন রূপো শরীরে ঢেলে স্বর্গীয় লাবণ্য গায়ে মেখে কতশত শতাব্দি ধরে বাঁকা জলে বহে চলেছে সে ইতিহাস এ গ্রামের কেউ জানেনা।

তাঁর পূণ্যময় ঘাটের মাচানে বসে মাতৃরূপা স্রোতস্বিনীর রূপালী ঢেউ দেখে পুরো একটি জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।

পশ্চিম দিকে আরেকটি মজবুত মাটির ঘর আছে। উপরে ছন দিয়ে চালা দেয়া আর সামনে একটি মাটির উঁচু বারান্দা। বারান্দার সামনে দিকে একটি সিঁড়ি আর পাশে আরেকটি সিঁড়ি যা ওই বেড়ার দেয়ালের ওপাশে ভেতর উঠোনে নেমে গেছে । সে ঘরের অর্ধেক জুড়ে মাচান। মাচানের উপর বড় বড় মাটির কুলোয় বছরের ধান মজুদ রাখা থাকে। বাকি অর্ধেকে একটি বড় খাট। ফুলতলা বালিশের কভারে বড় যত্নে সাজানো দুটো বালিশ, নকশি কাঁথা ও কোলকাতা থেকে আনা কমদামী ফুলছাপা রঙিন বিছানার চাদর। প্রৌঢ়ার ছেলে বাড়ি এলে সেখানে থাকে।

পুর্ব দিকে আটচালা টিনের ঘরের খানিক তফাতে গোয়াল ঘর। একসময় গাই গরু বাছুর ছিল কিন্তু এখন গোয়াল শুণ্য। গরু বাছুরের পেছনে গরুর মত খাটতে হয় যা প্রৌঢ় এখন আর একা পারেন না। বাড়ির দক্ষিণে কোনো ঘর নাই। বাড়িতে ঢোকার মুখে একপাশে বিশাল একটি কামিনী ফুলের গাছ আরেকপাশে বিশালাকার একটি ঝুমকো জবার গাছ। জবা গাছে থরে থরে ঝুমকো জবা ফুটে নুঁয়ে থাকে আর কামিনীরা দল বেঁধে রাতের আঁধারে সারা উঠোনে, বাড়িতে সুবাস ছড়ায়। নিম কাঠাল গাছের পাতারা হাওয়ায় দোলে। দেড় একরের পুরো বাড়িটির সীমানা দেবদারু, সুপারী , খেজুর আর তালগাছ দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ সীমানার ওপাশে মাটির চওড়া রাস্তা। রাস্তার এধারে বাড়ির সীমানা লাগোয়া একটি বিশালাকার বটগাছ তার অসংখ্য মোটা, সরু, খাটো, লম্বা, পাকানো শেকড় ঝুলিয়ে মহাকালের সাক্ষী হয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছের গোড়াটি চক্রাকা‌রে ইট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। জমিদার নলিনী মিত্র কালের সাক্ষী বটের গোড়া বাঁধিয়ে দিয়েছেন। এই বটগাছের বয়স কত তা গ্রামের কেউ জানেনা। বহুদূর থেকে হেঁটে আসা গেঁয়ো পথিকেরা শ্রান্ত দেহে বটের তলায় খানিকক্ষণ বসলে বাড়িটি থেকে বেতের পোয়ায় মুড়ি, সাথে পাটালি গুড় আর কাঁসার বাটিতে পানি নিয়ে আসেন ওহাবের মা। যিনি প্রৌঢ়ার গরীব বিধবা জা। মৃত স্বামীর ভিটাবাড়িতে অনাহারে অর্ধাহারে একটি পাঁচ ছয় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে যার জীবন কাটে। তবে প্রৌঢ়া তাকে এ বাড়িতে ছেলেসহ তিনবেলা খাওয়ান। ওহাবের মা জায়ের হাজারো নিষেধ স্বত্তেও উঠোন ঝাট দেন, থালাবাসন মাজেন, ঘর লেপেন। হাতের টুকিটাকি কাজ করে দেন। বাড়ির চারধারে খোলা জায়গায় দুই জা মিলে বিভিন্ন সবজির বাগান করেন। বারমাসে খুব কম শাকসবজিই প্রৌঢ়াকে কিনে খেতে হয়। ঘরগুলোর সামনে ছোট্ট এক চিলতে বাগানে প্রৌঢ়ার প্রিয় ফুল গাঁদা ফোটে বারোমাস। চওড়া মাটির রাস্তা বেশ খানিক দুরে গিয়ে শেষ হয়েছে খেয়াঘাটে। খেয়াপার হয়ে হাটুরে লোকেরা নদীর ওপারের হাটে যায়। খেয়াঘাটে যাবার আগে অবশ্য অনেকে বাড়িতে কিছুক্ষণ বসে হুকো টানে, পান সুপারি খায়। কখনওবা গুড়মুড়ি খেয়ে পানিও খায়।

এসব এই বাড়িটির বহু বছরের ঐতিহ্য।

আটচালা টিনের ঘরটির পেছনে অর্থাৎ উত্তর দিকে পুর্ব পশ্চিম বরাবর খানিকটা অংশ নদীর তীর পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে ছনের ঝাড় দিয়ে ভরা। তবে ঠিক ঘরের পেছনের অংশ আর পুর্ব অংশ শাকসবজি, লাউ কুমড়ার মাচান, বেগুন, কাঁচামরিচ,বাতাবি লেবুর গাছ দিয়ে ভরা । ওদিকে তাকালে প্রৌঢ়ার হাতের যত্ন স্পষ্ট অনুভূত হয়। ছন, হুগলা, উলুঝাড়ের ওপারে দেবদারু, সুপারীর সীমানা।

উত্তরের সীমানার ওপাশটায় হিন্দুপাড়া। একটি পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে হিন্দুপাড়ার মানুষেরা বারোমাসি কাঠাল গাছের নিচ দিয়ে আটচালা ঘরের পুর্বপাশ হয়ে অব্যবহৃত গোয়াল ঘরের পেছন দিয়ে, কামিনী জবার মাঝ দিয়ে মাটির চওড়া রাস্তায় গিয়ে ওঠে । কয়েক ঘর সনাতনী তাদের হাটবাজার বা অন্যান্য কাজকর্মের জন্য নদীর ওপাড়ে যেতে হলে এই বাড়ির ভেতরের পথটি ব্যবহার করে খেয়াঘাটে যান। কুমুদির মা কুমড়ো বড়ি,কাসুন্দি,নাড়ু, মোয়া ইত্যাদি বানিয়ে ফি বছর এ বাড়ির দাদা বৌঠানকে দিয়ে যান। এ বাড়ির প্রৌঢ়া বউ ঠাকুরণকে না দিয়ে কুমুদির মা নিজহাতে বানানো কোনো কিছুই খান না।

বাড়িটি তৎকালিক পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি অজপাড়াগাঁয়ের বাড়ি । দেশবিভাগের ফলে বাড়ির একমাত্র সন্তান ছেলেটি তার কোলকাতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় নতুন করে সরকারি চাকরি নিয়েছে। গত আট মাস নিয়মিত মানি অর্ডার আসলেও ছেলেটি বাড়ি আসতে পারে নাই। অথচ, কোলকাতা থেকে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসতো সে। ভোরে রওনা দিয়ে বাড়িতে এসে দুপুরের ভাত খেতো। পুর্ববাংলা তখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে শিক্ষায় কর্মক্ষেত্রে সমৃদ্ধ কোলকাতামুখী। আর দেশবিভাগের পরে কর্মস্থল ঢাকা থেকে বাড়ি পৌঁছাতে দু’আড়াই দিন লেগে যেতো। নতুন দেশ, নতুন শাষক, নতুন জায়গা,নতুন চাকরি,নতুন পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে তাই ঢাকাতে মানিয়ে নিতে প্রৌঢ়ার ছেলের বেশ ধকল যাচ্ছিল। এমনকি, বউটির ছেলে হয়েছে সে সংবাদ চিঠিতে পেয়েছে, নিয়মিত চিঠি আদান প্রদান হচ্ছে বউটির সাথে,ছেলের কুশলাদিও জানছিল কিন্তু সন্তানকে এক নজর দেখবার জন্য উর্দুভাষী উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটি বারের জন্যও ছুটি দেয় নাই ।

চুলোয় ভাত উথলে উঠেছে । বাইরে তখনও অন্তরাত্মা কাঁপানো মেঘের গর্জন। মনে হচ্ছে আবারও ঝুপ করে রাত্রি নেমে এসেছে। সেই অন্ধকারের বুক চিরে অগণিত বিদ্যুতের তির বিক্ষিপ্তভাবে ঝলসে উঠছে। এমনি সময় প্রৌঢ়া তাঁর ছেলের বউকে বললেন, “মাগো, ভাতটা একটু দেখো, আমার আবারও বাইরে যেতে হবে।” বউটি চমকে শাশুড়ির দিকে তাকালো। কারণ, এই প্রথম তার শাশুড়ি খোকাকে রেখে তাকে চুলোর রান্না দেখতে বলছেন।

ছেলেকে পাশ বালিশ দিয়ে শুইয়ে বউ উঠে এলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। ততক্ষণে শাশুড়ি প্রায় দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। বাইরে শশুরের রাগতঃ কন্ঠস্বর শুনতে পেলো বউটি। শশুর ধমকায়ে বললেন, “আস্তে যাও বাবুর মা। আছাড় খাবানে তো!”

বজ্রপাতের গগনবিদারী হুঙ্কারে প্রৌঢ়ের কণ্ঠস্বর ঢাকা পড়ে গেল।

প্রৌঢ়াকে ক্রমাগত ঘর বাহির করা দেখে প্রৌঢ় উদ্বিগ্ন হয়ে উপরের বারান্দায় পায়চারি শুরু করেছেন ।

এক পর্যায়ে প্রৌঢ়া আর বাইরে যেতে পারলেন না, হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে ঘরের বিছানায় শুয়ে পড়লেন। প্রৌঢ় দোঁড়ায়ে এসে প্রৌঢ়ার পিঠের নিচে খোকার ওয়েলক্লথটা বিছিয়ে দিলেন। খোকা আবারও কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। প্রৌঢ় ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকাকে কোলে নিয়ে ও ঘরে চলে যাও বউমা। আর এক থালে ভাত ভর্তা নিয়ে এখনই দু’টো খেয়ে নাও। জলদি করো, জলদি।”

খোকাকে কোলে তুলে নিতে নিতে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শশুরের দিকে তাকিয়ে বউ জিগেস করলো, “মার কি হয়ছে আব্বা?”

—“কলেরা,,, তোমার শাশুড়ির কলেরা হয়সে। শিগগির সরো ইখান থে।”

বউ আরও আতঙ্কিত হয়ে বললো, “আপনি ভাত খেইয়ে নিন আব্বা। আমিও ওধারে বইসে খাইয়ে নিচ্চি।”

শশুর ধমকে উঠলেন, “এক্ষণ ও ঘরে যাও। এক্ষণ।”

বউ ভয়ে ভয়ে বললো,

–“আব্বা, আপনি না খেলে আমি যাব না। আপনি আগে খান।”

অবস্থা বেগতিক দেখে শশুর আর বউ হাত ধুয়ে ঘরের আরেক ধারে চুলোর পাশে কুপির হলদে লাল আগুনের আলোতে খেতে বসলো। খোকা শুকনো স্তন মুখে নিয়ে দুধ না পেয়ে আবারও কেঁদে উঠলো। মেঘের গর্জনে খোকার কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল।

বউটির আর ওপাশের মাটির ঘরটায় যাওয়া হয় নাই। বিছানার একধারে শাশুড়ি আরেকধারে খোকাকে শুইয়ে অনবরতঃ তাদের পিঠের নিচের কাঁথা কাপড় পাল্টে দিচ্ছে। এভাবে একসময় বাড়ির সব কাঁথা কাপড় নষ্ট হয়ে গেল । বউ এঘর ওঘর উদ্ভ্রান্তের মত ছুটোছুটি করে কাপড়চোপর জোগাড় করছে। সিন্দুকে তুলে রাখা নকশী কাঁথাগুলো, শাশুড়ির পুরোনো শাড়ি, বউটির নিজের পুরোনো, নতুন শাড়ি, বাড়ির সবক’টি সুতির মশারি, শশুরের পুরোনো লুঙি যেগুলো শাশুড়ি রেখেছিলেন নকশি কাঁথা সেলাই করবার জন্যে। কোলকাতার ফুলপাখি ছাপা বিছানার চাদর, ফুলতলা বালিশের কভার, গামছা, পেটিকোট, ব্লাউজ, সব সব। মুহুর্তেই সব কাপড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রৌঢ় এতক্ষণ স্ত্রীর মুখে চামচে চামচে পানি দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি লাফিয়ে দাঁড়ালেন। নাহ, এভাবে হবেনা। এখনই বাবুর মাকে শহরের হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। আরও একজনকে দরকার। অন্ততঃ আরেকজন বলিষ্ঠ মানুষ দরকার। এই ঘোর ঝড় তুফানে যে নৌকা বাইতে পারবে। কিন্তু পুরো গ্রামেই, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও কলেরা লেগেছে। ওহাবের মাও দু’দিন আসে না। ঝড়জল মাথায় করে হাঁটু কাদা মাড়িয়ে তিনি ওহাবের মায়ের বাড়ি গেলেন। ওহাবের মুখে ওহাবের মা কাঠের চামচে পানি দিচ্ছেন। উঠানে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় চিৎকার করে জিগেস করলেন, “বউ, কি করতিছো তুমি? উহাবের কি হয়ছে?” ওহাবের মা ভাসুরকে দেখে আজ মাথায় ঘোমটা তুললেন না। তার চুল উস্কখুস্ক, অবিন্যস্ত। শুকনো মুখ, বিভ্রান্ত চোখদুটি কোটরে ঢুকে গেছে। যা এর আগে তাকে এমন একবারই লোকে দেখেছিল যখন তার স্বামী ক্ষয়রোগে মারা গেল। ক্ষীণ কন্ঠে ঘরের বারান্দা থেকে তিনি বললেন, “আপনি ইদিক আসপেন না ভাইজান। আমাদের কলেরা ধইরেছে।” প্রৌঢ় থতমত খেয়ে এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে পাশে তাঁর ভাইপো ফজলের বাড়িতে একহাঁটু কাদা ভেঙে ঢুকলেন। ফজল তার ছোট্ট শিশুটির মুখে কাঠের ছোট হাতা দিয়ে পানি দিচ্ছে। প্রৌঢ়কে দেখে কেঁদে উঠলো ফজলের বউ। ফজল বললো, “এ তো পানি মুখে নিচ্ছে না কাকা, ও কাকা রে, ও কাকা, আমি এখন কি করবো!” ফজলের মা বদনা উঠোনে ফেলে কাদামাখা পায়ে টলতে টলতে কোনরকমে বারান্দায় উঠেই ভেজা কাপড়ে ভেজে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। ফজল ছেলের কাছ থেকে দৌঁড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বললো, “মা, ওমা, মা, তোর কি হয়ছে মা? কি হয়ছে তোর?” আসেপাশের বাড়ি থেকে দু’তিনজন বয়স্ক নারী, অল্প বয়সী ছেলেরা দৌঁড়ে এলো সেখানে। কিন্তু তাদের মধ্যে বলিষ্ঠ জোয়ান কাউকে পেলেন না প্রৌঢ়, যে এই ঘোর তুফানে বৈঠা বাইতে সক্ষম। প্রৌঢ় দৌঁড়ে পুরো গ্রাম ঘুরে ভিজে, কর্দমাক্ত গায়ে পায়ে হতাশ হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর ভেজা কাপড়চোপর লুঙি গামছা নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। মাটির মেঝেতে প্রৌঢ়ের ভেজা কাপড়ের পানি টপটপ চুইয়ে পড়ছে। মেঝেটা মুহুর্তেই অনেকখানি অংশজুড়ে চক্রাকারে ভিজে থকথকে, কাদাকাদা হয়ে গেল।

এই চক্রবূহ্য ভেদ করে আর কোনোদিন কী তিনি বেরোতে পারবেন!!!

একইভাবে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দৌঁড়ে ছিঁটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি । পেছন থেকে বউটি অস্ফুটে ডেকে উঠলো, আব্বা, আব্বা,,,

প্রৌঢ় ঝড়জল বজ্র উপেক্ষা করে আম, জাম, কাঠালগাছ আর বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে ঘাটে গেলেন। ঘাটে বাঁধা নৌকোটির বাঁধন খুলে নৌকোতে লাফিয়ে উঠলেন। লক্ষ্মীমেয়ের মত শান্ত ছোট্ট নদীটির হঠাৎ ফুঁসে ওঠা এমন মাতঙ্গিনী রূপ তিনি অতীতে কখনও দেখেন নাই। বড় বড় ঢেউ ভেঙে তিনি শহরের দিকে বৈঠা চালানো শুরু করলেন।

ঝড়জল, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে উন্মত্ত উত্তাল ,বিপুল তরঙ্গ সাপের ফনার মত তিরে আঁছড়ে পড়ছে। ফুঁসে ওঠা মানুষ সমান ঢেউ ভেঙে গাঙ চিরে কাগজের নৌকোর মত শহরের দিকে ভেসে যাচ্ছেন তিনি একজন চিকিৎসকের জন্য। একটু চিকিৎসার জন্য। তিনি জানেন না সেখানে চিকিৎসক বা চিকিৎসা মিলবে কিনা! শহরে পৌঁছে এক পর্যায়ে তৎকালীন ছোট্ট সরকারি হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসক তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু স্যালাইন বা কোনো ওষুধ পান নাই। হাসপাতালের দু’তিনটে বিছানায় ও মেঝেতে কয়েকজন কলেরা রুগীও বিনা চিকিৎসায় ধুকছে। পাশে তাদের স্বজনদের আকুল আহাজারি। দু’তিন গ্রামে একসাথে কলেরা লেগেছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসা লোকজন এই ঝড়ের মধ্যেও গোটা শহরজুরে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটোছুটি করছে কিন্তু কোথাও কোনো ওষুধ কেউ পেলো না।

প্রৌঢ় উদ্ভ্রান্তের মত বেরিয়ে যেতেই বউটির মনে হলো,

দেড় এককের এই বসতঃ ভিটায় তখন মাত্র তিনটি প্রাণী। সে, তার শাশুড়ি আর তার ছ’মাসের কোলের শিশুটি । প্রৌঢ়া ও ছ’মাসের শিশুটি কলেরায় ধুকছে আর সে শাশুড়ির মুখে চামচ দিয়ে পানি দিচ্ছে। কোলে তার স্তন মুখে নিয়ে প্রায় নিস্তেজ শিশুটি। বাইরে জমাট বাধা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও,খুব দুরেও না, শেয়ালগুলো সমস্বরে এক নাগাড়ে ডেকেই চলেছে। জানালার ফাঁকে নজর পড়তেই দেখলো, ঝোড়ো হাওয়ায় কাঠাল গাছের দোলানো মাথার সবক’টা ডাল দানবের মত আরও দুলিয়ে দিয়ে আশ্রয়হীন কোনো পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। এই দুর্যোগে পাখিটি কোথাও নীড় খুঁজে পাবে কিনা জানেনা সে। ঘরের পেছনে সম্ভবতঃ একটি বেড়াল ঝোঁপঝাঁড় নাড়িয়ে ঢেঁকি ঘরের দিকে দৌঁড়ে চলে গেল। সেখানে কি সে নিরাপদ আশ্রয় পাবে! থেকে থেকে ডালপালা ভেঙে পড়ার মড়মড় মড়াৎ শব্দ হচ্ছে। বউটি আঁতকে উঠে কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলো, কেউ কি হাড়গোড় কড়কড় করে চাবিয়ে খাচ্ছে? হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে টিনের চালের ওপর কোনো গাছ বা গাছের মোটা ডাল তার শাখাপ্রশাখা নিয়ে আঁছড়ে পড়লো।

বউটির মনে হলো, রোজ কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে।

অনেক রাতে শুণ্য হাতে ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে আম,কাঠালের বনবীথির জমাট অন্ধকার,কর্দমাক্ত পথ দিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে একসময় প্রৌঢ় বাড়ি ফিরে এলো।

ভোররাতে বউটির হাতের উপর তার শাশুড়ির ঘাড় শক্ত হয়ে গেল। পাশে খোকাও নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে বউটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পাশে বসা শশুরের স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আব্বা, মার ঘাড় ওরম শক্ত হয়ে গেল কেন?”

শশুর বললেন, “তোমার শাশুড়ি মরে গেছে মাগো। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ছেলেকে দুধ দাও।”

বলে তিনি সদ্যমৃতা স্ত্রীর লাশের সামনে হাঁটুমুড়ে বসলেন। হারিকেনের হলুদাভ আলোছায়ায় স্ত্রীর মৃত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। স্ত্রীর ঠোঁটের কোণ থেকে তখনও পানি গড়িয়ে পড়ছে। তিনি আঙুল দিয়ে ঠোঁটের কোণটা মুছে দিচ্ছেন। কিন্তু, গড়িয়ে পড়া পানির ধারা কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। একসময় তিনি বুকফাটা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেঝেতে বারবার মাথা ঠুকতে লাগলেন। তাঁর কান্নার তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভোররাতের আলো আঁধারের বুক ছিঁড়েফুঁড়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়লো। টিনের চালে বৃষ্টির টুপটাপ ধীমে আওয়াজ, মাঝেমধ্যে মেঘের গুড় গুড় শব্দ আর মৃত্যুর জমাট নিরাবতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে প্রৌঢ়ের বক্ষবিদীর্ণ কান্না চারদিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।

বউটি আগে কখনও এত কাছ থেকে কোনো মৃত্যু দেখেনি। হারিকেন ও কুপির সম্মিলিত আলোয় বউটির খসে পড়া খোঁপার ঘনকালো চুলে আবৃত বুকপিঠ, মুখাবয়ব যেন অজাতশত্রুর ধুসর নগরী বিম্বিসার শ্বেতশুভ্র পাষাণ বেদীতে সদ্য শুলবিদ্ধ যন্ত্রনাকাতর কোনো দীর্ণ শীর্ণ বুদ্ধদাসী বালিকার প্রতিচ্ছবি । সে বাকরুদ্ধ, স্থবির, মুর্তির মত একইভাবে বসে রইলো। পুর্বকোণ রাঙা হয়ে উঠেছে সে বুঝলো না । মুক ও বধিরের মত শাশুড়ির মৃত মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে একটানা চেয়ে থাকলো। কোলের শিশুটি কখন যে আবারও মৃদু কঁকিয়ে উঠেছে, হতভাগী তা শুনতেও পেলো না ।

রাতভোরে সেদিন আর কেউ ওযু করে নামাজে বসলো না। সকালে ঝড়বৃষ্টি থেমে কাঁচা সোনার মত গলে গলে রোদ উঠোন প্লাবিত করলো । ঠিক কতটা সময় পার হয়েছে বউটি তা জানে না। আসলে তখন রাত না দিন, ঝড়বৃষ্টি না ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল, নাকি ঘোরতর অমাবস্যার অন্ধকার রাত তাও বউটি বুঝতে পারছে না। তার কোলে কে ঘুমিয়ে আছে, কার শিশু? ঘুমিয়ে আছে নাকি হাত পা ছুড়ে খেলছে, মায়ের চুল মুঠিতে টেনে ধরে খলবল করে হাসছে নাকি নিথর হয়ে নুঁয়ে পড়ে আছে তাও বউটি জানেনা। জানেনা, এ শিশু জীবিত না মৃত? বুকে মুখ গুঁজে স্তন খুঁজছে নাকি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে? কতকগুলো মাছি কী শিশুটির মুখের চারপাশে বনবন শব্দ করে ঘুরছিল? এসবের কিছুই বউটি জানে না।

সময় কতটা পেরিয়ে গিয়েছে কেজানে! একসময় অচেনা অজানা এক মহিলা এসে অসাড়, মুক,পাথরের মুর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা বউটির কোল থেকে মৃত শিশুটিকে আড়া করে তুলে বেরিয়ে গেলেন। পাশে শাশুড়ীর লাশ তখনও পড়ে আছে। সে লাশও নামাজের ছোট মাদুরে শরীরের মধ্যাংশ মুড়ে পাঁজাকোলা করে তুলে মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ভেতর উঠোনে প্রথমে মহিলাটি বড় চাটাই বিছিয়ে চাটাইয়ের পাঁচদিকে আগরবাতি জ্বালিয়ে নিয়েছেন । তারপর বড় চাটাইয়ের উপর শোয়ানো দুটি লাশকে হালকা কুসুম গরম পানি আর কোলকাতার জলে ভাসা সাবান দিয়ে গোসল করালেন। বাহির উঠোন থেকে আড়া বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে ঈমাম হুজুর মহিলাকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। গোসল শেষ হলে চাটাই যতটুকু সম্ভব সঙ্গে আনা নিজের ধোয়া শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নিলেন। তারপর কাফনের কাপড় বেড়ার দরজা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওপাশ থেকে নিয়ে নিলেন মহিলা। প্রৌঢ়া আর শিশুটিকে ঈমাম হুজুরের নির্দেশনা অনুযায়ী কাফন পরিয়ে দিলেন। চোখে সুরমাও এঁকে দিলেন।

গায়ে মুখে ছিঁটিয়ে দিলেন সুগন্ধি কর্পুর ,,,

ঈমাম সাহেবকে আজ এ বাড়ি ওবাড়ি দৌঁড়োতে হচ্ছে। সাথে করে নিয়ে এসেছেন মক্তবের উঠতি বয়সের তিন চারজন তরুণ কিশোর ছেলেকে। এক বাড়ির মৃতদের গোসল, কাফন পরানো, জানাজা পড়িয়ে দাফন সম্পন্ন করে আবার আরেক বাড়িতে দোঁড়োতে হচ্ছে ঈমাম হুজুরকে। এক বাড়ির মৃতদের জানাজায় আরেক বাড়ির পুরুষদের পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের কয়েকজন খুব ভোরেই চলে গেছে শহরে। দুজন কাফনের থান কিনছে তো আরও তিন চারজন সে থান নিয়ে গ্রামে রওনা দিচ্ছে । সাথে আগরবাতি, আতর,সুরমা ভরা সুরমাদানি,কর্পুর ইত্যাদি। আবারও দুএকজন গিয়ে থান নিচ্ছে গ্রামে ফিরছে ।

একদিনে নদীর পাড়ে বড়ছোট ১৮ টি কবর খোঁড়া হলো। শ্মশানে ১৩ টি চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। কুমদের মা বেঁচে থাকলেও তাঁর পাঁচ বছরের নাতিটি মারা গেছে। যার দস্যিপনায় কুমুদের মা রাতদিন অস্থির থাকতেন। এখন থেকে আর কেউ তাঁকে জ্বালাবে না, সদ্য বানানো গুড়মুড়ির মোয়া দু’হাতে তুলে নিয়ে দৌঁড়ে পালাবে না । পুজো শেষ হওয়ার আগেই ঠাকুরের ভোগ থেকে আর কেউ কলা, বাতাসা চুরি করবে না। কুমুদের মা মাটির বারান্দায় পা ছড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। হাওয়ার উড়ছে ঠাকুরের ফিরিয়ে দেয়া শুণ্য আঁচল। ঠাকুরের কাছে বিধবা তাঁর শ্বেতশুভ্র আঁচল পেতে লুটিয়ে পড়েছেন, সারারাত মাথা কুটেছেন,ভিখ মেগেছেন। ঠাকুর কেন এতো অপ্রসন্ন সে হিসাব তিনি কিছুতেই মিলাতে পারছেন না। ও পাড়ার সই বৌঠানও মরে গেলেন। ঠাকুর কেন তাঁকে একা রেখে গেলেন সেই অংক কষতে গিয়ে বারবার ভুল হচ্ছে তাঁর। কুমুদের বউ অবাক দুটো চোখ বড় বড় করে উঠোনের চারদিকে কী যেন খুঁজছে। আর তা না পেয়ে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। বউটি শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঝলমলে আগুন রোদেও চারদিকের অস্ফুট, পাঁজরভাঙা কান্নারোলে গ্রামটিতে সেদিন বয়ে যাওয়া বাতাসও ভারী, গুমোট ।

হিন্দুপাড়ার ধুপের ধোঁয়ায় সোনালী রোদের ঝকঝকে নীল আকাশ ধুসর হয়ে গেল। সমস্বরে “কলেমা শাহাদাত” আর “হবিবোল” আওয়াজের বেদনার্ত প্রতিধ্বনি সইতে বইতে না পেরে গ্রামের সবচেয়ে উঁচু তেতুল গাছটির আধভাঙা মগ ডালটি স্বশব্দে মড়মড় করে খেয়াঘাটের বড় মাটির রাস্তার উপর ভেঙে পড়লো।

মৃতপুরী গ্রামটি সেদিন এভাবে সাদা থান, আগরবাতি, ধুপের ধোঁয়া আর চিতার আগুনে ভারী হয়ে উঠলো।

ঈমাম সাহেবকে জানাজার পর জানাজা পড়াতে হচ্ছে । তিনি জানেন, যে বাড়ি থেকে মুরদা এইমাত্র কবরস্থ করে বেরোলেন, সে বাড়িতে আবারও যেতে হতে পারে। অন্ততঃ তার অতীত অভিজ্ঞতা তাইই বলে। নারী মৃতা সকাল পর্যন্ত দুজন ছিলেন। ওহাবসহ ওহাবের মাও মারা গেছেন। সকালে প্রৌঢ়ের ঘাটে নৌকা থেকে যে মহিলা নেমেছিলেন তিনি তাদেরও গোসল দিয়ে কাফন পরিয়েছেন। ভদ্রমহিলা এসেছেন নদীর পাড়ের অন্য একটি দূরের গ্রাম থেকে। সম্পর্কে প্রৌঢ়ার ভাবি । একটি তিন চার বছরের ছেলে নিয়ে যিনি তিনবছর আগে বিধবা হয়েছেন। কলেরার সংবাদ পেয়েছেন তাঁর ভাইয়ের কাছে গতরাতেই। যে ভাইয়ের সাথে তাঁর ননদের স্বামীর অর্থাৎ প্রৌঢ়ের গত সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল শহরে।

কবর খোঁড়াতে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না কোনো বাড়ির লোকজনেরই। তিনদিনের অবিরাম ঝড়বৃষ্টিতে মাটি যথেষ্ট নরম হয়ে আছে । একসময় এ বাড়ির উঠোনেও মসজিদের ঈমাম চলে এসেছিলেন সাথে ওই তিন চারজন তরুণ কিশোর মক্তবের ছেলেরা। প্রথমেই দুটি ছেলে গাঙের পাড়ে খানিক উত্তর সীমানা ঘেঁষে কোদাল দিয়ে দুটি কবর খুঁড়ে ফেললো। তারপর ওযু করে জানাজায় দাঁড়ালো। কাঠের খাটিয়ায় কাফনে মোড়া পাশাপাশি দুটি লাশ রেখে হালকা ভেজা উঠোনে দাদি ও নাতির জানাজা পড়লেন ঈমাম হুজুর। জানাজা শেষে গাঙের পাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে দুজনকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো। একটি কবর বড়, পাশে ছোট্ট আরেকটি কবর।

কবর দেবার পালা শেষ হলে ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকে দেখলেন বউটি পাথরের মুর্তির মত বসে একইভাবে বসে আছে। তিনি বউটিকে উঠিয়ে পশ্চিম সিঁড়ি দিয়ে ভেতর উঠোনে নিয়ে আসলেন। ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে ঈমাম সাহেব আর তাঁর সাথের ছেলেগুলো চলে গেছেন আরেক বাড়িতে। ভদ্রমহিলা বউটিকে ভেতর উঠোনের একপাশে জলচৌকিতে বসালেন। জলচৌকির পাশে একটি কাঁসার ঘটি ও পানি ভরা তিনটি মাটির কলস। বউটির মাথায় পানি ঢালার সময় ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির অবিন্যস্ত এলোচুল জলচৌকির পায়া ছাড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

দুটো কবরের পাশে মাটিতে বসে থাকা প্রৌঢ় আকাশের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছেন। চোখে তাঁর জমে আছে অনেক না বলা কথা। যা আর কখনোই কাউকে বলা হবেনা। এমন সময় দা হাতে পাশে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “ভাইজান, বাঁশের খুঁটো দিয়ে কবর দু’টো ঘিইরে দিতি হবে। আর কলাপাতা দিয়ে কবরগুলো ঢাইকে মুটা বাঁশের খন্ড কয়েকটা দিয়ে ভারাও দিতি হবে। শিয়েলের উৎপাত বাড়বে এখন গিরামে। আমি কলাপাতা কেইটে এইনেছি। কবরে বিছিয়ে দিয়ে বাঁশঝাড়তে বাঁশ কেইটে আগে ভারা দেবো তারপর খুঁটি গাঁড়বো। ওদিকের কাজ সাইরে আইছি। বিছানাপাতি ধুইয়ে, রোদে দিয়ে, ঘরদোর লেইপে বউমারে গোসল করায়ে পশ্চিমের ঘরে শুইয়ে দিয়েছি । এখন ইখানকার কাজ কইরে একবারে ডুবোয়ে গোসল সাইরে চিঁড়ে গুড় খাবো। সুময় লাগপে। আপনি তো গোসল করিছেন। চিঁড়ে ধুয়ে ভিজায়ে পশ্চিমের ঘরের মাচানের উপর ঢেকে রেখেছি। পাশে বাটিতে পাটালি গুড়ও থালা দিয়ে ঢেকে রেখেছি।

খেইয়ে নেন গে ভাইজান।”

প্রৌঢ় শুণ্য দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি আসলে কিছু শুনতে পেলেন কিনা ভদ্রমহিলা বুঝতে পারলেন না।

ভেতর উঠোনে জলচৌকিতে বসে বউটি ঘাটের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর ভেজা চুল মেলে দিয়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে চুল শুকানোর চেষ্টা করছে বউটির মা। খবর পেয়ে গতকাল তিনি,বউটির বাবা, তাদের বড় ছেলে, ছেলে বউ ও ছোট মেয়েটি এসেছেন । তাঁর মেয়ে দু’দিন হলো কথা বলেনা। মুখেও দানাপানি নেই না। কয়েক রাত যে ঘুমোয় নি তার হিসাবে নাই। রাতে বিছানায় শুইয়ে দিলেও মেয়ে তার চোখের দুটো পাতা এক করেনা। গভীর রাতে গুঙ্গায়ে চমকে উঠে বসে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়। ব্যস্ত হয়ে বিছানা হাঁতড়ে কিছু খোঁজে। বুক তার ভারী হয়ে নুঁয়ে পড়েছে। বুকে হাত দিয়ে যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠে মেয়ে জ্ঞান হারায়।

কিছুক্ষণ পরপরই বউটি জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে বোবা দৃষ্টিতে ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকছে। বউটিকে ঘিরে পিঁড়িতে, চাটাইয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে তার মা, ছোট বোন । তার ভাবি রান্নাঘরে ভদ্রমহিলার সাথে রান্না করছে। যদিও তিনদিন চুলো জ্বালানো মানা প্রথানুসারে কিন্তু কিছু খেতে তো হবে। বাইরে থেকে খাবার দেবার মত অবস্থা কোনো বাড়িরই নাই। বউটির বাবা ও বড় ভাই বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে বেড়া বানিয়ে ইতিমধ্যে পুরো কবরস্থান ঘিরে দিয়েছেন। প্রৌঢ় করবস্থানের পাশে বনবীথির ছায়ায় জলচৌকিতে বসে নিরবে কবর গুনবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন । তাঁর গোনায় বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে।

কবরস্থানে প্রৌঢ়ের বাবামায়ের কবরে খুঁটি গেঁড়ে নিশানা দেয়া আছে। পাশে ও ভেতরের দিকে ছোট ছোট আরও তিনটি কবরেও নিশানা দেয়া আছে। ওগুলো তাঁর ভাইবোনদের কবর যারা ছোট বেলাতেই মারা গেছে। ওদিকটায় আরও দুটো ছোট ছোট কবর। একটি তাঁর ছোট্ট ছেলেটির যাকে সাপে কেটেছিল। আরেকটি তাঁর ছোট্ট মেয়েটির কবর যে দু’দিনের জ্বরে আচমকা মারা গেল। তাদের বয়স কত হয়েছিল তা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। আরও কয়েকটি বড় বড় কবর রয়েছে। সেগু‌লোতে কারা ঘুমিয়ে আছেন তা প্রৌঢ় জানেন না। কেবল এটুকু জানেন, ওগুলো তাঁর পুর্বপুরুষদের কবর।

তিন দিনের দিন, দুপুরে একটি নৌকা ঘাটে এসে ঠেকলো। নৌকা থেকে বেলে ঘাটে একটি টিনের সুটকেস হাতে নিয়ে নামলো প্রৌঢ়র ছেলে। মাঝ নদী থেকেই সে দেখছিল, নদীর পাড় ঘেঁষে নতুন নতুন কবরের সারি আর শ্মশান ভরা নিভে যাওয়া চিতায় ছাইয়ের স্তুপ। চশমা খুলে চোখের পানি মুছে নিরবে আবারও চশমা পরলো যুবক। ঘাট থেকে উঠে দেখলো, বাজান তার নতুন বেড়া দিয়ে ঘেরা করবস্থানের বেড়ার বাইরে জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছেন। কবরস্থানে নতুন একটি বড় কবর আর নতুন একটি ছোট্ট কবর। তিনি বাবার পাশে এসে দাঁড়াতে প্রৌঢ় ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ উঁচু করে ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর অস্ফুটে বললেন, “বউমার কাছে যাও বাজান, সে তুমার পথ চাইয়ে বসে আছে।”

যুবকের হাত থেকে টিনের সুটকেস আম, জাম কাঠালের ছায়াবীথির পলিমাটিতে ভোতা শব্দ করে আঁছড়ে পড়ে গেলো।

তাঁর কাছে শহর থেকে টেলিগ্রাম গিয়েছিল। কাফনের থান কিনতে যাওয়া এক চাচাতো ভাই পোস্ট অফিস থেকে যুবকের অফিসের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল।

“Mother sick, come sharp”

টেলিগ্রাম পেয়ে উর্দুভাষী উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না বলেই সে তৎক্ষনাত রওনা দিয়েছে। ক’দিন থেকেই তার অস্থির লাগছিল। সদ্যোজাত শিশুটির বয়স ছয়মাস হয়ে গেছে কিন্তু শিশুটিকে দেখবার জন্য ছুটি মিলছে না তার। ছেলের জন্য কিছু কমদামী খেলনা কিনেছিলো তো। সেগুলো কবে ছেলেকে দেবে, কবে ছেলেকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলবে, এই খেলনাগুলো সব তোমার বাজান, সব তোমার, সব সব,,,

বাপের পাশে যুবক হাঁটুগেঁড়ে বসে পড়লো। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে “মা মা মাগো, মা রে, আমারে কিছু না বলে তুমি কোথায় চলে গেলে মা, কেন গেলে? ” বলে কেঁদে উঠলো যুবক। তার না দেখা ছ’মাসের শিশুটিও বাপের জন্য অপেক্ষা করে করে বুকভরা একরাশ অভিমান নিয়ে ইহজাগতিক সকল মায়া পেছনে ফেলে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছে।

কী এক হতভাগ্য বাবা সে!

যুবকের শশুর ও সম্বন্ধী যুবককে সেখান থেকে তুলে নিয়ে সরাস‌রি ভেতর উঠোনে আসলো। বউটির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। বউটির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নাই। শার্ট প্যান্ট পড়া কেউ একজন যে তার সামনে দাঁড়িয়েছে তা যেনো সে দেখছে না। সে তখন অন্যকোনো পৃথিবীর সোনাঝরা বিকেলে তাঁর খোকার খেলা দেখছে। দেখছে, তাঁর দুরন্ত খোকা উঠোনে হামাগুড়ি দিচ্ছে, হাতে মুঠো গোল গোল করে দাদির চুল টেনে ধরছে আর দাদি তাতে কপট কান্না করলে খোকা খলবল করে হেসে উঠছে। খোকার ওই ভুবনমোহিনী হাসিতে খোকার দাদি তাকে কোলে তুলে তার মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছেন। ডুরে শাড়ি পরনে, মোটা বেণীর মোটা খোঁপা করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে অদুরে বসে পড়ন্ত বিকেলের সোনা রোদের আলোয় বউটি কুলায় চাল ঝাড়ছে। চাল ঝেড়ে চালের ক্ষুঁদ আলাদা করছে, কাঁকড় বেছে ফেলছে আর মাঝেমধ্যে আনন্দিত দৃষ্টিতে বাঁকা চোখে দাদির সাথে খোকার দুরন্তপনা দেখে মৃদু মৃদু হাসছে।

বউটির শুণ্য কোল দেখে যুবক আবারও চিৎকার করে কেঁদে উঠে সেখানেই বসে পড়লো। হাত দিয়ে বউটির কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিগেস করলো, “খোকা কোথায়? আমার খোকন কই খোকার মা? খোকার মা, কোথায় আমার খোকা?” বউটি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছে না। কেউ একজন তাকে এমন প্রচন্ডভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে তাতেও বউটির কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। সে তখনও অন্যকোনো ভুবনে তাঁর খোকার দস্যিপনা দু’চোখ ভরে দেখছে, খোকার ভুবনমোহিনী খলবল হাসি দেখছে।

এমনি সময় যুবকের মামী, ওই ভদ্রমহিলা ছুটে এসে বউয়ের মুখেগালে চড় থাপ্পড় মারতে লাগলেন। তারপর বউয়ের দুহাত টেনে নিয়ে যুবকের কাঁধে রেখে বললেন, “বউ, ও বউ, বাবু এসেছে, আমাগে বাবু এসেছে বউ, ঢাকা থেকে বাবু বাড়িতে এসেছে। ভাল কইরে চাইয়ে দ্যাখ বউ, ঢাকা থেকে আমাগে বাবু এসেছে, ঢাকা থেকে, ঢাকা থেকে”,,,

ঠিক তখনই বউটি আসমান জমিন বিদীর্ণ করে চিৎকার দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠলো। দু’হাতে খাঁমচে, আঁকড়ে ,জড়িয়ে ধরলো যুবককে।

তারপর জ্ঞান হারিয়ে যুবকের বাহুতে ঢলে পড়লো।

উপরের বর্নিত ঘটনার প্রৌঢ় ও প্রৌঢ়া যথাক্রমে আমার দাদাজান ও দাদিজান। কলেরায় শাশুড়ি আর ছ’মাসের শিশুটির মৃত্যু যাঁর হাতের উপর হয়েছে, সন্তানহারা সেই হতভাগ্য জননী, পনেরো ষোলো বছরের বউটি আমার মা। যুবক, যিনি দেশভাগের নির্মমতার নিষ্ঠুর শিকার, যিনি তাঁর উর্দুভাষী নতুন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত, নির্যাতিত, মানসিকভাবে লাঞ্চিত, যিনি তাঁর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণের সংবাদ পেয়েও জীবিকার তাগিদে সন্তানকে এক নজর দেখবার জন্য ছুটিটুকুও পান নাই, সন্তানকে চোখের দেখাও দেখতে পারেন নাই, কলেরায় মৃত্যুর সাথে একদিন একরাত লড়াই করা হতভাগ্য জননীর জন্য একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তো দুরের কথা, মৃত মায়ের জানাজাটাও পড়তে পারেন নাই, একই রাতে বিনা চিকিৎসায় গর্ভধারিণী মা ও জীবনের প্রথম সন্তান হারানো ক্রন্দনরত ওই বিদগ্ধ যুবকই আমার বাবা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সেলিনা মওলা (Selina Moula)
সেলিনা মওলা
ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান ll

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য