Homeউপন্যাসঅনুরণন (পর্ব-০৩)

অনুরণন (পর্ব-০৩)

পেছনে ফিরে যাওয়া খুব সহজ। তবে অতীত আর বর্তমান, এদুটো কাল একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে বসবাস করা এ বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন নিয়মিত কলেজে যাচ্ছি। ক্লাস করছি। পড়ালেখাও করছি। যদিও একটি বাজে অসুখে আমার জীবন থেকে একটি বছর ধুপের মত উড়ে গেছে। যদিও পুড়ে যাওয়া ধুপের গন্ধে আমি প্রায় সর্বক্ষণ উন্মাতাল থাকতাম। আবার ফিরে গেছি শৈশব, কৈশোরের সেই আনন্দ বেদনাত্বক দিনগুলোতে। ফিরে গেছি অন্নপূর্ণা পিসির দেয়া গুড়ের মোয়াতে। ফিরে গেছি আমার জীবনের প্রথম প্রেমের কাছে। কৈশোরের সেই অপরিপক্ক আবেগ, অভিমান, বঞ্চনা, আকুলতাকে জীবনের এই পড়ন্ত বেলা থেকে পেছনে ফিরে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যতটা সহজ ভেবেছিলাম বাস্তবে তা ঠিক ততটাই জটিল। এখন, জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও অতীতের ঘটনাপ্রবাহের ভুলত্রুটি এ পোড়া চোখে ধরা পড়ছে না। এ এক এমন আত্মকেন্দ্রিক অনুভূতি যাকে না পারি ধিক্কার দিতে না পারছি স্বীকৃতি দিতে। মানুষ মনে হয় এমনই। নিজস্ব ভুলত্রুটি, অন্যায়, বীভৎসতায় জ্বলেপুড়ে খাক হবে, বিষপানে নীলকণ্ঠ হবে তবুও তা তার কাছে চির মহিমান্বিত, পরম আদরের। যেন কাল নাগিনীর মাথার মণি। হারিয়ে গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তছনছ করে দাপিয়ে বেড়ায়। যেন নিজের কাছেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা সর্বনাশা সর্বগ্রাসী এক ক্ষ্যাপা দুর্বাশা-অভিশাপ।
“ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।
মাথায় বৃহৎ জটা ধূলায় কাদায় কটা,
মলিন ছায়ার মত ক্ষীণকলেবর।
ওষ্ঠে অধরেতে চাপি’ অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
দুটো নেত্র সদা যেন। নিশার খদ্যোৎ হেন
উড়ে’ উড়ে’ খুঁজে কারে নিজের আলোকে।”…

বড় ভাইজান পড়ালেখা করতে বিদেশে গেছেন। বিদেশে, মানে আমেরিকায় গেছেন। অনেকদিন হলো ভাইজানকে দেখিনা। ভাইজান কবে বিদেশ গিয়েছেন তা অবশ্য আমি জানি না। কারণ, তখন আমার খুব অসুখ। পরে একটু সুস্থ্য হয়েই বড় ভাইজানের খোঁজ করেছি। মা বলেছেন, বড় ভাইজান আমেরিকায় পড়তে গেছেন। কিন্তু আমি এটা ভুলে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ভাইজানকে খুঁজি। মাকে জিগেস করি, মা বড় ভাইজান কি ভার্সিটি থেকে ফিরেছেন? মা বলেন, সে তো আমেরিকায়। কেন, কি হয়েছে মণি? কি দরকার? আমার আবার তখন মনেই থাকেনা, কেন সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে বড় ভাইজানকে খুঁজছিলাম। মা কেমন যেন রহস্যজনক ভাবে তাকিয়ে থাকেন। আমি থতমত খেয়ে বলি, না, এমনি। ভাইজানকে অনেকদিন দেখিনা তো, তাই। মায়ের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়। আবারও জিগেস করেন, কি হয়েছে মণি ? আমি বলি, সেই কলেজ থেকে মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে, ওষুধ দেবে মা?

একটি বিষয় আমি বুঝিই না, বড় ভাইজানের কথা মনে পড়লেই আমার মাথায় একটা ভোতা যন্ত্রনা শুরু হয়। আর আমি ভাইজানকে খুঁজতে থাকি। ভাইজানকে আমার খুব দরকার। কিছু একটা জিগেস করবো ভাইজানকে। কলেজে থাকলে ক্লাসে মন দিতে পারিনা। সারাক্ষণ ছটফট করি কখন বাসায় ফিরবো। কখন ভাইজানকে জিগেস করবো সারাক্ষণ সেই তাড়াহুড়োতে থাকি। বাসায় থাকলে সারাবাড়ি, একতলা দোতলা, ছাদ, এ ঘর, ও ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকি। মনে মনে ভাবি, ভাইজান ঠিক ভার্সিটি গেছেন। তারপর হঠাৎ একসময় মনে হয় , আরেহ আজকে তো ছুটির দিন, ভাইজানের ভার্সিটিও নেই। তাহলে ভাইজান কোথায়? বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে? আচ্ছা, বাসায় আসুক তারপর জিগেস করবো। আমি ভাইজানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি আর মাথার যন্ত্রনাটা ততক্ষণে আমাকে আঁধমরা করে ফেলে। বাথরুমে গিয়ে বমি করি। মায়ের কাছে যাই। তখন মা বলেন, ভাইজান আমেরিকায়। আমি বলি, মা মাথার যন্ত্রনায় মরে যাচ্ছি, ওষুধ দাও। মা ওষুধ দেয়। আমি ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

উফফ, কয়েকদিন পরপরই এমন হয়। ভাইজান যে আমেরিকায় পড়তে গেছেন এটা তো সবাই জানে। আমিও জানি। মা নিজে আমাকে বলেছেন। তারপরও একথা ভুলে ভাইজানকে খুঁজি। আস্তে আস্তে মাথার যন্ত্রনাটাও বেড়ে যায়। বমি করি। আরো আশ্চর্যের বিষয়, মা যখন জানতে চান, কি দরকার? ঠিক তখনই আমি একদম ভুলে যাই কি কারণে আমি ভাইজানকে এভাবে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছি। মাকে বলি, কি যেন দরকার ছিল, কি যেন জিগেস করবো। কিন্তু কি জিগেস করবো তাইই তো ভুলে গেছি। মাথার যন্ত্রনায় ততক্ষণে আমার চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। কপালের একদিকের একটি শিরা ফুলে উঠেছে। চোখের দৃষ্টি দশ সেকেন্ডও এক জায়গায় রাখতে পারিনা। গলায় দলা পাকিয়ে বমি চলে আসে। দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করি। মা তখন ওষুধ দেন। ওষুধ খেয়ে টানা ঘুম দেই। ঘুম থেকে উঠে মনে করবার চেষ্টা করি, কেন ভাইজানকে এমন হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম।
কী আশ্চর্য,
কিছুই মনে করতে পারিনা…

আপার বিয়ে নিয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আপা তার ডিপার্টমেন্টের একজন বড় ভাইয়াকে বিয়ে করছেন। অনেক আগে থেকেই ভাইয়া আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। আপা আর ভাইয়া যে প্রেম করছেন আমি তা জানতাম। শুধু আমিই নই, বাসার সবাই জানতো। ভাইয়া আপার দু বছরের সিনিয়র। দুজনেই একই ডিপার্টমেন্টে পড়েন। এবার ভাইয়া মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। খুব শিঘ্রই তিনি পিএইচডি করতে লন্ডনে চলে যাবেন। এজন্য এখনই বিয়ের তোড়জোড়। ভাইয়া বিয়ে করেই চলে যাবেন। আপা যাবেন দুতিন বছর পর যখন তার মাস্টার্স কমপ্লিট হবে, তখন।

ও পক্ষের লোকজন বাসায় অনবরতঃ আসছেন। আমরাও যাচ্ছি ওদের বাসায়। আমি অবশ্য একবারই গেছি। পরে মা আর আমাকে নেননি। একটু মন খারাপ যে হয়না তা নয়। তবে বাসার সবাই যখন রূপার মাকে আমার কাছে রেখে চলে যায় তখন আমার দারুণ লাগে। বাসা পুরো ফাঁকা হয়ে যায় আর তখন আমি একা একা ছাদে চলে যাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সপ্তর্ষিমন্ডলের ছয়টি তারা দেখি। বাকি একটি তারা খুঁজে পাই না। ওই হারিয়ে যাওয়া তারাটিকে খুঁজি। তন্ন তন্ন করে খুঁজি। আশ্চর্য, আমিতো কেবল ওই তারাটিকেই খুঁজি। খুঁজে পেলেই তো তারার মালা, নীলাভ মালা গাঁথা হবে।
গাঁথা হয়ে যাবে নীল মণিহার,
নীল মণিহার…

একবার দারোয়ান কাকু দেখে ফেলেছিলেন, আমি ছাদে একা উঠেছি। দৌঁড়ে এসে রূপার মাকে এতো জোরে ধমক দিয়েছেন যে ছাদ থেকে তার ধমকের প্রচন্ড শব্দ আমি শুনেছি। পরের দিন রূপার মাকে মা বলছিলেন, তুমি যদি আমার মেয়ের সাথে না থাকতে চাও তো বলো, আমি অন্য লোক দেখবো। রূপার মা অবশ্য খুব চালাক প্রকৃতির মহিলা। সাথে সাথেই মায়ের পা জাপটে ধরে মরা কান্না শুরু করে দিয়েছিল। মা খুব বিরক্ত হয়ে দারোয়ান কাকুকে বলেছিলেন, একে এখান থেকে সরাও তো রমজান । পায়ে ব্যথা পাচ্ছি। রূপার মাকে বিদায় না করলেও ময়মনসিংহ থেকে আরেকজনকে আনা হলো যাকে তার স্বামী একটি শিশুসহ ফেলে গেছে। দুধের বাচ্চাটিকে মেয়েটি তার মায়ের কাছে রেখে এসেছে ।
আহারে…
মেয়েটির নাম সালমা।
তার কাজ, বাসায় সারাক্ষণ আমার সাথে থাকা। আমি অবাক হয়ে মাকে জিগেস করলাম, ও কেন সারাক্ষণ আমার সাথে থাকে মা?
মা বললেন, এই যে দেখো না, তোমার আপার বিয়ের কথাবার্তা চলছে, আমাদেরকে যখন তখন ওদের বাসায় যেতে হচ্ছে, আবার ওরাও আমাদের বাসায় আসছে। সারাক্ষণ প্রচুর রান্নাবান্না, চা নাশতা বানাতে হচ্ছে। রূপার মা এদিকেই তো বেশী ব্যস্ত থাকে। তোমাকে দেখাশুনা করার সময়ই তার হয়না। আমিও সেভাবে তোমার দেখাশুনা করতে পারছি না। তাই, সালমাকে আনা হয়েছে। সালমা এখন থেকে সবসময় তোমার সাথেই থাকবে। রাতেও তোমার সাথে ঘুমোবে।
–কিন্তু, আমিতো একাই ঘুমোতে পারি মা । আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রূপার মা বিশ্রী ভাবে নাক ডাকতো। সমস্যা তো সেখানে হতো। আমার স্বপ্ন মাঝপথে ভেঙে যেতো,,,
মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে সালমাকে ডাকলো। ডেকে জিগেস করলো, এই মেয়ে, তুমি ঘুমোলে নাক ডাকো?

সালমা মেয়েটি আসার পর থেকেই কাঁদছে। দুধের বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে এসেছে। আহা আহা…
মায়ের প্রশ্নে তার গুমড়ে কান্নার বাধ ভাঙলো। সে একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বললো, না গো খালা, তোমরা আমাকে খামখাই দুষাচ্ছ। আমি জেবনেও নাক ডাকি নাই। বলেই মেয়ে হুলুস্থুল কান্না শুরু করে দিল।
মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দারোয়ান কাকুকে বললেন, এ আবার কোন জ্বালা রমজান? এই মেয়ের কান্না থামাও।
এই মেয়ে কেঁদো না মা, কেঁদো না।
ওদিকে আমি বহু কষ্টে হাসি চেপে আছি। আচ্ছা, ঘুমিয়ে গেলে সে কিভাবে জানবে তার নাক ডাকছে!!!
হি হি হি,,,
আমার সাথে সালমার আজ প্রথম দিন। কলেজ থেকে ফিরে সালমার কান্নাকাটির এপিসোডের মধ্যে পড়েছিলাম। যাক, সে এখন স্বাভাবিক। আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। কিছুক্ষণ আগে যে আকাশপাতাল এক করে কেঁদেছিল এখন তার লেশমাত্র নেই। বরং সে এখন আমার চুল খুব যত্ন করে আঁচড়ে দিচ্ছে। আর অবাক হয়ে বলছে, বাফরে, বুজানের কত্ত চুল। আমি তাকে বললাম, বুজান নয়, আপু বলে ডেকো আমাকে সালমা আপু। সে আবারও অবাক হয়ে, অথবা বুঝতে না পেরে জিগেস করলো, কি কন গো বুজান, আফনে আমারেও আফু ডাকবেন ? হায় হায়, খালায় তাইলে তো মাইরাই ফালাইবো। বললাম, শোনো সালমা আপু, এ বাড়িতে কেউ কাউকে মারধর করে না। তোমাকেও কেউ কখনও মারবে না। আর হ্যাঁ, বুজান না, আপু বলে ডাকবে আমাকে । সালমা মেয়েটি বেশ সরল। সহজেই সে খুশী হয়ে গেল। তবে অতিরিক্ত বাচাল টাইপের। আমাকে বললো, আফু জানেন, আমার জামাই না আরেকটা বিয়া করছে। হেই মাগির গায়ে গতরে গোস্ত ভরা, ছেনাল মাগিডা সোন্দরও আছে, ফর্সাও। আমিতো পাট কাঠির মত হুকনা, কালা।
বললাম, চুপ সালমা আপু, একদম মুখ খারাপ করে কথা বলবে না। এ বাড়িতে কেউ মুখ খারাপ করেনা।
সালমা অবিশ্বাসের দৃষ্টি ছুড়ে বললো, আইচ্চা।
একটু পর সে আবারও শুরু করলো।
বুজ্জেন আফু,
হেই বেডি ফর্সা তো তাই আমার জামাই হের পিরিতে পড়ছে। বিয়া করছে। আমারে আর মনে ধরেনা। আমি কালা তো তাই। তারফরও হের বাড়ি ছাড়ি নাই। চুলের মুঠি ধইরা ব্যডায় পিডাইছিল। তারফরও পায়েও ধরছিলাম গো আফু। তবুও আমারে নিলো না।
আমার মাথাটা আবারও যন্ত্রনা করছে।
সালমাকে তার স্বামী ফেলে গেছে।
সে পায়ে ধরেছিল
তাও নেয়নি
কেন নেয়নি
কিসের ভয়ে নেয়নি
কেউ কি সালমার স্বামীকে মেরেছিল?
কেন মেরেছিল?
কে মেরেছিল?
আমি উঠে গেলাম। বেলকুনীতে দাঁড়ালাম।
আকাশে আজ রঙের খেলা।
কী অপরূপ সুন্দর আকাশ আজ।
আচ্ছা, বড় ভাইজান এখনও বাসায় ফিরছেন না যে?
ভার্সিটিতে আড্ডা দিচ্ছে নিশ্চয়ই,,,
নাকি ফিরেছেন?
যাই, বড় ভাইজানের সাথে জরুরী কথা আছে।
তাড়াহুড়ো করে আমি ঘর থেকে প্রায় দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম। অনেক দুর থেকে কে যেন ডাকছে,
আফু, আফু কই যান? আফু…

আপার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। শপিং করা হচ্ছে। অনেকগুলো অনুষ্ঠান হবে। পানচিনি, গায়ে হলুদ, মেহেদী সন্ধ্যা, রিসেপশন। আমি অবাক হয়ে আপাকে জিগেস করলাম, বিয়ে হবে কবে তাহলে? সবাই হেসে উঠলো আর আপা লজ্জা পেয়ে ভরা আসর থেকে উঠে গেলেন। ছোট ভাইজান বললো, আরে গাধা, মেহেদী সন্ধ্যার দিনই ঘরে বসেই বিয়ে হয়ে যাবে ঘরোয়াভাবে। তারপর সন্ধ্যায় মেহেদী পরবে আপা। সাথে যত মেয়ে থাকবে সবাই পরবে। ভাইয়াও আসবে তবে একটু রাত করে। তখন নাচগান হবে, ব্যন্ড আসবে, গান হবে। তবে কোন ব্যান্ডকে কনফার্ম করবো তা এখনও ঠিক হয় নাই।বাকিসব ঠিকঠাক করে ফেলেছি। এরমধ্যে অবশ্য ভাইয়াকেও মেহেদী পরানো হবে। তবে তা নাচগানের আগে না পরে তা এখনও ঠিক হয় নি। আমার মনে হয়, আগে আপা ভাইয়ার ফটোসেশন আর খানিক নাচ করে তারপর মেহেদী পরলে ভাল হয়। তখনও ব্যন্ড দলের গান চলবে আর নাচের জন্য তো আমরা আছিই, তাইনা বুড়ি?
বললাম, সবই ঠিক আছে, কিন্তু ভাইয়ার মত তুমিও আমাকে “বুড়ি ” ডাকছো কেন? আর ভাইয়াই বা আমাকে “বুড়ি” ডাকে কেন? যাও, আমি নাচবো না।
আমার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। আশ্চর্য, আমাকে “বুড়ি ” বলছে এটাতে এরা আনন্দ পাচ্ছে? আপার মেহেদী সন্ধ্যায় আমি নাচবো না বললাম তাতেও আনন্দে সবাই ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলো???
এ কেমন কথা!!!
আসলে বিয়ে বাড়িতে লোকজন কারণে অকারণে হাসে। যেকোনো উৎসবে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটাও হাসে। যেমন সালমা হাসছে। তার হাসি থামছেই না। সালমা এখন ঘুমের মধ্যেও হাসে। একা একাই হাসে। আমি বলি, সালমা আপু, হাসছো কেন?
সে বলে, এইটা কেমন কথা জিগান আফু???
বিয়ার বাইদ্য বাজতেছে আর মানুষ হাসবো না?
আফনের বিয়ার সুমায়ও সব্বাই হাসবো। আমি তো আরও বেশী বেশী হাসমু। আফনেও হাসবেন নয়া দামানের কথা মনে কইরা।
হি হি হি।
বিরক্ত হয়ে বললাম, চুপ করো তো সালমা আপু। এইসব বাজে কথা একদম বলবে না আমার সাথে।
সালমা মুখ কালো করে বললো, আইচ্চা।
বাড়ি ভর্তি মানুষ। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী আপার বান্ধবীরা সর্বক্ষণ বাড়িতে বিভিন্নরকম কাজ, হাসিঠাট্টা, রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। কেউ কেউ পুরো সময়টা আমাদের বাড়িতেই থাকবে বলে একবারে চলে এসেছে। কেউ কেউ আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। বাবা অবশ্য আগেই বাড়িঘর রঙ করিয়ে ফেলেছেন। যদিও শুধুমাত্র বিয়ে আর মেহেদী সন্ধ্যাটা বাড়িতে হবে, মানে ছাদে হবে। বাকি অনুষ্ঠানগুলোর জন্য ভেন্যু কনফার্ম করে ফেলা হয়েছে।দুটো অনুষ্ঠান বাড়িতে করবার কারণ, আপার বান্ধবীরা বলেছে, তারা সারারাত নাচবে। ছোট ভাইজান আর তার বন্ধুরাও সারারাত নাচতে চেয়েছে। মা অবশ্য আমাকে বলেছেন, মণি, তোমার বান্ধবীদেরও নিমন্ত্রণ করো। রাতে কেউ থাকতে চায়লে থাকবে। নাচবে। গাইবে। প্রয়োজনে তাদের বাবা মায়ের সাথে আমি কথা বলে নেবো। আমি মাকে বললাম, আমার তো কোনো বান্ধবী নেই। কাকে নিমন্ত্রণ করবো?
মা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নীরবে চলে গেলেন।
বাড়ি ভর্তি লোকজন তবে আমার ঘরে কোনো ঝামেলা নেই। এদিকে কেউ আসেনা। উফফ, কিইযে শান্তি শান্তি লাগে। তবে সালমা আপুর বড়ই অশান্তি। তার কাজটাই তো আমার সাথে সারাক্ষণ থাকার কাজ। অথচ এতো বিশাল আয়োজন আনন্দের এই সময়ে সব আনন্দ ফেলে তাকে আমার কাছে থাকতে হচ্ছে।
বললাম, সালমা আপু, আমিতো শুয়েই আছি, তুমি যাও না। মজা করো গিয়ে। সালমা আপু মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, আফনে যান না ক্যান? আফনেও চলেন আফু। বললাম, হইচই শুনলে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয় যে। আমি যাব না। তুমি যাও।
— না, খালায় বকপো
–আরেহ না। আমি মাকে বলে দিচ্ছি।
সালমা আপু প্রায় নাচতে নাচতে চলে গেল।
আমি বিছানা থেকে উঠে বেলকুনীতে দাঁড়ালাম। আকাশটা আজ অন্যরকম। কেমন জানি বিধ্বংসী।
এটা বাংলার কোন মাস? মনে করতে পারলাম না। কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেলে হুড়মুড় করে সন্ধ্যা নেমে আসে। এ সময়ের সন্ধ্যার এতো তাড়া কেন?
আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা তারাটিকে খুঁজি। কুয়াশার জন্য দেখা যাচ্ছে না?
নাকি, এই বেলকুনী থেকে সন্ধ্যাতারা দেখা যায়না?
ঠিক বুঝতে পারছি না ।
এক কাপ চা হলে ভাল হতো। না না কফি। ডাক্তার কাকু আমাকে কফিই খেতে বলেছেন। ক্যাফেইন নাকি ব্রেইনকে সচল রাখে। মা অবশ্য আমাকে কফি তেমন একটা খেতে দেন না। বলেন, ঘুমের সমস্যা হবে। সালমা মেয়েটার ঘুমের কোনো সমস্যা নাই। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে এবং নিয়মিত নাকও ডাকে। সন্ধ্যাটা ক্রমেই রাতের দিকে এগুচ্ছে। নিকষ কালো অন্ধকার রাত। আকাশটা আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো, আমি নিজেও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছি। উথাল পাথাল করে নিজেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে। আলো আর আঁধারের অপার্থিব খেলা চারধারে,,,
–কে ওখানে? আরেহ কে, কে ওখানে?
বিড়বিড় করে বলে উঠলাম। কেউ উত্তর দিলনা। হয়তো ওখানে কেউই নাই। আমারই ভ্রম। অথচ, ওখানে একটি মেয়েকে দেখলাম মনে হলো। লাল পেড়ে সাদা গরদের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয়, পাড়ার কোন মেয়ে সেজেগুঁজে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। মেয়েটির চুল খোলা। সামনে একপাশে ছড়িয়ে আছে। এত্ত লম্বা ঘন চুল!! উফফ, চুলে গোঁজা দুটো গন্ধরাজ গালের পাশের দুলছে। কী অদ্ভুত স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য!!! যেন স্বর্গের অপ্সরা। সে কি পথ ভুলে এখানে চলে এসেছে?
হায়, কী হবে এখন তার?
“হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়।
পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহে–হেথায় সুলভ নহে হাসি”…
বিদায় অভিশাপ।
সহস্র বছরের প্রেম কাহিনী
দেবযানী,,,
এক দুঃখী রাজকন্যা।
যে পাতালপুরীতে সুতপুত্র কচকে দৈত্যগন হত্যা করেছে বারংবার আর দেবযানী তার পিতার মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে কচকে ফের জীবনদান করেছিলেন।
আচ্ছা,
কচ কে দৈত্যপুরীর দৈত্যরা কেন মেরে ফেলতো?
পাতালের রাজকন্যার সাথে স্বর্গের দেবপুত্রের ভাব হয়েছিল বলে?
বড় ভাইজান,
ও বড় ভাইজান,,,
আচ্ছা, আপার বিয়ের তো আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। বড় ভাইজান এখনও এলো না যে? আসবে না? আমি হঠাৎ, ভাইজান, ও বড় ভাইজান বলে ডাকতে ডাকতে প্রথমে বেলকুনী থেকে ঘরে তারপর ঘরে থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরের দিকে ছুটলাম।
একি,
কোনো হইচই নেই কেন?
চারদিকে পিনপতন স্তব্ধতা!
কি হয়েছে?
সবাই হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেল?
কদিন ধরেই তো দিনরাত হইচই, গানবাজনার আওয়াজে এদিকটা সরগরম থাকে। আজ সবাই কোথায়? সব এমন চুপচাপ কেন?
বড় ভাইজান এসেছে?
বড় ভাইজান আসলে তো আরো জোরে সবাই হইচই করবে।
আমি হকচকিয়ে মায়ের ঘরের দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দরজা খানিক চাপানো। খোলা অংশের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম,
সবাই চুপ হয়ে বসে আছে।
আপা মায়ের বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।
আরেহ, আপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!!!
বাবা পায়চারি করছেন আর বলছেন,
আমার মেয়েকে আমি আরও বড় জায়গায় বিয়ে দেবো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
শোনো , তুমি মেয়েকে বুঝাও।
দরজার বাইরে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
মানে কী!!!
আপার বিয়ে ভেঙে গেছে?
এও কী সম্ভব!!!
ভেতরে বসা ছোট খালু বললেন, ওদের আগেই বলে দেয়া উচিৎ ছিল ভাইজান। আপনার বড় ছেলে যে জেলে এটা ওদের কাছে লুকানো ঠিক হয় নাই। বাবা গর্জন করে উঠলেন। বললেন, ছেলেতো সব জানে। সেইই তো বলেছে সে তার ফ্যামিলিকে ম্যানেজ করবে। সেইই বলেছে, “বড় ভাইজান খুন করে জেলে আছে একথা আপনাদের তোলারই দরকার নাই। এসব বিষয় আমিই ম্যানেজ করবে।”
এরপর একটু থেমে বাবা ছোট খালুকে বললেন,
তুমি দেখো নাই, ওরা কেউ বড় ছেলের কথাই তুলে নাই? তার মানে আমি কী ধরে নেবো? ধরে নেবো, ওরা সব জানে। ধরে নেবো ওরা অলরেডি ম্যানেজড।
আঁধখোলা দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব শুনছি। আমার সারা গা ঘেমে উঠছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। বড় ভাইজান খুন করেছেন! খুন করে জেলে আছেন! কাকে খুন করেছেন?
উফফ, নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।
পাশের টেবিলে রাখা কাঁচের ফুলদানীটা সোফার কাঠের হাতলে এক বাড়ি দিয়ে ভেঙে সেই ভাঙ্গা কাঁচ পেটে ঢুকিয়ে দিল!
উফফফ, পেট ফুটো হয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।হকিস্টিকের আঘাতে মাথাটা চৌচির হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়লো।
সে এক হাত মাথায় আর আরেক হাত পেটে চেপে ধরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
মেঝেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে ।
রক্তে পড়ে থাকা মানুষটা মুহুর্তেই রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। সে গোঙ্গাচ্ছে। আমি অনেক দুর থেকে তাকে তুলতে চাইছি।
ঘরের ছাদটা নিচে নামতে শুরু করেছে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে,,,
চারদিকে অন্ধকার,,,
মেঝেতে রক্তের নালা,,,
গোঙ্গানী,,,
আমি দরজার ওপাশ থেকে পর্দা আঁকড়ে টেনে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। পর্দা ছিঁড়ে হেঁচড়ে দরাম করে মায়ের ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম…
“হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি”

অরুণাচল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সেলিনা মওলা (Selina Moula)
সেলিনা মওলা
ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান ll

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য