- উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২) অনুরণন (পর্ব-০৩)
আত্মান
পৃথিবীতে কেউ কেউ জন্মায় কেবল এ পৃথিবীকে উপভোগ করবার জন্য। আবার কেউ কেউ জন্মায় এ বিশ্বের সকল ব্যর্থতা, সকল বেদনা, সকল নিন্দা অবহেলায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য। আমিতো খাপ খাইয়ে নেবার যুদ্ধটা মায়ের পেট থেকেই করবার চেষ্টা করছি।
কিন্তু কেন করছি?
পরাজিত হতে চাই না বলে?
পদে পদে ক্ষণে ক্ষণে কি পরাজিত হচ্ছি না?
আমি আমার একটি অবয়ব নিয়ে এই মহাজাগতিক পরিমন্ডলে উপস্থিত কেবল। কিন্তু যাদের অবয়ব নেই? তারা? বিমুর্ত সেইসব মায়া মমতা স্নেহ ভালবাসা প্রেম ব্যাকুলতা এইসব আসলে কোথায়? এরা তো আমার চারপাশে নেই। তাহলে এই মুর্ত অবয়ব দিয়ে আমি কি করবো?
কেন এ যুদ্ধ?
কার সাথে এ যুদ্ধ?
বোবা ঈশ্বর?
তাঁর সাথে যুদ্ধ করা যায়?
তাঁর সাথে যুদ্ধ করে কে কবে পেরেছে?
আমার মা বাবাও তো যুদ্ধ করেছিলেন।
তারা কি পেরেছেন ঠেকাতে আমার জন্ম?
আমিই বা এতদিন কি পেরেছি ?
আমি কি পেরেছি মানব জনমের মৌলিক অধিকারগুলো জয় করতে অথবা ছিনিয়ে আনতে ?
আমি কি পেরেছি সেইসব বিমুর্ততাকে নিজ মুঠোয় ভরতে যা নিদ্রায় জাগরণে গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে?
“মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল,,,”
–সুরঞ্জনা/জীবনানন্দ দাশ
সম্ভবতঃ আধঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে দেখি ঘরের ছাদটা কাফনের মত ধবধবে সাদা। আমার মনে হলো, আমি মরে গেছি। আমাকে শ্বেতশুভ্র কাফন পরানো হয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি সকলের কথা শুনতে পাচ্ছি কেন? ওহ হ্যাঁ, রূপার মায়ের কাছে শুনেছিলাম, মরা মানুষ সবই শুনে, দেখে, বুঝে কিন্তু বলতে পারেনা। নড়াচড়াও করতে পারেনা। তবে কি আমার চোখদুটো এখনও বন্ধই আছে?
কিজানি, ঠিক বুঝতে পারছি না।
আবার এটুকু বুঝলাম, আমার জামাকাপড় ভিজে জবুথবু হয়ে আছে। বিছানাটাও পুরোপুরি ভেজা।
ও আচ্ছা, আমার মৃতদেহ গোসল করানো হয়েছে। চারদিক তো ভেজা থাকবেই।
এরমধ্যে, ছোট ভাইজান কোত্থেকে ছুটে এসে আমাকে কষে একটা চড় মারলো সাথে বিভিন্নরকম অকথ্য গালিগালাজ। ছোট খালু আর ছোট মামা ঠেকাতে আসলে সে তাদের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। এক পর্যায়ে তারা ছোট ভাইজানকে বাইরে নিয়ে যেতে সমর্থ হলেন।
উফফ, আমি কিন্তু ভীষণ ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু তবুও ছোট ভাইজানের উপর খুব মায়া হলো। আহা, আদরের ছোট বোনের মৃত্যুতে সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। এরমধ্যে বাবা ফুঁসে উঠলেন। বললেন, মরিস না কেন তুই? এ আবার কেমন কথা? আমিতো মরেই গেছি। প্রায় সাথে সাথেই মা বললেন, মারার চেষ্টা তো কম করি নাই। তখনই জানতাম, এই মেয়ে আমাদের সব ধ্বংস করবার জন্যই জন্ম নেবে।
এমা, এসব কি কথা? কেউ মরে গেলে বুঝি বাড়ির লোকজনেরা এতো অকথ্য জঘন্য কথা বলে? ওই যে পাশের বাড়ির তিতলির দিদা মরে গেল সেদিন, কেউ তো এমন আজেবাজে কথা বলে নি! এরা কেন এসব বলছে???
আমি যে বেঁচে আছি তা বুঝলাম, ডাক্তার কাকু এসে যখন আমার মাথায় হাত রেখে জিগেস করলেন , এখন কেমন আছো মাই ডিয়ার লিটল ড্যান্সিং ফ্রগ?
আমি ততক্ষণে পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটামুটি সবই বুঝে গেছি। ডাক্তার কাকুর কথার উত্তরে আমি উঠে বসলাম। বললাম, আমার ঘরে যাব।
আর হ্যাঁ ডাক্তার কাকু, আমাকে কী ব্যঙের মত দেখায়? আমি কি ব্যঙের মত লাফাই যে আপনি আমাকে ড্যান্সিং ফ্রগ বলেন? আমি ভাল আছি। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।
মাথার প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সালমা এগিয়ে এলো আমাকে ধরতে। আমি তাকে সরিয়ে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। কপালের একপাশ একটু থেঁতলে গেছে। বেশ ফুলে উঠেছে কপাল আর মাথার ডানদিকটা। ফোলা জায়গায় হাত দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, এমন সময় কোথা থেকে যেন আপা ছুটে এসে আমাকে এলোপাথারি কিল, লাথি, চড় থাপ্পড় মারতে লাগলেন। আমি ততক্ষণে মেঝেতে পড়ে গেছি। তখন মামি, কাকিমা আর আরও অনেকে ছুটে এলো। আমি কোনরকমে মাথা তুলে আপার দিকে চেয়ে বললাম,
–স্যরি আপা।
আপার বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়াতে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। চুপচাপ কলেজে যাচ্ছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। এক সন্ধ্যায়, সালমাকে ডেকে বললাম, সালমা আপু, তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। এ বাড়িতে মারধোর, গালাগালি সবই হয়। এমনকি খুনের চেষ্টা,,,এমনকি খুনও করা হয়। আমি সবকিছু জানতাম না। অথবা ভুলে গিয়েছিলাম, মনে ছিলনা তাই তোমাকে অমন বলেছি। আসলে, এ বাড়িতে সব সবকিছুই হয়। খেতে বসে মাকে বললাম, মা, সালমা আপুকে অন্য কোথাও শোবার ব্যবস্থা করে দাও। ও বিশ্রী ভাবে নাক ডাকে। আমার ঘুমের সমস্যা হয়।
আর হ্যাঁ, আমি আর ওষুধ খাবো না।
মা রেগে বললেন, ওষুধ খাবে না কেন? ধীরে শান্তস্বরে
বললাম, ওষুধ খাইয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলে কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারো নাই।
মা চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালেন। মাকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে হাত ধুয়ে আমি আমার ঘরে চলে গেলাম।
বেলকুনীতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। শীতের বিকেলগুলোর খুব তাড়া। সন্ধ্যা বিকেলের এ সময়টা অদ্ভুত এক বিষন্নতায় পৃথিবী ডুবে যায়। বেলা শেষ হবার বিষন্নতা। অন্ধকারে ডুবে যাবার বিষন্নতা। নিজেকে হারিয়ে ফেলবার বিষন্নতা। রক্তপাতে রক্তপাতে সুর্য্যটা ডুবে যাচ্ছে দুরের আকাশে। দুরে, বহুদুরের সন্ধ্যার রক্তাভ, রক্তাক্ত আকাশ। কে ওখানে? কে ভেসে যাচ্ছে?
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে,,,
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
–পূর্ণেন্দু পত্রী।