Homeউপন্যাসঅনুরণন (পর্ব-০৬)

অনুরণন (পর্ব-০৬)

উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১)অনুরণন (পর্ব-০২)অনুরণন (পর্ব-০৩)অনুরণন (পর্ব-০৪) অনুরণন (পর্ব-০৫)

প্রকৃতি, এক লীলাবতী চঞ্চলা মেয়ের নাম। অবিরাম সে তাঁর লীলাখেলা খেলে যায়। কখনও সে ছান্দিক, কখনও বা হুলুস্থুল উলোটপালট, ছন্দহারা। কখনও সৌম্যশান্ত, সীমাবদ্ধ, কখনও বা বল্গাহারা

“দূর পাহাড়ের ঝর্ণাতলায়
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়,
সোনায় মোড়া মেঘহরিণী।”

এ খেলায় কেউ কেউ কখনোই প্রকৃতির ছন্দে বা অছন্দে সামিল হতে পারেনা। বহুদূর অরণ্যে দাঁড়িয়ে সব খোঁয়ানো বিপর্যস্ত কবির মত শুণ্য, বেদনার্ত দৃষ্টিতে কেবল মেঘহরিণীর অনন্ত ছোটাছুটি দেখে। পারলৌকিক জগতের বিচিত্র শাখা প্রশাখায় অবাধ, অগাধ বিচরণ করতে গিয়ে অকস্মাৎ শেকলে টান পড়ে। ফিরে যেতে হয় খোয়াড়ে। অবেলায়, কালবোশেখির উথাল পাথাল ঝড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে,হাওয়ার মাতমে ভুল করে নিজেকে পাখি ভেবে ডানা মেলতে চায়। ভুল উচ্ছ্বাসে, ভুল আবেগে, ভুল বাস্তবে উড়তে গিয়ে গুবরে পোকার মত মাথা গুঁজে মাটিতে পড়ে যায়। ছটফট করে। মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে অতৃপ্ত পরাবাস্তব বাসনা।

বাস্তব তখন ক্রিতদাসের মত ক্রুর হাসিতে ফেটে পড়ে।

হা হা হা,,,

“প্রিয়তম, ওইখানে সহস্র ঝাড়বাতি–
এখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার ;
এখানে নিদ্রাহীন বিষাদ রাত্রি,
মৃত সৈনিকের বিশ্রী হাহাকার।।
এখানে লাবণ্য নেই–
কিন্নরকন্ঠ নেই,
সুক্ষ্ম সৌন্দর্য্য নেই,
চোখভরা কথা নেই,
ভাঙা বিগ্রহে বাসি ফুল দেয়
পুরোনো পৃথিবীর সে পুরোনো মেয়েই ।।”,,,

কিছু কিছু মানুষ ছন্দচ্যুত হয়েও ছন্দে ফিরবার মত অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। অথবা, প্রকৃতি তাদের প্রতি সদা প্রসন্নময়ী। তারা কখনো ছন্দ হারালেও প্রকৃতি তাদের ছন্দে ফিরিয়ে আনে। বুকে টেনে নেয়। ঠিক মায়ের মত। ক্ষমতাহীনদের জন্য, অবাঞ্ছিতদের জন্য জন্ম জন্মান্তর ধরে বরাদ্দ থাকে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, রক্তের নালা, ফিনকি দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া রক্তের ফোয়ারা,,,

এক সন্ধ্যায় আমাদের বাসাতে একটি অভাবনীয় আনন্দের ঘটনা ঘটে গেল। আমি অবশ্য কলেজ থেকে ফিরে বিছানায় গড়াচ্ছিলাম। সামনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। রূপার না এমন জোরে চিৎকার চ্যাচামেরি হুলুস্থুল সোরগোল শুরু করে দিল যে আমার মনে হলো, আবারও কেউ খুন হয়েছে। হতেও পারে। তাই আর বিছানা থেকে উঠলাম না। গড়াগড়ি করাতেই বেশী স্বস্তিবোধ করছি। সালমা আপু ধাম করে আমার রুমের দরজা খুলে বিছানায় শুয়ে থাকা আমাকে অকস্মাৎ বেদমভাবে ঠেলতে লাগলো। তাকে ধমক দিয়ে বললাম, কি হয়েছে, এভাবে ঠেলছো কেন? আর আমার রুমে এভাবে ধুমধাম করে ঢুকলে কেন? সে ধমক খেয়েও বিন্দু পরিমাণ উদ্যম হারালো না। বরং আমার হাত ধরে প্রায় লাফাতে লাফাতে বললো, আফু গো আফু, বড় আফু আর দুলাভাই একলগে বাসায় আইছে। উররে সোন্দর লাগতেছে দুইজনরে, উররে সুনার চান ময়না পাখি লাগতেছে গো আফু, আয়েন, লন চলেন, দুইজনরে সালাম করি গিয়া।

আফু আয়েন না,,,

বললাম, হাত ছাড়ো সালমা আপু, আমাকে রেষ্ট নিতে দাও। আর এখন এখান থেকে যাও। কিছুক্ষণ পরে চা নিয়ে এসো। আমি চা খেয়ে পড়তে বসবো।

সালমা আপু কিছুক্ষণ মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। মনে হলো, আমার সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে, যেভাবে আমার গায়ে হাত তোলা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে এভাবে ছুটে আমাকে ডাকতে আসাটা যে তার অন্যায় হয়েছে এটা প্রথমে আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভুলে গেলেও পরে তার মনে পড়েছে ।

অদ্ভুত এদের জীবন। নিজে এক কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খেয়েও অন্নদাতার আনন্দে আনন্দিত হয়, কষ্টে কাঁদে। মা সালমার মেয়ের জন্য প্রতিমাসে টাকা পাঠায়। এতেই সে খুশী। বাকি সবটুকু খুশী আনন্দ উচ্ছ্বাস বেদনা কষ্ট এই বাসার জন্য, এই পরিবারের জন্য সে নিবেদন করেছে। জীবনকে ওরা জটিল করেনা। ওদের সুখ দুঃখ রাখবার পাত্র এভাবেই মিলে যায়।

মেলেনা আমার।

মিললেও হারিয়ে যায়।

“যা কিছু পায় হারায়ে যায় না মানে সান্তনা “,,,

যদিও আমি কখনোই চাইনি, চাইনা, ঈশ্বর আমার কাছে আসুক। তিনি দুরে থাকলেই বা কি আর কাছে আসলেই বা কি? বোবা ঈশ্বর কথা বলেন না। প্রশ্নের উত্তর দেন না। নির্ঘুম সারারাত পায়চারি করে, বেলকুনীতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার পাপগুলো খুঁজি।

একসময় বড় ক্লান্ত হয়ে যাই,,,

বিদ্রোহে প্রতিবাদ করি,,,

এবং খেই হারাই,,,

“নয় নয় নয় এ মধুর খেলা

তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল সন্ধ্যা বেলা

নয় নয় নয় এ মধুর খেলা”,,,

আজ আর আমার ঘরে লাইট জ্বালাতে কেউ এলো না। আমিও শুয়ে আছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়েই আছি। ঘরে সন্ধ্যার আলো জ্বালানো হয় নাই। যদিও আমি নিজে কখনও সন্ধ্যায় লাইট জ্বালাই না। মা অথবা সালমা এসে জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।প্রচন্ড গরম পড়েছে আজ। মাথার উপরের ফ্যানটা একটা বাজে রকম একটানা ঘরর ঘরর শব্দ করে আজকাল। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছি। বিড়বিড় করে বলছি, আর কতদিন এভাবে ঘুরবি? একদিন সুইচ অন করলেও আর কেউ তোকে ঘুরাতে পারবেনা। ক্যাপাসিটর পাল্টাবে, বিয়ারিং পাল্টাবে তারপর হয়তো আরও কিছুদিন পুতুলের মত নাচবি। ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে ধীর লয়ে মুদ্রা বসাবি। সেখানে কোনো তাল থাকবে না, কোনো ছন্দও থাকবেনা।

তারপর?

বিছানায় শুয়ে বেলকুনীর দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বকুল গাছের মাথাটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।আমি বকুলের ডালপালার মধ্যে চাঁদ খুঁজছি। আজ চাঁদের কোন তিথি? কোন পক্ষ? শুক্লা না কি কৃষ্ণপক্ষ? নাকি অমাবস্যা? নাহ, অমাবস্যায় রাত এতো জ্বলজ্বলে হয়না। নিশ্চয়ই শুক্লা পক্ষ। আকাশেও আলোর ছটা। আকাশটা আজ আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। আলোয় ভরে উঠেছে বকুলের ডালপালারা। মৃদু হাওয়ায় ডালগুলো দুলছে। যেন চাঁদের আলোয় তারাও ভেসে যাচ্ছে অমরাবতীর ঠিকানায়।

“সহসা ডালপালা তোর উতলা-যে
ও চাঁপা, ও করবী!
কারে তুই দেখতে পেলি আকাশ-মাঝে
জানি না যে॥
ও চাঁপা, ও করবী!
কোন্‌ সুরের মাতন হাওয়ায় এসে
বেড়ায় ভেসে
ও চাঁপা, ও করবী!”,,,,

আপা ভাইয়াকে স্বাগত জানাবার জন্য আজ আকাশও সেজেছে। সেজেছে আমাদের আঙিনার বকুলের ডালপালাও। হয়তো নদীতে এখন জোয়ার লেগেছে। রজনীগন্ধারা ফুটে উঠেছে। বাতাসে ভালবাসার নেশা।

বাতাসে প্রেমের সোমরস।

বকুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দেয়া ঝলমলে আকাশ দেখছি আর আকাশপাতাল ভাবছি। ঠিক এই সময় চোখের উপরে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। আমি চোখজ্বালা সেই আলো সহ্য করতে না পেরে হাত দিয়ে চোখমুখ ঢেকে ফেললাম। আপা লাইটের সুইচ অন করে বিগলিত কন্ঠে বললো, কিরে, এখনও শুয়ে আছিস যে ? ওঠ। রাত হয়ে গেছে তো।

উল্লেখ্য, আমি বিগত প্রায় সাত/আটমাসের মত হলো বাসার কারো সাথে কথা বলিনা। অবশ্য, আমার সাথেও কেউ কথা বলেনা। শুধু সালমা আপু, রূপার মা খালা আর রমজান কাকু মানে দারোয়ান কাকুর সাথে কথা বলি। মালি কাকুর সাথেও অবশ্য কথা বলি না। মালি কাকুই নিজে থেকে দৌঁড়ে এসে বিভিন্ন ধরনের ফুল হাতে গছিয়ে দেয়। মালি কাকুকে একদিন কঠিন কন্ঠে বলেছি, মালি কাকু, আমাকে আর ফুল দেবেন না তো। ফুল আমার বিচ্ছিরি লাগে।

আবছা আবছা মনে পড়ে, এ বাড়িতে আসবার পর, যখন আমার ভীষণ অসুখ ছিল তখন মালি কাকুকে বলেছিলাম বকুল গাছ, কদম গাছ, কামিনী ফুলের গাছ লাগাতে । গন্ধরাজ ফুলের গাছ তো আগেই লাগিয়েছে। সেই গাছে থোকা থোকা গন্ধরাজ ফোটে। একদিন ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি, ঘুমের মধ্যে খুব বাজে একটি স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, মালি কাকু আমার দিকে রেগেমেগে তাকাচ্ছে আর শিউলী ফুলের গাছটি উঁপড়ে ফেলছে। ঘুম থেকে গুমড়ে কেঁদে উঠে বসলাম । মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জিগেস করলাম, মালি কাকু কই? মায়ের চোখের ঘুম উবে গেল। মা তাঁর সেই বিখ্যাত রহস্যজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন মণি, কি হয়েছে? রামানন্দ তো চলে গেছে। কাল ভোরে আসবে। কি দরকার তাকে? কেঁদে বললাম, মা, মালি কাকু শিউলী ফুলের গাছটা উঁপড়ে ফেলেছে। কেন মা? কেন? মা অবাক হয়ে বলেছিলেন, আমাদের উঠোনে তো শিউলী ফুলের গাছই নেই। উঁপড়াবে কিভাবে?এখন ঘুমোও।

আমি ভীষণ দ্বিধান্বিত হয়ে বললাম, ও আচ্ছা। সমুদ্রমন্থন থেকে উঠে আসা পারিজাত ইন্দ্রের অমরাবতীর বড় যত্নের ধন। কে তাকে চুরি করে পৃথিবীতে আনলো ? কৃষ্ণ? হয়তো। সুর্য্য অভিশাপ দিয়েছিল? তাই অভাগীনি সুর্য্য ওঠার আগেই ঝরে যায়। ভূলুণ্ঠিত হয়। কী অবাক কান্ড! দেবতায় দেবতায় ঝগড়া হয় আর অভিশপ্ত হয় সৃষ্টি!

আহারে হতভাগী, আহা পারিজাত , আহা,,,

পরের দিন মালি কাকু শিউলী ফুলের গাছ লাগিয়েছে। আমি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাছ লাগাতে লাগাতে বললো, দেখে নিও মা জননী, সামনের শরতেই ফুল দেবে। আশ্বিনে মা আসেন তো, মায়ের পুজো হয় এই ফুলে। আমি অবাক হয়ে মালি কাকুকে জিগেস করলাম, কিন্তু আপনার মা না মরে গেছেন? তাহলে আবারও আসবে কিভাবে?

–দুর্গামা মা হয়ে আসবেন।

বলে কপালে দুহাত ঠেকিয়ে দুর্গা মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলো তারপর পরম আদরে শিউলি গাছে জল ঢালতে লাগলো।

এইতো সেদিনও মালি কাকু দৌঁড়ে এসে বললো, মা জননী, এক ঝুড়ি শিউলি কুঁড়ায়ে রূপার মায়ের কাছে দিছি। বলছি সালমাকে দিয়ে মালা গেঁথে তোমাকে দিতে। দেয় নাই মাগো?

বললাম, দিয়েছে কাকু। আপনার শিউলীরা ভারি মিষ্টি। রূপোর মালার চেয়েও অনেক দামি আর সুন্দর এদের মালা। সালমা আমার টেবিলে কাঁচের পিরিচে রেখে গেছে।

মালি কাকু খুব খুশি হয়ে কাজে ফিরে গেল আর আমি কলেজে। শিউলীর মালা ভরা কাঁচের পাত্রটি পড়ে রইলো আমার টেবিলে ।

আজ তো শিউলীরাও ফুটেছে। তারাও আজ ভারি আহ্লাদিত। চারদিকে মোহনীয় সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। তারাও আপা ভাইয়াকে স্বাগত জানাচ্ছে।

স্বাগতম, হে মহান প্রেমিক প্রেমিকা,,,
স্বাগতম, হে যুগলবন্দী চখাচখি,,,
স্বাগতম, হে ধ্রুপদী কবিতা সঙ্গীত,,,

আহা, আপা ভাইয়াকে স্বাগত জানাতে এই বহুরূপী পৃথিবীর সে কী দারুণ আয়োজন!!!

কী বিস্মিত, আহ্লাদিত আড়ম্বর!!!

আপা আবারও আদুরে গলায় বললো, কী হলো রে ? উঠে পড়। তোর ভাইয়ার সাথে দেখা কর গিয়ে। তোকে খুঁজছে তো।

আমি বিছানা থেকে উঠে হাতমুখ ধুতে গেলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সেলিনা মওলা (Selina Moula)
সেলিনা মওলা
ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান ll

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য