উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২), অনুরণন (পর্ব-০৩), অনুরণন (পর্ব-০৪), অনুরণন (পর্ব-০৫), অনুরণন (পর্ব-০৬)
উত্তরায়ণ
প্রায় দুমাসের মত হলো, মহুয়া আমেরিকায় চলে গেছে। মহুয়ার মা তাকে নিয়ে গেছেন। তার যাবার একদম ইচ্ছা ছিলনা। মা কিংবা বাবার প্রতি মহুয়া কখনও কোনো আকর্ষণ অনুভব করে নাই। কিন্তু ফুপ্পিকে ছাড়া সে নিজেকে ভাবতেই পারেনা। ফুপ্পিকে ছাড়া তার অস্তিত্ব অর্থহীন। মহুয়ার বিশ্বাস, তার ফুপ্পি আসলে এঞ্জেল। তিনি পারেন না এমন কিছু এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে নাই। তিনি চায়লেই আকাশে চাঁদ উঠাতে পারেন। বাতাসে ফুলের সুগন্ধ বইয়ে দিতে পারেন। তাদের লনের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে ফুল ফোটাতে পারেন। একবার এমনও হয়েছে, মহুয়া গরমে ছটফট করছে। এসির বন্ধ ঘরে তার আর ভাল্লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে লনে ঘাসে খালি পায়ে খোলা হাওয়ায় হাঁটবে কিন্তু অসহনীয় গরমে সে লনে নামতেই পারছে না। চারদিকে লু হাওয়া বইছে। ফুপ্পি বললেন, লনে যাও সোনা , এখুনি বৃষ্টি নামবে। মহুয়া লনে গিয়ে একবার এদিক ওদিক করতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মহুয়ার বিশ্বাস, ফুপ্পি প্রখর রোদে তিনি চাইলেই বৃষ্টি নামাতে পারেন। মহুয়া যখন নির্ঘুম রাতে অনেকক্ষণ ঘরে বেলকুনীতে হাঁটাহাঁটির পর কিচেনে বরফ ঠান্ডা পানি খেতে নামে, তখনই কোথা থেকে যেন ফুপ্পি এসে বলেন, তোমার তো ঠান্ডা খাওয়া নিষেধ সোনা , টনসিল ফুলে যাবে। ফ্যারেঞ্জাইটিস, ল্যারেঞ্জাইটিস হবে। গলা বসে যাবে। কথা বলতে গেলে ভোকাল কর্ড ট্রমাটাইজড হবে। এই ট্রমা সারতে দীর্ঘদিন লাগে। কখনও আবার পুরোপুরি সারে না। ক্ষত থেকে যায়। কন্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়। এদিকে এসো, আমি তোমাকে আদর করে দিচ্ছি। তারপর এক্কেবারে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বে। আশ্চর্য, এরকম কতশত বার হয়েছে! মহুয়া ফুপ্পির আদর নিয়ে বিছানায় গিয়েই বুঝেছে তার চোখ ঘুমে জড়ায়ে আসছে। এক মুহুর্তেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। মহুয়া বহুবার ভেবেছে, আচ্ছা, সব ডাক্তারই কী ফুপ্পির মত?
উঁহু, ফুপ্পি এঞ্জেল।
কিন্তু এরকম একটা বাজে ঘটনার পর তার মা আর তাকে বাংলাদেশে রাখতে চান নি। মহুয়ার ফুপ্পিই ফোনে মহুয়ার মাকে ঘটনার বিবরণ জানিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেকের মাথায় মহুয়ার মা বাংলাদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর সবধরণের ফর্মালিটি কমপ্লিট করে মাস দুয়েকের মাথায় মহুয়াকে সাথে নিয়ে আমেরিকা ফিরে গেলেন । আমেরিকার কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। মহুয়ার ধারণা, তার মা শেক্সপীয়ারের ডেসডেমিনো।
আমি অধির আগ্রহে জিগেস করেছিলাম, আর ওথেলো? ওথেলো কি তোর বাবা?
মহুয়া বলেছিল, নাহ, শেক্সপীয়ার নিজেই।
শেক্সপীয়ারে মা যতই এডিক্ট হয়ে পড়েন, ততই শেক্সপীয়ার মায়ের মনজগতকে কমপ্লিকেটেড করে তোলেন। একপর্যায়ে মা আমেরিকায় চলে যান পিএইচডি করতে। আর বাবা ঢুকে যান লাইব্রেরীতে। বাবা আসলে ওথেলোর কোনো চরিত্র নন। বাবা আসলে কোনো চরিত্রই নন।
বাবা শুধু কবি,,,
“দ্য ট্রাজেডি অব ওথেলো” নাটকটির বাংলা অনুবাদ আমি পড়েছি। মঞ্চেও নাটকটি দেখেছি। ওথেলোর ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা তারিক আনাম ও ডেসডেমোনো হয়েছিলেন তারানা হালিম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বড়দের আলোচনায় বুঝেছিলাম, ঈর্ষা একজন হৃদয়বান ব্যক্তিকে কতখানি নিকৃষ্টতম কার্যকলাপে জড়িয়ে ফেলতে পারে, ওথেলো তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কিন্তু শেক্সপীয়ার কিভাবে নিজেই ওথেলো হয়ে গেলেন? মহুয়ার মাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছিলেন বলে? কিন্তু এই গ্রাস তো ভালবাসার গ্রাস, ঈর্ষার নয়। ভালবাসাও যে খুন করতে সক্ষম তা কি এ বিশ্বে কেউ জানেনা? ভালবাসা কেবল মানুষে মানুষেই হয়? ৪০/৪২ বছরের পুরোনো ঘরর ঘরর শব্দে থেমে থেমে ঘোরা প্রায় নষ্ট একটি মিল্লাত ফ্যান কিংবা ১৯৩৭ সালের প্রথম সংস্করণ একটি ছেঁড়া কবিতার বইয়ের সাথে জন্মজন্মাতরের নিরব ভালবাসার অলিখিত, অবিচ্ছিন্ন বন্ধনও রচিত হতে পারে।
আমেরিকায় যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরেও মহুয়ার বিশ্বাস ছিল, কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাবে আর শেষ পর্যন্ত তার মা ফুপ্পিকে বলবেন, মহুয়া আপনার কাছেই থাকুক। পৃথিবীতে একমাত্র আপনাকেই সে ভালবাসে। কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্তও এমন কিছুই ঘটলো না। মহুয়ার তখন ধারণা হলো, ফুপ্পিও তাকে ভালবাসেনা। ভালবাসলে তো নিশ্চয়ই এমন ঘটনাই ঘটতো।
এসব কথা ড্যানি আমাকে বলেছে।
মহুয়ার আমেরিকা যাবার সবদোষ মহুয়া আমাকে দেয়। কারণ, আমি অমন না করলে এখনও সে বাংলাদেশেই থাকতো। কলেজে সপ্তাহখানেক পরেই মহুয়ার সাথে দেখা। এদ্দিন সে কলেজে আসেই নাই। আমি প্রায় দৌঁড়ে গিয়ে তাকে টেনে ধরলাম। ঝটকা দিয়ে মহুয়া হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাগতঃ দৃষ্টিতে মুখ ইস্পাত কঠিন করে হিসহিসিয়ে বললো,
আই হেইট ইউ–
আই হেইট ইউ ব্ল্যাডি বাস্টার্ড্স।।
গেট লস্ট,,,
মুখহাত ধুয়ে, উপরে উপরে এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়ে নিয়েছি। কারণ দুই বেণী করা চুল এখন আঁচড়াতে বসলে রাত পার হয়ে যাবে। তারপর নিচে নামলাম। ততক্ষণে মন দুয়েক মিষ্টি কিনে এনেছে ছোট ভাইজান। আমাকে দেখে খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে জিগেস করলো , কি রে, তুই এতক্ষণে নামছিস?
আমি উত্তর না দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে ভাইয়াকে সালাম দিলাম। আপা ভাইয়া তখন ঘর আলো করে পাশাপাশি বসে আছেন। ইশ, আপাকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! কলাপাতা রঙের একটা সুতির শাড়ি পরেছে আপা যার পাড় রক্তলাল। কপালে একটি লাল টিপ। চোখে কাজল হালকা টেনে দিয়েছে। কানে জরোয়া ঝুমকো দুল। গলায় একটি লম্বা সোনার চেইন। সেখানে হার্ট শেপের সোনালী পাথর বসানো বেশ বড় একটি লকেট। গোল গোল হাতে লাল রেশমি চুড়ির সাথে দুগাছা করে সোনার চুড়ি। সবচেয়ে সুন্দর অনামিকায় হোয়াইট ও হলুদ সোনার উপর হিরে বসানো আংটিটি। আংটিটি সম্ভবতঃ ভাইয়া পরিয়ে দিয়েছেন। চুলে একটি বেণী করা আর বেণীটি বাঁ দিকের বুকের উপর ঝুলে কোমড় ছাড়িয়ে কোলে দলা হয়ে বসেছে। কপালে, গালে উড়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো আর ডান কান বরাবর ক্লিপে আটকানো কয়েকটি দোলনচাঁপাতে আপাকে রবীঠাকুরের প্রেয়সীর মত দেখাচ্ছে । আপাকে দেখেই আমার মনে হলো–
একগুছি চুল বায়ু-উচ্ছ্বাসে কাঁপা
ললাটের ধারে থাকে যেন অশাসনে।
ডাহিন অলকে একটি দোলনচাঁপা
দুলিয়া উঠুক গ্রীবাভঙ্গির সনে।
বৈকালে গাঁথা যূথীমুকুলের মালা
কণ্ঠের তাপে ফুটিয়া উঠিবে সাঁঝে;
দূরে থাকিতেই গোপনগন্ধ-ঢালা
সুখসংবাদ মেলিবে হৃদয়মাঝে।
–নিমন্ত্রণ/রবীঠাকুর
আমার ধারণা, গহনাগুলো আপা বাসায় এসে পরে নিয়েছে। কারণ ভার্সিটিতে আপা কখনোই গহনা পরে যায়না। বড়জোর দু’কানে ছোট দুটি ইমিটেশনের টব।আর বাঁ হাতে হাতঘড়ি। দোলনচাঁপাও লন থেকে নিয়ে চুলে পরেছে। অথবা, হয়তো, ভাইয়া দিয়েছে,,,
এতো আনন্দ, উচ্ছ্বাস, আড়ম্বরের মধ্যেও আপার চোখের নিচে পড়া কালি চোখে পড়ে গেল। আপাকে অনেক অনেকদিন হলো ভাল করে দেখিনি। আপা শুঁকিয়েও গেছে। দীর্ঘদিন ধরে হয়তো আপা ঘুমোয় না। ঠিকমতো খায়না।নির্ঘুম রাত তার ভোরের অপেক্ষা করে। বেলকুনীতে হাঁটাহাঁটি করে। আর বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
আহারে আমার আপা, আহা আপা,,,
ভাইয়া মুখ নিচু করে বসে আছেন। আবার মুখ তুলছেনও। লজ্জামাখা, বিব্রত হাসি লেগেই আছে তার ঠোঁটে, চোখে মুখে। আমি সালাম দিতেই ভাইয়া যেন অকূলে কূল পেলেন। বললেন,এ, এদিকে, এইখানে আয় বুড়ি। এই এইখানে বস ছোট গিন্নি।
আমি ভাইয়ার কথা সম্পুর্ণ অগ্রাহ্য করে অন্যখানে বসলাম। জিগেস করলাম, কেমন আছেন ভাইয়া? তিনি খানিক বিব্রতবোধ করে মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ভাল রে বুড়ি, খুব ভাল। তুই কেমন?
বললাম, ভাল।
এরমধ্যে আপা উঠে এসে আহ্লাদে আমার একটি বেণী একটু টেনে বললো, কি রে, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলি না যে? আপার হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বেজে উঠলো। আমি মুগ্ধ হয়ে কান পেতে সেই রিনিঝিনি শুনছি। আপা আবারও আমার বেণীতে আরেকটু জোরে টান দিয়ে বললো, কি হলো? তোর ভাইয়াকে সালাম কর।
এবার আপার দিকে সরাসরি তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বললাম, বেণী ছাড়ো। সম্ভবতঃ তখন আমার দু’চোখ পারদের মত হীম শীতল ছিল। আপা আমার বেণী ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তখনও আপার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া আপাকে বললেন, আহ, রাখো তো। ওসব সালাম টালাম পরে করবে ছোট গিন্নি। আমি আপার দিক থেকে চোখ সরিয়ে এবার ভাইয়ার দিকে একইভাবে তাকালাম। শান্ত কন্ঠে বললাম, আমাকে এইসব বাজে নামগুলো ধরে ডাকবেন না। মা যে নামে ডাকেন সে নামেও ডাকবেন না। আমার একটি নিজস্ব নাম আছে। সেই নামে ডাকবেন।
ভাইয়া থতমত খেয়ে বোকার মত হেসে বললেন, আচ্ছা।
দরজার ওপাশ থেকে মা ডাক দিলেন,
মণি, ও মণি,,,
কোন “মণি”কে ডাকছেন বুঝতে পারলাম না। সাধারণত, দু’বোন একসাথে থাকলে বড় মণি, ছোট মণি বলে ডাকেন মা। বাবা অবশ্য যার যার নাম ধরেই ডাকেন।
ডাক শুনেও না শোনবার ভান করে বসে থাকলাম। হঠাৎ দেখি ঘরে মা বাবা ছোট ভাইজান সবাই চলে এসেছে। সম্ভবতঃ তাদের ভয় হয়েছিল আমি ভাইয়াকে বিব্রতকর কিছু বলবো। তাদের সন্দেহটা আসলে সত্য। আমি অপেক্ষা করছিলাম, আপা মায়ের ডাকে ওদিকটায় গেলে, মানে মায়ের কাছে বা নিজের ঘরে বাসর সাজানোর তদারকিতে গেলেই আমি ভাইয়াকে জিগেস করবো,
আপনার বাড়ির মানুষগুলো এতো অমানুষ কেন?
আপনি এতো অমানুষ কেন?
জিগেস করা হলো না। বাবা ঘরে ঢুকে ভাইয়াকে বললেন, বাবা, আমি কাজি সাহেবকে ফোন করে দিয়েছি । গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি খাতা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। কোর্ট ম্যারেজ ঠিক আছে। তবে, এভাবে বিয়েটা হয়ে গেলে আরও ভাল হয়। তোমার বন্ধুদের মধ্যে সাক্ষী পাওয়া যাবে তো? ভাইয়া বললো, ওরা এখুনি চলে আসবে। বাবা বললেন, গুড। ছোট ভাইজান ভাইয়ার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল। যদিও সে এতক্ষণ বাড়ির লাইটিং এর তদারকি করছিল। লাইটিং হচ্ছে মেইন রাস্তা থেকে শুরু করে বাড়িতে আসা পর্যন্ত। অর্থাৎ, পুরো গলি। লনের গাছগুলোও লাইটিং হচ্ছে। আহা, গাছেরা চাঁদের আলো আর গায়ে মাখতে পারবেনা। কৃত্রিম নিয়নেই আগামী সাতদিন তাদের তড়পাতে হবে।
আপার দুজন বান্ধবী এরই মধ্যে এসে পৌঁছে গেছে যারা বাসর সাজাচ্ছেন। আরও দুজন এসে ঘরে ঢুকলেন। ভাইয়ার দুজন বন্ধুও চলে এসেছেন। আরও কয়েকজন বন্ধু নাকি রওনা দিয়েছে। পৌঁছে গেল বলে। প্রতিবেশীদের কয়েকজন খালাম্মা, কিশোরী মেয়েরা ও ভাবিবৃন্দও হাজির। রান্নাঘরে বিরিয়ানি, রোষ্ট, মাংসের রেজালা, কাবাব, ফিরনি, জর্দা রান্না শুরু হয়ে গেছে। ওহ না, ভুল বললাম, রোষ্টের মুরগি জবাই দেয়া হয়ে গেছে। এখন ছেলা হচ্ছে। এদের কেউ কেউ গায়ে হলুদের আবদার করছে। কিশোরী মেয়েরা গানের সাথে ছাদে নাচতে চাচ্ছে। ঘুঙ্গুর নিয়ে তাদের দোঁড়ঝাপ চলছে। ছোট ভাইজানের হাজার হাজার বন্ধু দৌঁড়ে এসেছে। তাদের একদল বাজার করেছে, একদল লাইটিং তদারকি করছে, একদল সাউন্ডবক্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করছে, একদল গান ও মিউজিকের পসরা সাজাচ্ছে, একদল কিশোরী মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে দেখছে। একটি মেয়ে সাউন্ডবক্সয়ালা হাতুড়ে ইঞ্জিনিয়ারকে বললো,
ভাইয়া, “আজি ভাল করিয়া বাজাও গো দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে” এই গানটা আনেন। আমরা এই গানে নাচবো। আরেকটি মেয়ে বললো, আরেহ, আগে হলুদ বাটো, মেন্দি বাটো,, বাঁটো ফুলের মৌ, এই গানের সাথে নাচ হবে। আরেকটি মেয়ে বললো, উঁহু, আগে হবে, ও আমার রসিয়া বন্ধুরে, তুমি কেন কোমড়ের বিছা হইলা না, হি হি হি,,, আরেকজন বললো, তাহলে, চুমকি চলেছে একা পথেও হবে হি হি হি,,,
আমি বসার ঘর থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসব দেখতে দেখতে সিঁড়ি ধরে দোতলায় নিজের ঘরে চলে আসলাম। দরজা খুলতেই বেলকুনীর দিকে নজর পড়লো।
বেলকুনীটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে,,,
একদম হঠাৎই সুনসান গম্ভীর শোকবিহ্বল কবরস্থান বদলে যেন পুজোমন্ডপের আনন্দ উল্লাস ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো । হই হুল্লোড় , নাচগান, হাসাহাসি খুনসুটির কলকল্লোলে প্রাগৈতিহাসিক শবদেহগুলো জীবন্ত হয়ে নুপুরের ঝনাৎ ঝনাৎ আওয়াজে ঝংকার তুললো। নৃত্যের তাল লয় ছন্দ বাধভাঙা গাঙের ঢেউয়ে মুদ্রা বসাতে লাগলো।
বেলকুনীতে দাঁড়িয়ে লনে ছোটাছুটি করা ছেলেমেয়েদের আনন্দ উল্লাস দেখে বহুদিন পর আমি স্বাভাবিকভাবে হাসলাম। নিরবে হাসলাম। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। উফফ, চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে! ঠিক ডান দিকের আকাশে শুক্লাপক্ষের পঞ্চমীর চাঁদ। কারিগর যেন রূপোর থালা গড়তে গিয়ে গলানো রূপোর কোজাগরি জ্যোৎস্নায় উদাস হয়ে বিকল হয়ে গেছেন। গলে গলে পড়া জ্যোৎস্নার রূপসাগরে তলিয়ে গেছেন। রূপ বিহ্বল তাঁর অসাড় হাত শেষ পর্যন্ত রূপোর থালাটির সবটুকু কী গড়তে পারবে ? দ্বিধান্বিত কারিগর যে নিজেই নেশাতুরা । তাঁর শৈল্পিক আঙুলগুলোও গলে গলে পড়া জ্যোৎস্নার মাতাল সৌন্দর্য্যে থমকে গেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়, উদাস, নেশাতুরা, অসাড় আঙুল,,,
কীভাবে তারা আবারও সচল হবে?
“ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া
এমন ক’রে লাগে আজি আমার নয়নে॥
আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।
তোমরা যা বল তাই বল, আমার লাগেনা মনে,
আমার লাগেনা মনে “,,,
–রবীঠাকুর
আমি বেলকুনী থেকে ফিরে পড়ার টেবিলে বসলাম। এক কাপ চা হলে ভাল হতো। যদিও নিচে এক কাপ চা খেয়েছি। কিন্তু পড়তে বসার আগে এক কাপ না হলে পড়ায় কনসেন্ট্রেশন আসেনা। থাক, বাসায় এখন নানান কাজে সবাই ব্যস্ত। অনেকের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তাদের মনে হচ্ছে, তারা স্বপ্ন দেখছে। কেউ কেউ হাতে চিমটি কেটে দেখছে, স্বপ্ন না কি সত্য। যেমন পাড়ার পেট পাতলা খালাম্মা, যিনি একজনের কথা অন্যজনকে যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পাচার করে পেট খালি করেন , দুই সিজারে দুই লাখ টাকা খরচের গল্প হাত পা নেড়ে বারবার অভিনব কায়দায় বলা একজন ভাবি, আরেক ভাবিরও বিশ্বাস হচ্ছে না যিনি একই মর্মান্তিক কাহিনী সব আড্ডাতেই বলেন, যখন তাকে সিজারের জন্য অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হচ্ছিল তখন সেই ভাই ভয়ে পরপর দু’বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তবে স্থুলকায় ভদ্রমহিলা মিনুর মা খালাম্মা যখন বললেন, অলৌকিক বিষয় যে জামাই ফিরে এসেছে। নিজ পরিবারের সবাইকে ত্যাগ করে ফিরে এসেছে। ও বড় মণির মা, আমার তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। যদিও, সুখের স্বপ্ন আমি কখনো দেখি না তবুও তখন আমারও মনে হলো, স্বপ্ন দেখছি। কারণ, এই মহিলাটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করি। আপার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পরদিন যখন সবাই আপাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন এই মহিলা এক গ্লাস দুধ হাতে আমার ঘরে এসেছিলেন। তিনি একটিও কথা না বলে বিছানায় আমার পাশে বসে আমার মাথায় কিছুক্ষণ হাত রেখেছিলেন৷ আমার থেঁতলে যাওয়া কপালে কি যেন একটি মলম মাখিয়ে দিয়েছিলেন। সারা শরীর ভয়ঙ্কর ব্যথা। তিনি হালকাভাবে মাথাটা তুলে দুধের গ্লাসটি আলতো করে মুখে চেপে ধরেছিলেন। সেসময় তাঁর ব্যথিত দৃষ্টিতে চোখ পড়তেই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সবটুকু দুধ এক নিশ্বাসে খেয়ে নিয়েছিলাম । এরপর দুটো প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন। সেদিন অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছিলাম, কে ইনি?
এখনও মাঝেমধ্যে ভাবি, কে ইনি,,,