উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২), অনুরণন (পর্ব-০৩), অনুরণন (পর্ব-০৪), অনুরণন (পর্ব-০৫), অনুরণন (পর্ব-০৬), অনুরণন (পর্ব-০৭)
পরাস্ত নাবিক
সেলিনা মওলা
সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। সপ্তাহে দু’একদিন আমি কিছু সময়ের জন্য কলেজে যাই। গ্রুপ স্ট্যাডি করি, টেস্ট পেপার সলভ করি। বেশিরভাগ সময় ঘরে পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকি। একদিন কলেজের গ্রুপ স্ট্যাডি শেষ করে বেরিয়েছি, দেখি কলেজ গেটে ড্যানি দাঁড়িয়ে আছে। এর আগেও একদিন ড্যানি এসেছিল। সেদিন ড্যানিকে দেখে এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম। সে হয়তো অন্য কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। আর আমিতো তাদের অনেক ক্ষতি করেছি। ড্যানি কেন আমার সাথে দেখা করতে আসবে? কিন্তু সে আমার দিকেই এগিয়ে এসেছিল সেদিন। ওদিকে আমাকে বহন করা গাড়িটিও প্রায় একই সাথে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
ড্রাইভার কাকু গাড়ি থেকে মুখ বের করে বললো, ছোটআম্মা,উঠে পড়েন। এইখানে গাড়ি দাঁড়ায়ে রাখা যাবেনা। ড্রাইভার কাকুর কথা সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে সেদিন ড্যানিকে বলেছিলাম, একটা রিকশা নে তো। আমি আর ড্যানি লাফ দিয়ে রিকশায় উঠলাম। রিকশা চলতে শুরু করলো আর আমার গাড়ি রিকশার পেছনে পেছনে । অনেক কষ্টের মধ্যেও আমরা দুজনই লুটোপুটি করে হেসেছিলাম। উফফ, কতদিন পর প্রাণ খোলা হাসি হাসলাম! হাসতে হাসতে রিকশাওয়ালা ভাইকে বলেছিলাম, ব্রিটিশ কাউন্সিলে চলেন ভাইয়া। ব্রিটিশ কাউন্সিলের যেখানে আমি, ড্যান আর মহুয়া বসে আড্ডা দিতাম, লম্বা ঘাসগুলো ছিঁড়ে চিবোতাম সেখানে সেদিন আরেকদল আড্ডা দিচ্ছিল। সে দলেও দুটো মেয়ে একটি ছেলে। আমাদের কফিহাউসটা বেহাত হয়ে গেছে। অগত্যা সিঁড়ির একধারে বসেছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ড্যান আমাকে ছোট ছোট করে মহুয়ার কথা বলেছে। পিয়সীর কথা জিগেস করতে ড্যান বললো, তার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। ফোন করেছিল কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করে নাই। ততক্ষণে আমার গাল গড়িয়ে জল পড়ছে । ড্যান আমার হাত চেপে ধরে বেরিয়ে আসলো। ড্যানের দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না। ওভাবেই মুখ নিচু করে গাড়িতে উঠলাম।
আজ অবশ্য ড্যানিকে দেখে প্রায় দৌঁড়ে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, রিকশা ধর একটা।
ড্যান বললো, না রে, সময় নাই। আজ রাতের ফ্ল্যাইটেই অস্ট্রেলিয়া রওনা দেবো। ড্যাড কিছুতেই বুঝলো না আমাকে। তোকে শুধু এক নজর দেখতে এসেছিলাম। তোর জন্য মনটা অস্থির লাগছিল।
তারপর একটু চুপ থেকে জিগেস করলো,
আচ্ছা, তোকে চিঠি লেখা যাবে?
অস্ফুটে বললাম, নিশ্চয়ই লেখা যাবে ড্যান।
ফোনও করতে পারিস। তবে, অনেক খরচ হয়ে যাবে।
ড্যানি কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে অন্যমনস্কভাবে ফুটপাতের ধুলোনুড়ি জুতোর ডগা দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে একসময় বললো, যাই মণি।
উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কেবল ড্যানির এলোমেলো ভাবে হেঁটে চলে যাবার দিকে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম,,,
যে আমার মন ভাল করার প্রজেক্ট নিয়ে এসেছিল, মন ভাল করে দেবে বলে প্রমিজ করেছিল, সে আজ তার ব্যর্থতার পাহাড় পিঠে নিয়ে আমাকে কাঁদিয়ে টলতে টলতে ফিরে গেল—-
“ও মহাকাল,
ক্লান্তি কী নেই তোমার?
আর কত “সময়” দরকার?
নিদ্রাহীন রাত্রি, নির্জন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন কালো সকাল–
কিংবা কুয়াশায় আবছা একাকি বিষন্ন বিষাদ বিকাল?
পৃথিবীর হরেক রঙ আর প্রিয় কিছু স্পর্শ অধিক,
বাহুতে তাবিজ বেঁধে উত্তর সাগরে হারালো নাবিক”,,,
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। কী পরীক্ষা দিচ্ছি, কেমন দিচ্ছি জানিনা। আমাদের আটজনের একটি গ্রুপ ছিল। সবার মাধ্যমিকের রেজাল্ট মোটামুটি একই রকম। যদিও ওরা সাতজন আমাকে তেমন পছন্দ করতো না তবু পাশাপাশি রোল নম্বর থাকায় তাদের সাথে লেখাপড়া বিষয়ক সামান্য লেনদেন চলতো। আমাকে অপছন্দের বেশকিছু কারণ ছিল। মহুয়া, ড্যানি আর আমার ঘটনাটি আস্তে আস্তে সবাই জেনে গেছিল। এমনিতেই এক বছর অসুস্থ্যতার জন্য নষ্ট হয়েছে। কিভাবে,কেন অসুস্থ্য হয়ে গেছিলাম, এটাও সবাই কিছু কিছু জানে। এক বছর পর এক বছরের জুনিয়ারদের সাথে আবারও কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাস করছিলাম। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীরা আমাকে নিয়ে কানাঘুষো করতো। তখনও আমি সুস্থ্য হইনি। তবুও বুঝতাম। কিন্তু কি নিয়ে কানাঘুষো চলছে তা বুঝতাম না। এসব কথা মাকে বললে, মা বলতেন, ওসব নিয়ে ভেবো না। লেখাপড়ায় মন দাও। আমি সেভাবেই চলতাম। আপার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার খবরটাও কলেজে ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর বিয়ে ভাঙার কারণ যে আমি নিজে তাও কলেজের মেয়েরা জেনে গিয়েছিল। নামকরা কলেজ, সেখানে আমাদের পাড়ারও দুয়েকজন পড়তো। মুখরোচক কাহিনী। ছড়ানোই স্বাভাবিক।
আমি লেখাপড়ায় বেশ পিছিয়ে গিয়েছিলাম। একদিকে বিভিন্ন ঘটনা আরেকদিকে আমার বেপরোয়া চলাফেরা। লেখাপড়ায় বেশ পিছিয়ে থাকা আর সারাক্ষণ একটা অস্থির ভাব আমাকে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছিল। কোথাও নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি যেনো সীমাহীন শুণ্যে ভেসে ভেসে গন্তব্যহীন কোথাও যাত্রা করেছি। আমার দশদিকে কেবল শুণ্যতা আর শুণ্যতা। সর্বক্ষণ দুহাত বাড়িয়ে কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছি কিন্তু কোথাও কিছু নেই। সবকিছু মিলে আমি প্রচন্ড বিপর্যস্ত ছিলাম। আমার সাথিদের পাশে একটু বসতে পারাই তখন আমার জন্য বিশাল কিছু। কখনো তারা সে সুযোগ দিত কখনো দিত না। পুরো বেঞ্চ জুড়ে তারাই বসে অংক করতো কিংবা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি সলভ করতো। আমি কিছুক্ষণ গাছের মত দাঁড়িয়ে থেকে ক্যান্টিন থেকে একটা চেয়ার এনে তাদের ওখানে বসতাম। সময় অনেকটা চলে যাবার পর তাদের সঙ্গ ধরতে পারতাম।
পরীক্ষা চলছে পুরোদমে।
একটু অবাক হলাম সাথে ভয়ও পেলাম যখন অংক প্রথম পত্রের দিন সাতজনের একজন অনুপস্থিত হলো। পরের পরীক্ষাগুলোতে একে একে সাতজন অনুপস্থিত হওয়া শুরু করলো। আমি ভয়ঙ্কর ঘাবড়ে গেলাম এবং আমিও পরীক্ষা ড্রপ দিব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
দুর্ভাগ্যবশতঃ শেষ পর্যন্ত আমার ড্রপ দেয়া হলো না। ভাবলাম লাভ কি? আমি পরীক্ষা দিলেও যা না দিলেও তা। এজন্য পৃথিবীর কোনো লাভক্ষতি নাই। আমার নিজেরও কোনো লাভক্ষতি নেই। তাই যেমন তেমনভাবে পরীক্ষা শেষ করলাম৷
ভেতরে ভেতরে এতো ভেঙে পড়েছি তা বাসার কেউ জানেনা। কারণ, আমি কারো সাথে এসব আলোচনা করিনা। আমি অবশ্য কোনো কথা বা আলোচনাই করিনা। কারণ, এখানে আমার কোনো মুল্য নেই। এরা আমাকে ঘিরে যা করে তা আমার জন্য করেনা। তাদের সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য করে। সে সময়টায় বাসার সবাই গায়ে পড়ে আমার সাথে কথা বলা শুরু করেছে। কারণে অকারণে বিভিন্ন কথা বলে। তাদের ভাবটা এমন যে এ বাড়িতে আমাকে নিয়ে কখনোই কোনো অনাচার হয়নি। এরা কখনোই আমার মৃত্যু কামনা করেনি। আমি বেশিরভাগ সময় উত্তর দেইনা। মাঝেমধ্যে হু, হ্যাঁ, না ইত্যাদি দিয়ে পাশ কাটিয়ে আসি। এই বিষয়টা শুরু হয়েছে আপার বিয়ে থেকে। পরীক্ষা দিয়ে চলছি আবার এও ভাবছি, পরীক্ষায় ভালমন্দে আসলে আমার নিজস্ব কী লাভ বা ক্ষতি? কোনো ধরনের লাভক্ষতির হিসেব করতে আমি নারাজ।
পরীক্ষা শেষে মাকে বললাম, মা, গ্রামের বাড়ি যাব।
মা কি যেন ভেবে বললেন, না মণি, তোমার কোথাও যাওয়া হবেনা। আমি আর একটিও কথা না বলে পুরো তিনমাস নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলাম। সাথে অবশ্য পড়বার মত কিছু বই থাকতো। সিথেনে থাকতেন রবীঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ। গভীর রাতে নিকষ কালো অন্ধকার আকাশে যখন নীলাভ নক্ষত্রেরা তাদের শরীরের আগুন নিয়ে জ্বলে উঠতো তখন জীবনানন্দ দাশ আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন। কখনও বাহুতে তাবিজ বেঁধে দুর সমুদ্রের পার থেকে দিকভ্রান্ত বিভ্রান্ত কোনো নাবিক হয়ে, কখনও করুণ গাঙচিল , কখনো বা লাশকাটা ঘরের টেবিল থেকে উঠে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলতেন,
“যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;”
আমি তখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতাম ,,,
আষাঢ়ী আকাশে মেঘেদের অবিরাম ছোটাছুটি দেখতে দেখতে বেলকুনীতে দাঁড়িয়ে ঝোড়ো বৃষ্টিতে ভিজতাম। আষাঢ়ী বৃষ্টি বড় ছন্নছাড়া, বড় খেয়ালী। সে কোনো ছন্দের ধার ধারে না। তার কোনো বাঁধাধরা সুরও নেই। সে উন্মত্ত, মাতাল। ইচ্ছে হলো হুলুস্থুল বর্ষনে দিগ্বিদিক্ ভাসিয়ে দিল। ঝপাঝপ নেমে আসলো আমার বেলকুনীতে। সুঁচের মত বৃষ্টিবিদ্ধ করে দিল আমার মুখ ঠোঁট সর্বাঙ্গ। তারপর পাগলের মত দাপাতে থাকে পুরো বেলকুনী জুড়ে। দাপাদাপি দস্যিপনায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে লনের গাছগুলো, ডালপালাগুলো । গেট আর লনের মোট তিনটে লাইটের আলোকছটায় তাদের দাপাদাপি, মাতলামি,পাগলামি দেখে, স্বদর্পে তুমুল এলোমেলো ঝরে পড়া দেখে আমার বুক ধুকধুক করে ওঠে। এই মাতলামিতে আমিও সামিল হতে চাই। এই বৃষ্টিমদে আমি অবগাহন করতে চাই। এই আষাঢ়ী বৃষ্টিসোম আকন্ঠ পান করে আমিও মাতাল হতে চাই। তখন আমি ঘরের জানালা আটকাই না। আষাঢ়ী বৃষ্টিরা আমার বিছানা, বালিশ, কাঁথায় হুলুস্থুল দাপাতে থাকে। জানলার ধারে আমার পড়ার টেবিলের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ বইখাতাপত্রগুলো ভিজিয়ে দেয়, ভাসিয়ে দেয়। আমিও ভেসে যাই। আমার ঘরটা মুহুর্তেই অলকানন্দা হয়ে যায়। ছন্নছাড়া, হতচ্ছাড়া বৃষ্টিরা ভিজিয়ে দেয় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথের জটিল জটিল বইগুলোর ও খাতাগুলোর প্রতিটি পাতার উপরে, ধারে, নিচে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বাঁকা করে লিখে রাখা আমার আর্ত, বেদনার্ত অনুভূতির ছোটছোট প্রকাশ পংক্তিগুলো ,,,
আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকি–
“আজকে ভীষণ বৃষ্টি নামুক,
হুলুস্থুল বাদলা হাওয়া একলা মেয়ের খোঁপা খুলুক;
চার দেয়ালের একলা ঘরের কপাট ভাঙুক–
আজকে মেয়ে হুলুস্থুল বৃষ্টি ভিজুক।।
এক দৌঁড়ে পিচঢালা পথ,
ফুটপাত বা ভেজা রাজপথ–
ছেঁড়া স্যান্ডেল ছুঁড়ে ফেলে,
শরীর ভরা বৃষ্টি ঢেলে,
বৃষ্টি ভেজা একলা মেয়ে এলোমেলো একটু হাঁটুক।
ছন্নছাড়া আষাঢ় মাতাল মন ভিজিয়ে অট্টহাসুক।।
একলা মেয়ে একটুখানি তার একাকি স্বপ্নে ভাসুক।”
সেই বর্ষায় আমি গীতবিতানে আসক্ত হয়ে পড়লাম,,,
আজকাল কোনো কিছুতেই অবাক হই না। এই যেমন, সালমার আড়াই বছরের মেয়েটা পানিতে ডুবে মরে গেল আর সংবাদ পেয়ে সালমা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সম্ভবতঃ অজ্ঞানও হয়েছে কয়েকবার। মা তাড়াতাড়ি গাড়িতে করে ড্রাইভার কাকুকে দিয়ে তাকে ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দিলেন। সাথে দারোয়ান কাকুও গেলেন কারণ সালমাকে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি ঘর থেকে সালমার চিৎকার শুনে পাশ ফিরে সমরেশ মজুমদারের কালবেলায় ডুবে গেছি। সন্ধ্যায় যখন রূপার মা চা দিতে এসেছিল তখন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে-ই বলেছে এসব। রূপার মাকে একটু ধমক দিয়ে বলেছি, চুপ করো তো খালা আর এখান থেকে যাও। রাতে নিচে নেমে ডিনার করে নিজের ঘরে ফিরেছি। আবারও কালবেলা নিয়ে মগ্ন হয়ে গেছি। বাইরে তখন ভীষণ বৃষ্টি । সে রাতে আর ভিজতে মন চাইলো না। বেশ রাত হয়ে গেছে। একটু ঝিমুনি ধরে এসেছিল। ঝিমুনির মধ্যে দেখলাম, আমি বৃষ্টির মধ্যে সালমার কখনো না দেখা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে লনে হেঁটে বেড়াচ্ছি। মেয়েটি আনন্দে তার ছোট ছোট গোল গোল হাতে বৃষ্টির পানি মুঠো করে ধরছে আর খলবল করে হাসছে। তার কান্ড দেখে রূপার মা ভরা বৃষ্টিতে লনে নেমে আসলো। দু’হাতের আজলা ভরে বৃষ্টির পানি ধরে সালমার মেয়ের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর মেয়ে আরও জোরে জোরে খলবল করে হেসে উঠছে। হঠাৎ গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে নজর পড়লো। দেখি ভেঁজা শাড়ি গায়ে হাত পা অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সিঁড়িতে বসে সালমা হাউমাউ করে কাঁদছে।
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।
বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে রে,,,
হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম,,,
আমার উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট মাধ্যমিকের রেজাল্টের চেয়ে সামান্য বেশী ভাল হলো। ঘরে শুয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যগ্রন্থ “সাগর থেকে ফেরা” পড়ছিলাম। আপা দরজা খুলে ঢুকলো। খুব আহ্লাদ করে বললো, এমা, কী অবাক কান্ড! তুই শুয়ে আছিস?
গল্পের বই পড়ছিস! তোর ভাইয়া ফোন করেছে তোর রেজাল্ট শুনে, চল কথা বল গিয়ে।
তখন জানলাম আমার রেজাল্ট হয়েছে।
নিচে নেমে রিসিভার তুলে বললাম, হ্যালো
ভাইয়া বললো, কংগ্রাচ্যুলেশনস।
আমি বললাম, থ্যাংকস।
–তো কি গিফট দেয়া যায় বলো তো। কেমন গিফট পেলে তুমি খুব খুব খুশি হবে?
ভাবলাম, বলি, আপাকে এখনই নিয়ে যান। প্লিজ নিয়ে যান এখুনি। এটাই আমার জন্য আপনার দেয়া সবচেয়ে দামি গিফট হবে।
বলতে পারলাম না।
বললাম, কিছু লাগবে না। আমি এমনিতেই খুশি আছি। আপনি ভাল আছেন?
–হ্যাঁ, ভালই। খুব তাড়াতাড়িই আসছি। তোমার আপার কাগজপত্র এবার ঠিকঠাক করে ওকে নিয়ে আসবো।
বললাম, ও আচ্ছা।
এটুকু বলেই আপার দিকে রিসিভার এগিয়ে দিলাম। আপা সামান্য থতমত খেয়ে রিসিভার হাতে নিল। আমি আমার ঘরের দিকে রওনা দিলাম।
ছোট ভাইজান হঠাৎ কোত্থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে শূন্যে উঠিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নাচতে লাগলো। তার শোরগোল থামছেই না দেখে আমি ঝটকা দিয়ে নিজেকে তার কবল থেকে উদ্ধার করলাম৷ বাবাও অফিস থেকে চলে এসেছেন। আমি একদম বাবার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। কানে, মাথায় বেজে উঠলো সেই বাজে জঘন্য কথাগুলো।
–মরিস না কেন তুই,,,
আমি বাবাকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে সিঁড়ি দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার বইটা হাতে তুলে নিলাম।
শেষ পাতায় লিখলাম,
“আঁধারের মেয়ে চলে আরও ঘোর অন্ধকার শালবনে।
যেখানে জোনাকের আলো জ্বলে —
অসংখ্য নক্ষত্র যেন তারে বলে,
আমাদের ক্ষীণ আভায় কারে খোঁজো একা মনে মনে?
যেখানে চিতার আগুন ফুলকি দিয়ে ওঠে,
সেইখানে নিজদেহ দেখো নাই প্রতিবার?
শ্রাবণ মেঘের ফাঁকে, কার মুখ ফোটে ?
মাথায় মননে নিত্য কারা ফিরে আসে?
কারা করে ফিসফাস,কাদের চিৎকার?
কারে খোঁজো মৃত মনে, মৃত আত্মার—
বাসনা কামনা আর উড়ে চলা পাখির ডানা–
ওসব মিথ্যে স্বপ্ন, খেয়াল, ইচ্ছে, বেহায়াপনা।।”
বাসায় আবারও হইচই পড়ে গেল। মন মন মিষ্টি আনা হলো। পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনদের খুঁজে খুঁজে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। ছোট ভাইজান ঠিক করেছে, নেক্সট শুক্রবার লনে ছোটখাটো একটি পার্টি করবে। আপা আহ্লাদি গলায় বলেছে, একবারে তোদের ভাইয়া আসলে পার্টিটা কর। বাবা তখন বলেছেন, না। জামাই আসলে এবার আমি রিসেপশন পার্টি দিব হোটেল পূর্বাণীতে। আর তখন ছোটখাটো পার্টির বন্দোবস্ত প্রতিরাতেই লনে করা হবে। একথা শুনে ছোট ভাইজান, “হুররে” বলে চিৎকার করে একটা লাফ দিয়েছে আর তাতে আপা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। সন্ধ্যায় চা দিতে এসে এসব কথা রূপার মা আমাকে নানারকম অভিনয় করে বলেছে। আজ আর রূপার মাকে ধমক দিলাম না। শুধু তার কথা শেষ হলে জিগেস করলাম, সালমার খবর কিছু জানো খালা?
এক মুহুর্তেই রূপার মায়ের আনন্দঘন অবয়বখানি করুণ বিষাদে ভরে গেল। বললো, সামনের সপ্তাহে রমজান ভাই গিয়ে সালমাকে নিয়ে আসবে। তারপর একটু চুপ থেকে বললো, ছোটআম্মা, আপনি এতো ভাল কেন?
আমি চোখের জল লুকোতে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, আজ আমাকে একটু কফি দেয়া যাবে খালা? ব্ল্যাক কফি। দুধ চিনি ছাড়া। দেয়া যাবে?
রূপার মা ঘর থেকে এক লাফে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, আমি এক্ষণ লইয়া আইতাছি ছোটআম্মো। আমার সুনার চান ছোটআম্মা গো ছোটআম্মা …