উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২), অনুরণন (পর্ব-০৩), অনুরণন (পর্ব-০৪), অনুরণন (পর্ব-০৫), অনুরণন (পর্ব-০৬), অনুরণন (পর্ব-০৭), অনুরণন (পর্ব-০৮)
একফোটা বৃষ্টিজল
সেলিনা মওলা
হলের মত অনেক বড় একটি ঘর । হলটাতে তিনটা বড় বড় এসি চলে সবসময়ই। সেখানে তিনটি চৌবাচ্চা আছে । চৌবাচ্চাগুলোতে বেওয়ারিশ লাশ বিশেষ পানীয়তে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। লাশগুলো সংরক্ষনের জন্য ওই চৌবাচ্চাগুলোতে রাখবার আগে লাশগুলোকে আরও কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে কাঁটাছেঁড়ার উপযোগী করে তোলা হয়। পাঁচটি সিমেন্টের টেবিল আছে যেগুলোতে লাশ শুইয়ে রাখা হয়। নাহ, মর্গের কথা বলছি না, বলছি মেডিকেল কলেজের ডিসেকশন হলের কথা। মর্গের বিবরণ আরও ভয়াবহ। সেখানে বিভিন্ন রকমের অপমৃত্যুর বীভৎস, বিকৃত, অর্ধগলিত, পচাগলা লাশ মাটিতে চাটাইয়ের উপরে পড়ে থাকে। প্রথমবার পোস্টমর্টেম দেখতে গিয়ে জুরিসপুডেন্টের স্যার মর্গের কিছুদুর আগে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আমাদেরকে বলেছিলেন, যারা সহ্য করতে পারবে না, তারা চলে যাও। পোস্টমর্টেম দেখা সবার জন্য কমপোলসারি নয়। আমাদের মর্গটা কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভেতরে নয়। হাসপাতালের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ের ওধারে জঙ্গলের মত একটা জায়গা আছে। জঙ্গলের ভেতর একটি পোড়ো বাড়ির মতন আছে, ওটাই মর্গ। সেখানে যেতে হলে বড় রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলের মাটির রাস্তায় নামতে হয়। মুলতঃ মর্গের ওই এলাকা জুড়েই অনেকখানি অংশে লাশের পচা,বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে থাকতো। আমাদের দেখে মর্গের গোপালচন্দ্র ডোম টলতে টলতে এগিয়ে এসে দাঁতের বত্রিশপাটি বের করে একখান ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে স্যারকে বলেছিল,
–পাটখেতেরত্তে পুলিশ নিয়ে এসেছে, শিয়ালে পেট খেয়ে ফেলেছে।
গোপাল দাদা রাজশাহীর ভাষায় কথা বলে। তার গলার স্বর অদ্ভুত রকমের চিকন। তাকে না দেখে হঠাৎ তার কন্ঠস্বর শুনলে মনে হবে কোনো নারীর সুরালো কন্ঠস্বর। অথচ লোকটি যথেষ্ট তাগড়া। চুল ঢেউ খেলে কাঁধ থেকে নেমে পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে। চোখদুটো মুখের তুলনায় খুব ছোট ছোট যেগুলো কোটরে ঢুকানো কিন্তু অদ্ভুতরকমের জ্বলজ্বলে। যেন তার দৃষ্টি চোখের কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়ছে। তার চোখের দিকে তাকালেই একটি ভুতুড়ে ভাব অনুভূত হতে বাধ্য। তবে কিছুক্ষণ সাহস করে তাকিয়ে থাকলে বুঝা যাবে তার ওই তীক্ষ্ণ, জ্বলজ্বলে, ভুতুড়ে দৃষ্টি অসম্ভব রকম নিরাসক্ত। সে মোটামুটি স্বাস্থ্যবান, পেটানো শারীরিক গঠন যাকে বলে। স্বাস্থ্যবান হলেও তার গাল দুটো ভেঙ্গে মুখগহ্বরের ভেতরে ঢুকে গেছে। উপরের পাটির দাঁত বেশ উঁচু। অথচ নিচের পাটির দাঁতগুলো একদম মুখের ভেতরের দিকে। এজন্যে সে স্বাভাবিকভাবে হাসলেও তার উপরের সবগুলো দাঁত মুখের বাইরে ঝুলে পড়ে। না হাসলেও উপরের সারির সামনের দাঁত কিছুটা বেরিয়ে থাকে। হাতের কব্জিতে লাল সুতোর সাথে আরও বিভিন্ন রঙের কিছু সুতো বাঁধা। পায়ে একটি রাবারের পুরোনো, খানিক ছেঁড়া স্যান্ডেল। গোপাল দাদার পরনে একটি ধুসর রঙের বহু পুরাতন শার্ট আর ময়লাটে সাদা ধুতি। ধুতির সাদা রঙ বিলুপ্তপ্রায়। শার্টটির আসল রঙ আসলে বুঝা যাচ্ছেনা। গলায় মেটে রঙের কেমন যেন পুঁতির মালা যা তার গলাটিকে,গলার শিরা, পেশিগুলোকে খাঁমচে ধরে আছে। একটি নতুন ঝকঝকে লাল সবুজ হলুদের চেক গামছা গলায় ঝুলছে । গপী দাদার গায়ের রঙ হয়তো কোনো একসময় গৌরবর্ণ ছিল যা এখন পুড়ে এক ধরনের পরাবাস্তব অপার্থিব তামাটে রঙ ধারণ করেছে। তাকে দেখলে হারিয়ে যাওয়া গ্রীক মিশরীয় সভ্যতার ক্ষয়ে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত অথচ পেশিবহুল দেহের কোনো ক্রিতদাসের ভাস্কর্য বলে মনে হয়। আমাদের দুয়েকজন ছেলে ও আমি বাদে বাকি সব মেয়ে পিছু হটে গেলেও আমরা কয়েকজন স্যারের সাথে মর্গে ঢুকলাম। প্রথমেই নজরে পড়লো, বিছানার ময়লা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা থেঁতলে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মাথায় ও দুচোখে সেলাই দেয়া একটি লাশ। গোপাল দাদা এক গাল হেসে জড়ানো কন্ঠে সাবলীলভাবে বললো,
–এটার মাথার উপর দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে গিয়েছিল। মগজ সব রাস্তাতেই ছিটকে পড়েছিল। চোখটোখ কিছুই ছিলনা। পোস্ট মর্টেমের পর ভিতরে তুলাগজ দিয়ে সেলাই করে দিয়েছি।
আরও দুটো লাশ দেখলাম যাদের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পুলিশি ছাড় পেলে আত্মীয়স্বজন নিয়ে যাবে। আত্মীয়স্বজন কেউ না থাকলে পুলিশি তদারকে দেহ সৎকার করা হবে।
বাড়িটা পুরোনো হলেও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই নিঃখুত।জানালা দরজাগুলো যথেষ্ট মজবুত। আর যেটি লক্ষনীয় তা হলো এই বড় কামড়াটির আটটি জানালা। ওগুলো খুলে দিলে ঘর আলোয় ভরে যায়। মৃতলোকের গুঢ় অন্ধকার রাজ্যকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা আর কি।
মুলকথা, পোস্টমর্টেম রুমে নাকি পর্যাপ্ত সুর্য্যের আলো থাকা প্রয়োজন। চেড়া বুক এরাও তো আরেকটু চিড়ে দেখবে। চিড়ে চিড়ে খুঁজবে কোথায় কোথায় আরও কত কত কষ্ট জমিয়ে রেখেছে,,,
একপাশের জানালার দিকে দেখলাম, মেঝেতে চাটাইয়ের উপরে শোয়া একজন প্রৌঢ়, যাকে কুপিয়ে খুন করে পাটখেতে ফেলে গেছিল খুনি বা খুনিরা। লাশের মাজার একদিক থেকে শুরু করে পেটের নাড়িসহ বেশ কিছুটা অংশ নাই। গোপাল দাদা একইরকমভাবে হেসে বললো, -শিয়ালে খেয়ে ফেলেছে দিদি।
লাশের একটি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে। অন্য চোখটি নাই। সেদিকের কান,গাল, ঠোঁটও নাই। গলার দিকটাও খাবলে খেয়েছে। লোকটির গায়ে একটি ময়লা কর্দমাক্ত ভেজা রক্তাক্ত ছেঁড়া শার্ট। সম্ভবতঃ শার্টের রঙ সাদা ছিল। উঁহু, আসলে শার্টের রঙ বুঝাই যাচ্ছিল না। নিম্নাঙ্গ একটি লুঙ্গী দিয়ে ঢাকা। পায়ের উরুগুলোও কামড়ে খেয়েছে শেয়াল। যতটুকু বাকি আছে সেখানে কোপের চিহ্ন। এক কাঁধের এক পাশে, বুকেও কোপানোর চিহ্ন। লোকটির সারাদেহে দলা দলা রক্ত। পুরো শরীর শুকনো রক্তে মাখামাখি। গায়ে লেপ্টে থাকা কাদামাটিতেও লাল রক্ত। গোপাল দাদা চাপাতির মত ধারালো কিছু অস্ত্র নিয়ে তার উপরের মাড়ির দাঁতগুলো ঝুলিয়ে একগাল হেসে জড়ানো গলায় স্যারকে জিগেস করলো,
–শুরু করবো স্যার?
স্যার বললেন, না, আগে উপরের সবকিছু দেখি, ছাত্রদের পড়াই তারপর শুরু করো।
আচ্ছা গোপাল, আজকাল কী বেশী বেশী খাচ্ছো?
স্যারের প্রশ্নের উত্তরে গোপাল দাদা লজ্জিত হয়ে মুখ নিচু করে ফেললো।
মর্গের অবস্থা দেখে আরও কয়েকটি ছেলে ছিটকে বেরিয়ে গেল। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখছি। আমার কাছে এসব তো আর নতুন কিছু নয়। এরকম বীভৎস, রক্তাক্ত লাশ আমি আগেও দেখেছি। খুব কাছ থেকেই দেখেছি। সে সময়গুলোতে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য হলেও এইসব বীভৎস বোধের থেকে অন্য এক অবোধ জগতে চলে যেতাম। এখন আর অজ্ঞান হইনা। বাস্তবের মুখোমুখি হই। অবাকও হই না।
এখন আমি অজ্ঞান হওয়ার মত স্নায়ুবিক কাপুরুষতাকে ঘৃণা করি।
স্যার আমাকে জিগেস করলেন, ঠিক আছিস তো?
আমি বললাম, জ্বী স্যার।
স্যার একটি বেতের ছড়ি নিয়ে লাশটির উপরের বিভিন্ন জায়গা দেখাচ্ছেন আর পড়াচ্ছেন। গপী দাদা আগেই লাশটির শার্ট লুঙ্গী খুলে ফেলেছিলেন। স্যারের আদেশে উল্টে পাল্টে দিচ্ছিলেন যেন দৃশ্যতঃ সকল আঘাত নজরে আসে। সব আঘাত ও আঘাতের সব ধরনের বিবরণ স্যার একটি খাতায় টুকে নিচ্ছিলেন। উপরের সবকিছু পড়ানো হলে স্যার গপী দাদাকে ইশারা করলেন। তখন গপী দাদা চাপাতির মত ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে একটানে লাশের বুকটা চিরে ফেললো। আর আমি “ও মাগো ” বলে দুহাতে চোখমুখ ঢেকে ফেললাম। হাতে থাকা খাতা কলম মেঝেতে পড়ে গেল। কলম মেঝেতে পড়ে যাওয়ার ঝনঝন তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘরের সুনসান নিরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল।আমার ফাউন্টেন পেনটা গড়াতে গড়াতে লাশটির চেরা বুকের একপাশে ঠেকে স্থির হলো। সহস্র শতাব্দির পেছন থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠলো,,,
এটা অবশ্য মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ঘটনা ।
মেডিকেলের দ্বিতীয় দিনেই আমাদের ব্যচে ভাগ করে ডিসেকশন হলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সি ব্যাচে পড়লাম। ডিসেকশন হলে লাশের কোনো গন্ধই নাই। যা আছে তা ফরমালিন আর বিভিন্ন মেডিসিন যেগুলো লাশ সংরক্ষনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেসবের গন্ধ। এতো বিদ্ঘুটে বাজে গন্ধ আমি জীবনেও কোথাও পাইনি। মাঝেমধ্যে হাসপাতাল ক্লিনিকে গিয়েছি, সেখানকার আলাদা গন্ধ, মেডিসিন মেডিসিন গন্ধ। তবে এই গন্ধের সাথে সেই গন্ধের বিন্দুমাত্র মিল নাই। ডিসেকশন হলের গন্ধের সাথে পৃথিবীর কোনো গন্ধের মিল নাই।এই গন্ধের অভিজ্ঞতা নিতে হলে এনাটমির ডিসেকশন হলেই যেতে হবে।এমনকি, এনাটমি ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলে পুরো কলেজে এই গন্ধ নাই। পাশেই আমাদের হাসপাতাল, সেখানে অন্যরকম গন্ধ থাকলেও এই গন্ধ নাই।
আমরা ডিসেকশন হলে ঢুকলাম। ডেমোনেস্ট্রেটর স্যাররা যার যার ব্যচকে নিজেদের জায়গায় নিয়ে গেলেন। আমাদের জায়গায় পাশেই টেবিলে একটি পুরুষ লাশ শুইয়ে রাখা হয়েছে। একটু দুরে আরেকটি টেবিলে একটি যুবতী মেয়ের লাশ। পুরুষ লাশটি একজন মধ্যবয়স্ক লোকের। আসলে এখানকার লাশগুলোর বয়স আন্দাজ করা কঠিন। আমি দেখলাম, এই লাশগুলোকে ঠিক লাশ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মানুষের ডামি। এদের গায়ের রঙ বুঝা যাচ্ছে না। মেয়ে লাশটি একটু কম কালো হলেও পুরুষ লাশটি একদম কুচকুচে কালো। আমরা একদিকে রাখা চেয়ারগুলোতে বসলাম আর আমাদের স্যার সামনে টেবিলের ওপাশে একটি চেয়ারে বসলেন। পাশে একটি ব্ল্যাকবোর্ড। স্যার প্রথমেই বললেন, এই লাশগুলো বেওয়ারিশ। তবে এদের এখানে এনেই ডিসেকশন হলে ঢুকানো হয়না। পাশের একটি রুম আছে, সেখানে একটি মেশিন আর বিভিন্ন মেডিসিন আছে। ওখানে লাশগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়। এই পদ্ধতিগুলো প্রায় দু আড়াই মাস ধরে চলে তারপর ডিসেকশনের উপযোগী হয়। এসব নিয়ে আমাদের সাথে মুল কাজগুলো করে মতিলাল। মানে এনাটমি ডিপার্টমেন্টের ডোম সে। উপযোগী হবার পর ওইযে হাউসগুলো দেখছো, ওখানে ফরমালিন মেশানো পানিতে সংরক্ষণ করা হয়। তবে ফরমালিনের সাথে আরও কিছু মেডিসিনও দেয়া লাগে।
দুতিন দিন পর থেকেই শুরু হলো আমাদের লাশকাটা অধ্যায়।
ডিসেকশন হলে আমরা মানে ব্যাচ সি, টেবিলের উপরে ঝুঁকে আছি। অন্যান্য ব্যাচও একই কাজে ব্যস্ত। কারণ, সামনে ফার্স্ট প্রফেশনাল বোর্ড পরীক্ষা। নাইফ, সিজার, ফরসেপ আর আমাদের ব্যাচের একটি ছেলেকে নিয়ে স্যার লাশের ডিসেকশন করছেন আর পড়াচ্ছেন। তখন আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ। চার/পাঁচমাস পরেই ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষা। মেডিকেলের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রির চাপে আমাদের চেহারা পালটে গেছে। আমার ওজন নেমে এসেছে চল্লিশ/ঊনচল্লিশ কেজিতে। এনাটমির শিক্ষকগন বলতেন, ডিসফিগারেশন, ডিসকালারেশন এন্ড সিভিয়ার ওয়েট লস না হলে কেউ ফার্স্ট প্রফ পাশ করতে পারেনা।
প্রথম প্রথম ডিসেকশন হল থেকে হোস্টেলে ফিরে তিতপল্লার খোসায় সাবান লাগিয়ে কমপক্ষে আধাঘন্টা কনুই পর্যন্ত হাত ঘষতাম। এমনও হয়েছে, ঘষতে ঘষতে হাতের চামড়া তুলে ফেলেছি তাও ওই গন্ধ যায়না। চামচ দিয়ে ভাত খেতে গিয়েছি তাতেও চামচ যখন মুখের কাছে নিয়েছি তখনই ওই গন্ধ। বমি করে দিয়েছি। গত দেড় বছরে পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটেছে যে এখন কোনো রকমে হাত ধুয়েই ভাত মুখে দেই। ক্ষিদে পেটে গ্রোগাসে ভাত খাই হোস্টেলের বিরল প্রজাতির ডাল দিয়ে যার মধ্যে ডুবসাঁতার দিয়েও কেউ কখনো ডাল খুঁজে পায়নি।
কাঁটাছেঁড়া লাশের শিরা উপশিরা মাসল টেন্ডন ও বিভিন্ন ভিসেরা ফরসেপ দিয়ে চিমটে চিমটে ধরে পড়াচ্ছেন স্যার, এমন সময় মতি ভাই এসে জোরে জোরে আমার ভাল নাম ধরে ডাকতে লাগলো। ডিসেকশন হলের পিনপতন স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আমার নাম দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে নিজের নামের প্রতিধ্বনি কান পেতে শুনতে লাগলাম। নারীদেহটির ছিন্নভিন্ন দেহের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, তাঁর ছেঁড়া দেহ থেকেও কী আমার নামটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে?
হলের সব লাশগুলো থেকেও কী প্রতিধ্বনি হচ্ছিল?
এই মেয়েটিও কী আমার নাম ধরে ডাকছিল?
স্যারের ডাকে আমার সম্বিত ফিরলো।
স্যার বললেন,
–মতি তোমাকে ডাকছে।
মতি ভাই আমাদের ডিসেকশন হলের সেই ডোম।
স্যার মতি ভাইকে একটু উঁচু গলায় জিগেস করলেন, কী হয়েছে মতি?
হলের সবাই তখন নিজেদের কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মতি ভাই বললো,
–প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে এই আপার ফোন এসেছে। স্যারে আপাকে রুমে যেতে বলেছে।
মতি ভাইও রাজশাহীর ভাষায় কথা বলে এবং সেও চব্বিশ ঘন্টা মদে ডুবে থাকে।
স্যার মতি ভাইকে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, যাচ্ছে।
স্যার ভেবেছিলেন খারাপ সংবাদ। তাই তিনিও আমার সাথে গেলেন।
প্রিন্সিপাল স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার হেসে বললেন, বসো। তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। তোমার বড় ভাই আমেরিকা থেকে এসেছেন তো তাই তোমাকে নিতে তোমার বাবা তোমাদের গাড়ি নিয়ে আসছেন। উনি রাতে রওনা দেবেন। ফেরিঘাটে জ্যামে না পড়লে ভোরেই পৌঁছে যাবেন। আমি তোমার বাবাকে ধরিয়ে দিচ্ছি। এটি বলেই তিনি ডায়াল করতে শুরু করলেন। আমার স্যার বললেন, যাক, আমিতো স্যার ঘাবড়ে গেছিলাম। তাই নিজেই ওকে নিয়ে আসলাম স্যার। আচ্ছা, তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলে ক্লাসে চলে এসো।
টেলিফোনের ওপাশে বাবা।
আমি হু হ্যাঁ বলে ফোন রেখে দিলাম।
প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে যেন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমি ডিসেকশন হলে ঢুকলাম। স্যার বললেন, একটা এপ্লিকেশন রেখে যেও। আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লাম। ক্লাশ শেষ হলে ডিসেকশন হল থেকে বেরোতে বেরোতে আড়াইটার মত বেজে গেল। ক্ষিদেয় মাথা ঘুরছে। উপর পেটে তীক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। তবুও আমি বান্ধবীদের সাথে হোস্টেলের দিকে না গিয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ালাম। হাসপাতাল এক্সচেঞ্জ থেকে এক্ষুনি একটি ফোন করা জরুরী। খুব জরুরী। সে আমলে এসটিডি লাইন খুব স্বল্প ছিল। শুধুমাত্র বড় বড় অফিসারদের অফিস রুমে ও বাসাতে ছিল। যেমন প্রিন্সিপাল স্যারের এসটিডি লাইন। হাসপাতাল সুপারের অফিস ও বাসায় এসটিডি লাইন। বাদবাকিদের জেলার বাইরে ফোন করতে হলে টাঙ্ককলই একমাত্র ভরসা।
নীতা, আমার বান্ধবী, মানে আমার ক্লাসমেট, সেও আমার সাথে যেতে চাইলো। তখন থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছে সে, এইতো খালুজানের সাথে কথা বললি ডাইরেক্ট , এখন আবার কোথায় ফোন করবি? কি হয়েছে তোর? এতো অস্থিরতা করছিস কেন? আবার পেট চেপে ধরছিস। মানে গ্যাস্ট্রিকের পেইন শুরু হয়ে গেছে। তুই এপ্রোনের পকেটে এন্টাসিড ট্যাবলেট রাখিস না কেন ? বলে নিজের পকেট থেকে একটি এন্টাসিড ট্যাবলেট বের করে খোসা ছাড়িয়ে ননটাচ টেকনিকে আমার মুখে ঢুকিয়ে দিল। ওর আসল ফন্দি , আমার সাথে এক্সচেঞ্জে যাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি ঘ্যানঘ্যানে আমার মাথাটা ফেটে চৌচির হবার দশা ততক্ষণে।
এই মেয়েটির অপরিসীম কৌতুহলে আমি দিশাহারা। সবসময় তার উপর ভীষণ বিরক্ত থাকি। আমি কেন টিভি দেখিনা, আমি কেন গভীর রাতে বেলকুনীর এপাশ ওপাশ একা হেঁটে বেড়াই, আমি কেন পার্টনারশীপে পড়ালেখা করিনা, মিলি আপা আসলে আমার কে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ের রহস্য উদ্ঘাটনে সে সর্বদা মুখিয়ে থাকে। আমি নীতাকে শান্তস্বরে কঠিন থেকে কঠিনতর ভঙ্গীতে বললাম,
–নাহ, তুই না, আমি একাই যাচ্ছি। তুই বরং রান্নাঘরের খালাকে একটু ভাত রাখতে বলিস।
আমাদের ডাইনিংএর এই বিখ্যাত ডাল পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পানীয়। গামলা ভরে যখন টেবিলে রাখা হয় তখন এই ডালকে “ইয়োলো সি” ও বলা যেতে পারে। শুধু পার্থক্য একটি মাত্র জায়গায়, তাহলো, সাগরে ডুব দিয়ে তাও মাঝেমধ্যে মুক্তো পাওয়া যায় কিন্তু এই ডালের গামলায় ডুব দিয়ে কখনো কেউ ডাল নামক বস্তুটি এক চিমটি তুলে আনতে পারেনি। অন্ততঃ ইতিহাস তাইই বলে। সেই ডালকেই আজকাল পঞ্চব্যঞ্জন মনে হয়। তা দিয়েই দুটো ভাত খেতে পারলে ব্যথাটা হয়তো কমতো। তারপর তো এন্টাসিড ট্যাবলেট আছেই।
এক্সচেঞ্জে মনির ভাইকে পেয়ে খুব স্বস্তি পেলাম। প্রায় দৌঁড়ে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ভাইয়া, একটা ট্রাঙ্ককল বুক দেন তো।
মনির ভাই আমাদের হাসপাতালের চারজন টেলিফোন অপারেটরের একজন। তারা রোস্টার ডিউটি করেন। অন্যরাও অনেক ভাল তবে মনির ভাইয়ের হাতে এবং কন্ঠে জাদু আছে। এমন ভাব নিয়ে অপর পাশের অপারেটরকে লাইন দিতে বলেন যেন মনে হয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রাশিয়ান প্রধানমন্ত্রীর সাথে পারমাণবিক উইপেন নিয়ে ভীষণ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবার জন্য অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। দশ মিনিটের মধ্যে লাইন না পেলেই দেরী হয়ে যাবে, ধমাধম পারমাণবিক বোম ফাটা শুরু হয়ে যাবে। এই মুহুর্তে এই দশটি মিনিট পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ও গুরুত্বপূর্ণ দশ মিনিট। এই দশ মিনিটের উপর নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। এই দশ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর দুই পরাশক্তির প্রধানদের মধ্যে আলাপ না হলে বিনা নোটিশে নিউক্লিয়ার বোম পটকার মত ফটাফট ফুটতে শুরু করবে। এই দশ মিনিট বিনা ফোনে, বিনা বাক্যালাপে পার হয়ে যাওয়া মানে পুরো বিশ্বময় পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ । এবং সর্বপ্রথম বোমাটি পড়বে অপর পাশের অপারেটরের মাথায়।
মনির ভাই গম্ভীরভাবে ইশারায় একটি চেয়ারে আমাকে বসতে বলে রিসিভার তুলে ডায়াল করা শুরু করলো।আমি একটি কাগজে নাম্বার লিখে তার সামনে দিলাম। তিনি অবাক হয়ে জিগেস করলেন,
–এটা কার নাম্বার?
বললাম, বাসার নাম্বার।
মনির ভাই আরও অবাক হলেন।
তার অবাক হবার কারণও আছে।
গত দেড় বছর আমি মাত্র একটি নাম্বারেই ট্রাঙ্ককল বুকিং দিয়ে কথা বলেছি। ওটা এই নাম্বার নয়।
ওটা মহুয়ার ফুপ্পির নাম্বার।
আমি আবারও অস্থিরভাবে মনির ভাইকে জিগেস করলাম, দেরী হবে ভাইয়া?
মনির ভাই তার গাম্ভীর্য্য পুরোপুরি বজিয়ে রেখেছেন। খুব সিরিয়াসভাবে বললেন, দশ মিনিট দেখি।
যেকথা কল বুকিং দেবার পর তিনি সবসময়ই বলেন।
দশ মিনিটের মধ্যেই ফোন এলো। মনির ভাই খুব গাম্ভীর্য্যের সাথে রিসিভ করে ততোধিক গাম্ভীর্য্যের সাথে ঢাকার নাম্বারে “জরুরি কল” বলে রিসিভার আমার হাতে দিলেন।
ওপাশ থেকে বড়ভাইজান ফোন তুলেছেন।
বড় ভাইজান আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবেগে কেঁদে দিলেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
— হ্যালো, হ্যালো, মণি, ও মণি, হ্যালো,,,
বাবা তো রাতেই রওনা দিচ্ছে তোকে আনতে। ব্যগ ট্যাগ গুছিয়ে ফেল এখুনি,,,
আমি শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কন্ঠে বললাম, আমি যাব না। বাবাকে রওনা দিতে মানা করো। নইলে এখানে খামকা একটা সিন ক্রিয়েট হবে।
এটুকু বলে অপর পাশের কথা শোনার অপেক্ষা না করেই আমি রিসিভার রেখে দিলাম।
মনির ভাই এবার অবাক হবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। বললেন, এতো জরুরী ফোন,,, গুরুত্বপূর্ণ,,, এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ?
আত্মতৃপ্তির একটি হাসি দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম,
–ধন্যবাদ মনির ভাই,,,
আজ আর এটমিক ওয়ার ঠেকাতে পারলো না মনির ভাই। বরং এই যুদ্ধের প্রথম বোমাটি নিজহাতে ফেলে যুদ্ধটি শুরুই করে দিলেন।
এক্সচেঞ্জ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের পেছনের গেটের দিকে যাচ্ছি। ওদিক দিয়ে হোস্টেল কাছে।
ভরা দৃষ্টিতে আজ সামনের দিকে তাকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটছি।
মনে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওই,
ওই শব্দগুলো ,,,
“আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!”
–বিদ্রোহী/কাজি নজরুল ইসলাম।
উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ফর্ম তুলছি। ঠিক মনে নেই, আমাদের সময় থেকেই সম্ভবতঃ ইউনিট পদ্ধতি চালু হয়েছিল। আমার কোনো সাথী নেই। ছোট ভাইজানের মাস্টার্স ফাইনাল চলছে । গাড়ি করে তাই আমি একাই যাচ্ছি ফর্ম তুলতে, জমা দিতে। একদিন অতর্কিতে সহেলির কাজিন মিথুন ভাইয়ার সাথে দেখা। সহেলী, আমার সেই সাত সাথীর একজন। একদিন পড়া শেষে সহেলীকে আজিমপুরে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছিলান। সেদিন গাড়ি থামতেই মিথুন ভাইয়া এগিয়ে এসেছিল। তখন সহেলী ভাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মিথুন ভাইয়া কার্জন হলে আমাকে আবিস্কার করলেন। যেন হীরের খনি খুঁজে পেয়েছেন। বললেন, কোথায় হারিয়ে গেলে? ওদিকে মামানী তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। এখনি চলো, বাসায় গিয়ে মামানীর সাথে দেখা করবে। বললাম, ভাইয়া, এসব কী বলছেন? খালাম্মা আমাকে কেন খুঁজবেন? মিথুন ভাইয়া ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গীতে বললো, জ্বী, আপনাকেই খুঁজছেন আপনার খালাম্মা। এবার কথা না প্যাঁচায়া চলো তো। আমার আর ক্লাস নাই।
অতঃপর, আমার গাড়িতে মিথুন ভাইয়া আর আমি কার্জনহল থেকে আজিমপুরের দিকে রওনা দিলাম।বুঝতে পারছিলাম, ড্রাইভার কাকুর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
মাঝে আরও কিছু বাজে ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। অবশ্য, বাজে ঘটনা না ঘটে ভাল ঘটনা ঘটলেই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হতো। আমিতো স্বপ্নেও ভাল ঘটনা দেখিনা। গাড়ি চলছে আর আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হরেকরকম গাড়ি রিকশা, হরেকরকম সওদা সাজিয়ে ফুটপাতে হরেকরকম ফেরিওয়ালা আর হরেকরকম মানুষ।চারদিকের কোটি কোটি মানুষজনের এই জাদুর শহরে আমি একা,,,
সেদিন আমি সত্যিই প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলাম । গাড়িতেই কখনো ফুপিয়ে কখনো শব্দ করে কাঁদছিলাম। ড্রাইভার কাকুও কেঁদে দিয়েছিল। বলেছিল , আর কাঁদেনা ছোটআম্মা। আপনের মাথা জ্বালা রোগ আছে। মাথার জ্বালা শুরু হয়ে যাবে। আর কাঁদেনা মাগো।
একটু চুপ থেকে কাকু বললো, আচ্ছা কাঁদেন গো আম্মা। কাঁদলে চক্ষের পানির সাথে দুঃখ কষ্ট বাইর হয়ে যায়। বুক হালকা হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। একেবারে শেষের দিন আমি প্র্যাক্টিক্যাল শেষ পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে সোজা সহেলীদের বাসায় গিয়েছিলাম। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হবার পর থেকে বাবা আর আমাকে দিতে আনতে যান না। শুধু ড্রাইভার কাকুই যায়। সহেলীর বাসাটা ড্রাইভার কাকুর চেনা ছিল। আমার ধারণা, উঁহু ধারণা নয় বিশ্বাস ছিল যে ওরা সাত জন পরীক্ষা ড্রপ না দিলে আমার চেয়েও ভাল রেজাল্ট করতো। কারণ, ওদের প্রস্তুতি আমার চেয়েও ভাল ছিল। ভয় পেয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। ইশ, পরীক্ষা চলাকালীন যদি জানতে পারতাম এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে একেকজন তাহলে বাসায় বাসায় যেতে না পারলেও অন্ততঃ টেলিফোনে ওদের বলতাম, প্লীজ, তোমরা পরীক্ষা ড্রপ দিওনা। তোমাদের প্রিপারেশন অনেক ভাল। সিরিয়াসলি অনেক ভাল। তোমাদের রেজাল্ট অনেক ভাল হবে।
সহেলীদের দরজায় কলিং বেল বাজাতে সহেলীর মা দরজা খুলেছিলেন। খালাম্মা, খালু, সহেলী আর সহেলীর ছোট ভাইয়ের গ্রুপ ছবি দেখিয়েছিল একদিন কলেজে। তাই খালাম্মাকে চিনতে অসুবিধা হলো না। সালাম দিয়ে জিগেস করলাম, সহেলী আছে খালাম্মা ? তিনি উত্তরে বললেন, তুমি সেই মেয়েটা না? যে মেয়েটাকে পুলিশ ধরে জেলে ভরেছিল?
আমি মুখ নিচু করে থাকলাম। খালাম্মা ততক্ষণে প্রায় চিৎকার করছেন। আসেপাশের ফ্ল্যাট গুলো থেকে দরজা খুলে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। উপরের লোকজন নেমে এসেছে। নিচের লোকজন উঠে এসেছে। খালাম্মা সমানে চিৎকার করে বলছেন, কোন দুঃসাহসে তুমি এখানে এসেছো? ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলে না? তোমার ভাই তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে রেপিষ্টের হাতে খুন হয়ে যাচ্ছিল না? তখন ওই বদমাশটার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বদমাশটাকেই খুন করতে হয়েছিল না তোমার ভাইকে ? এতো বড় নষ্ট মেয়ে তুমি! তোমার সাথে মিশেই আমার মেয়ে নষ্ট হয়েছে। তুমিই আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছো। এক্ষুনি এখান থেকে নামো নইলে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির নিচে ফেলো দেবো অসভ্য, শয়তান মেয়ে,,,,
ড্রাইভার কাকু আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনলো।
আমি কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠে বসেছিলাম সেদিন।
সারা শহরের কোটি কোটি মানুষ আমার দিকে চেয়ে বিকৃত, ধিক্কার আর ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। মনে হচ্ছে ওরা এখনই আমাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলবে।
চারদিক থেকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, রেপিষ্ট, বদমাশ, নষ্ট মেয়ে, ফষ্টিনষ্টি, রেপিষ্ট,,,
ওহ, ধরণী দ্বিধা হও, দ্বিধা হও প্লীজ,,,
হাসপাতাল এক্সচেঞ্জ থেকে কেমন যেন একটা সুখী সুখী অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মেডিকেল টার্ম এ এই অনুভূতিকে “ইউফোরিয়া” বলে। ক্ষিদেও নেই তখন। শুধু উপরের পেটে সরু, তীক্ষ্ণ একটি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে । কিছু খাওয়া দরকার এখনই। হোস্টেলে ঢুকে সরাসরি কিচেনে চলে গেলাম। সেখানে কেউ নাই। ডাইনিংও তালাবদ্ধ। যা ভেবেছিলাম। নীতা তাহলে খাবার রাখার কথা বলেই নাই রান্নাঘরের খালাদের। কিন্তু কী অদ্ভুত, নীতার উপরে এই মুহুর্তে আমার একটুও রাগ বা বিরক্তি আসলো না। আমি খুশী মনেই রুমে ফিরে গেলাম। রুমমেট আপাদের একজন, মিলি আপা বললো, আমারও আজ ফিরতে দেরী হয়ে গেছিল। নীতা তোর খাবার রেখে গেছে টেবিলে। হাত ধুয়ে খেয়ে নে।
কী আশ্চর্য, নীতা আমার খাবার রুমে রেখে গেছে!!! আর আমি কিনা তাকে নিয়ে এতোটা আজেবাজে কথা ভাবছিলাম!!! নিজের উপরে ভীষণ রাগ হলেও হাতের খাতা বই টেবিলের এক কোণায় ফেলে দৌঁড়ে হাত ধুতে গেলাম। হাত ধুচ্ছি আর সেদিনের কথা ভাবছি। যেদিন মিথুন ভাইয়া আমাকে সহেলীদের বাসায় প্রায় ধরেই নিয়ে গেল।
খালাম্মা আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেন। সহেলী আরেক পাশে বসা। সামনে সেন্ট্রাল টেবিলের উপরে বসে মিথুন ভাইয়া কেমন বিমর্ষ মুখে, ছলছল চোখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমি কাঁদছি আর খালাম্মা আমাকে তাঁর বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন। আর বলছেন, আর কেঁদো না সোনা, আর কাঁদেনা পাখি। আমি মিথুনের কাছে সব শুনেছি। আমার বড় অন্যায় হয়ে গেছে মা । বড় পাপ করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দে মা, মাফ দে,,,
এতক্ষণে মনে পড়লো, মিথুন ভাইয়াও তো একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। যদিও অনেক জুনিয়র মিথুন ভাইয়া। যেহেতু ডিপার্টমেন্টের চাঞ্চল্যকর মর্মান্তিক একটি ঘটনা সেহেতু পুরো ডিপার্টমেন্টের সবাই জেনেছে। একই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে মিথুন ভাইয়াও সবই জেনেছে। এমনকি, আউট সাইড অফ দ্য কোর্ট যে মিউচ্যুয়াল উইদ কমপেনসেশনে যাবার জন্য বাবা বারবার উকিল পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন মিথুন ভাইয়া তাও জানে।
সহেলীদের ড্রয়িং রুমে আমি আর মিথুন ভাইয়া একা মুখোমুখি বসে আছি। খালাম্মা আর সহেলী ডাইনিং টেবিলে খাবার দিচ্ছে। মিথুন ভাইয়া এসব বলছেন আর আমি চোখ বড় বড় করে শুনে যাচ্ছি। আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখে ঝাপসা দেখছি।
আচ্ছা, এদের বাসার ড্রয়িং রুমের ছাদটাও কী নিচে নেমে আসছে?
নইলে আমার কেন দম বন্ধ হয়ে আসছে?
মিথুন ভাইয়া লাফিয়ে উঠে এসে আমাকে ধরে ফেললো। আর “মামানী, সহেলী পানি আন” বলে জোরে জোরে ওদের ডাকতে লাগলো। খালাম্মা তাড়াতাড়ি পানি এনে আমার চোখেমুখে ছিটাতে লাগলেন। সহেলী একটি কুশনের উপর আমার মাথাটা নামিয়ে আমাকে শুইয়ে দিল,,,
ঠান্ডা ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। কেমন যেন আনন্দ বিষাদমাখা অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। দীর্ঘ কয়েকবছর পর একটু আগে এক্সচেঞ্জ থেকে ওই একটি টেলিফোন যেন আমার শুষ্ক মরুভূমিতে একফোটা বৃষ্টির জল। আনন্দে উচ্ছ্বাসে পাগলের মত আমি ওই বৃষ্টির ফোটাটিকে হাতড়ে খুঁজছি সারা গায়ে মেখে নেবো বলে।
একটু শীতল হতে চাই যে, একটু শীতল,,,
অথচ তপ্ত রোদেতাপে,আগুনমাখা ধু ধু বালুতে সে ফোটাটি এক নিমেষে শুকিয়ে গেল। লু হাওয়া আমাকে পোড়াতে লাগলো। আমি পুড়ছি, হাহাকার করছি, মরুভূমির তপ্ত বালুতে গড়াগড়ি দিয়ে বৃষ্টির সেই অমুল্য একটি ফোটা পাগলের খুঁজছি, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। বৃষ্টিজলহীন তপ্ত মরুভূমিতে ওই একফোটা বৃষ্টির জলই আমার এতবছরের অর্জন ছিল। আবারও সেখানে, সেই শুষ্ক, বৃষ্টিহীন রুক্ষ মরুতে, আবারও তৃষ্ণার্ত আমার চির হারিয়ে যাওয়া,,,
কী এক দ্বিধান্বিত অনুভূতি!!!
কী এক বিষন বিষাদ তৃপ্ত বিজয়,,,
মিলি আপা প্রায় ধমকে বললো, কি শুরু করেছিস তুই? খেতে বসে একবার হাসছিস আবার কিসব বলছিস বিড়বিড় করে!!!
খা ঠিকমতো। ফার্স্ট প্রফের আগে এসব সবারই হয়। খেয়ে একটু ঘুমা। তারপর ঘুম ভাঙলে আমি চা বানিয়ে দেবো।শিগগির খা।
আমি খেয়ে উঠে প্লেট ধুয়ে আহ্লাদের একখানা হাসি দিয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে থাকা মিলি আপার পেটের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে শুয়ে পড়লাম। জানি, এখনই বাকি দুজন রুমমেট আপারা ওই কথাগুলো বলবে। যেগুলো সবসময় বলে।
রুনু আপা বললো, দেখেন আহ্লাদির কান্ড। আচ্ছা মিলি আপা, এই আহ্লাদিকে কোত্থেকে কুড়িয়ে এনেছেন?
মিলি আপা আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, কমনরুমের এক চিপায় চৌকির উপর উপুড় হয়ে কাঁদছিল। সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছি,,,