Homeউপন্যাসঅনুরণন (পর্ব-১২)

অনুরণন (পর্ব-১২)

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ৷৷

(দৃষ্টির অগোচর যে ব্রহ্ম তা সর্বদাই পূর্ণ। আর নাম এবং রূপ নিয়ে যে ব্রহ্ম দৃষ্টিগ্রাহ্য, তাও পূর্ণ। দৃষ্টির অগোচর যে ব্রহ্ম সেটি ‘কারণ’; আর নামরূপাত্মক যে ব্রহ্ম সেটি ‘কার্য’। পূর্ণ থেকেই পূর্ণের উদ্ভব (অর্থাৎ, কারণ থেকেই কার্যের উদ্ভব)। কারণ-ব্রহ্ম যদি পূর্ণ হয় তো কার্য-ব্রহ্মও পূর্ণ। অন্যদিকে যদি দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্রহ্ম পূর্ণ— একথা স্বীকার করে নিই, তাহলে তাকে বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে, স্বীকার করতে হবে তাও পূর্ণ।)

ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

(উপনিষদ্)

বাবার সাথে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বাবা জিগেস করলেন, “কি খাবে?” বললাম, “পরোটা, ডিম ভাজি আর ডাল ভুনা।” বাবা অর্ডার দিলেন। আমরা খাওয়া শুরু করলাম। হোস্টেল থেকে বেরিয়েছি অনেকক্ষণ। কিন্তু এখনও বাবার সাথে আমার তেমন কোনো কথা হয়নি। খুব ভোরে নাজমুল ভাই যখন রুমের পাশে এসে এসে আস্তে আস্তে আমার নাম ধরে ডাকলো তখন আমার চোখের পাতা কেবল হালকা লেগে এসেছিল। মিলি আপা অনেক ভোরে উঠে পড়তে বসেছে। সে হকচকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নাজমুল ভাইকে উদ্বেগের সাথে জিগেস করলো, “কি, কি হয়েছে নাজমুল ভাই? এতো ভোরে মণিকে কেন ডাকছেন?” মিলি আপার গলা শুনে আমি ধীরে উঠে বসলাম। নাজমুল ভাই বললো, “মণি আপার আব্বা এসেছেন ঢাকা থেকে।” মিলি আপা আরো ভয় পেয়ে ভুরু কুঁচকে জিগেস করলো, “কেন, হঠাৎ? বাড়ির সবাই ভালো তো?” নাজমুল ভাই একগাল হেসে বললো, “আমিও ভয় পেইয়েছিলাম গো আপা। স্যার বললেন, এমনি মেয়েরে দেখতে এসেছেন।” আমি জানলার পর্দা ফাঁক করে একটু হেসে নাজমুল ভাইকে বললাম, “নাজমুল ভাই, বাবাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়েছেন তো ? আমি আসছি।”

ভোর ছয়টায় লেডিস হোস্টেলের মেইন গেইট খোলা হয়। প্রয়োজনে আগেও খোলা হয়। অনেকে, বাড়ি থেকে বাসে ট্রেনে করে রওনা দিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। তখন মেইন গেইট ধাক্কাধাক্কি করলে অথবা ক্যাম্পাসের নাইট গার্ড বাঁশিতে হুইসেল দিয়ে নাজমুল ভাইকে জোরে হাঁক দিলে সে এসে মেইন গেইট খুলে দেয়। একটা এসিস্ট্যান্ট আছে, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না, সে কুম্ভকর্ণের মত নাক ডেকে ঘুমোয়। কাজের সময় কখনোই তাকে পাওয়া যায়না। ভাব দেখায়, কাজের ঠেলায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত।

সেদিন ভোরে নিয়মমাফিক নাজমুল ভাই মেইন গেইট খুলেছে, দেখে একজন ভদ্রলোক বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে, ঘাসের সরু লনে হাঁটুমুড়ে বসে আছেন। নাজমুল ভাই অবাক হয়ে বললো, “আসসালামু আলাইকুম স্যার! আপনি এভাবে এখানে মাটিতে বসে আছেন কেন স্যার? গেইট একটু ধাক্কা দিলেই তো আমি উঠে যাই স্যার।”

বাবা লন থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হেসে বলেছেন, “কেমন আছেন নাজমুল সাহেব?

সমস্যা নাই। আমার মেয়েকে এতো ভোরে ডাকতে চাই নি। সে ভোরে উঠতে পারেনা। আর আমারও ততো তাড়া নাই।”

বাবাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে নাজমুল ভাই আমাকে ডাকতে এসেছেন। মিলি আপা আর আমার অন্য দুই রুমমেটের চোখে বিস্ময়।

হাতমুখ ধুয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিচে গেলাম। বাবা বললেন,

–কেমন আছো?

–ভাল। তুমি কেমন আছো?

–ভাল।

একটু পর বাবা বললেন, “নাস্তা করবে না?”

–হ্যাঁ, করবো।

–তাহলে চেইঞ্জ করে এসো। আমি ওয়েট করছি।

বাবা গাড়ি আনেননি, নাইট কোচে এসেছেন। বাবাকে খুব ক্লান্ত, ম্লান দেখাচ্ছে । আমার ভীষণ মায়া হলো। কিন্তু বাবাকে তো আসতেই হতো। অপরাধবোধের দহন ভয়ঙ্কর। পাঁজর পর্যন্ত পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে। বাবাও তেমনি পুড়ছেন। এই অন্তর্দহন থেকে তাঁকে কেউ মুক্ত করতে পারবে না। এমনকি আমিও না।

বাবা আর আমি সেদিন কিছুক্ষণ শহরে ঘুরলাম। শপিং করলাম৷ আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, বিস্কুট চানাচুর, চা পাতি ইত্যাদি কিনে দিয়ে বাবা বললেন, “লাঞ্চে কি খাবে? চায়নিজ খাবে?” বললাম, “হ্যাঁ।” আমরা একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার জন্য ঢুকলাম। লাঞ্চ করে আমরা হোস্টেলে ফিরে আসলাম। বাবা বললেন, “বিকেলের বাস ধরবো। একেবারে টিকিট করে এনেছি।” তারপর কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে বললেন, “আসি মা।” আমি বললাম, “আচ্ছা।”

হোস্টেলের সামনের সরু রাস্তাটা দিয়ে মেইন গেইটের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আমার বাবা। বাস ধরার জন্য চলে যাচ্ছেন তিনি। বেশ নুহ্যভাবে হাঁটছেন বাবা । খুব ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্তভাবে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন তিনি । যেনো শতশত শতাব্দী ধরে তপ্ত মরুভূমিতে হেঁটে চলেছেন। তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। মাথার আধ হাত উপরে জলন্ত পিন্ডের মত সুর্য্য। কোথাও একটি গাছও নেই যে যার ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেবেন তিনি। নাই তৃষ্ণার জল। বড় কষ্টে তিনি তাঁর দেহটিকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। আমি পেছন থেকে ব্যথিত দৃষ্টিতে বাবার চলে যাওয়া দেখছি। বাবা গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অব্দি তাকিয়ে থাকলাম । বাবার যাবার পথের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলাম। তারপর, ধীর শান্ত পায়ে হোস্টেলের রুমে ফিরে গেলাম।

মিলি আপা জিগেস করলো,

–খালু চলে গেছেন? এমন হঠাৎ আসলেন যে ? তোর বিয়ে নাকি? আমি বিছানায় বসে দু’পা দোলাতে দোলাতে খুবই আনন্দের সাথে বললাম,

–হ্যাঁ। কিন্তু ছোট্ট একটা ঝামেলা হয়েছে।

অন্য দুজন রুমমেট চোখ বড় বড় করে উৎকন্ঠার সাথে সমস্বরে জিগেস করলো,

–কি, কি ঝামেলা???

আমি মুখ ফুলিয়ে দুঃখ দুঃখ চেহারা নিয়ে তাদের দিকে তাকালাম। রুনা আপা বললো,

–বর ভেগেছে?

–হ্যাঁ।

আরেক রুমমেট বেনু আপা আতঙ্কিত হয়ে বললো,

–এখন তাহলে উপায়?

ভগ্ন হৃদয়ে, ব্যথিত কন্ঠে বললাম,

–উপায় নাই গোলাম হোসেন, বিয়েটা আর হচ্ছে না।

ভরদুপুরে চার রুমমেট হোস্টেল ফাটিয়ে কাঁপিয়ে হেসে উঠলাম।

আজ বাইরে থেকে ফিরে রুমমেটদের সাথে হাসাহাসির পর কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আজকেও মিলি আপা ডেকে তুলেছে, চা দিয়েছে। তারপর গম্ভীর মুখে জিগেস করেছে,

–খালু এসেছিলেন কেন? কিছু হয়েছে?

–কিছুই হয়নি মিলিপা। এমনি দেখতে এসেছেন।

–সত্যি বলছিস?

হেসে বললাম, “হ্যাঁ তো, দেখতে এসেছে। পড়ালেখার চাপ পড়েছে, শুকিয়ে গেছি, ডাইনিং এর খাওয়া, এইসব নিয়ে চিন্তা করছে হয়তো, তাই।”

মিলি আপা কি যেনো ভাবলো। তারপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললো,

–তুই এতো গাঢ় ঘুম ঘুমোচ্ছিস কেন?

–এমা, ঘুম পেলে ঘুমোবো না?

–না রে মণি, কিছু একটা হয়েছে তোর। কখনও তোকে এতো গাঢ় ঘুমোতে তো দেখিনি।

মনে মনে বললাম, হয়েছেই তো। আমার জন্মের আগেই হয়েছে। তারপর থেকে বিরতিহীনভাবে হয়েই আসছে। এন্ড আই থিঙ্ক, আরও হবে। আরও অনেক কিছু হবে।

মুখে বললাম, “মনে হয় প্রেশার ফল করছে খুব আজকাল। তাই এমন হচ্ছে।”

মিলি আপা তারপরও অবিশ্বাস ভরা দৃ‌ষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ম্লান হেসে বললাম,

“মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি

এই নিদ্রা?”

মিলি আপা তারপরও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। চোখে তার এক রাজ্য সন্দেহ।

চায়ে চুমুক দিয়ে গ্রেস এনাটমির পাতায়, পাতার উপরের, পাশের, নিচের ফাঁকা জায়গায় পেন্সিল দিয়ে বাঁকা বাঁকা করে লিখলাম,

“গায় তার ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ- অবসাদ সুখ

চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন-বিমুখ

প্রাণ তার–“

আমি বিষন্নভাবে পেন্সিল মুখে নিয়ে কামড়াচ্ছি। থমকে থাকছি। আবারও লিখছি,

“এরা প্রশ্ন করেনাকোঃ ইহারা সুন্দর শান্ত-

জীবনের উদ্‌যাপনে সন্দেহের হাত

ইহারা তোলে না কেউ আঁধারে আকাশে

ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।”

মনে মনে বিড়বিড় করছি,

“দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।

দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।

দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।”

আবারও পেন্সিল কামড়াচ্ছি। চোখদুটো ঘোলা হয়ে আসছে। ঘোলা ঘোলা চোখে লিখলাম,

“ভুলে যাব যেই সাধ- যে-সাহস এনেছিলো মানুষ কেবল

যাহা শুধু গ্লানি হলো- কৃপা হলো- নক্ষত্রের ঘৃণা হলো-

অন্য কোনো স্থল

পেল নাকো,,,”

–জীবনানন্দ দাশ।

গতানুগতিক অভ্যাসবশতঃ সন্ধ্যায় বেলকুনীতে বসেছি। নীতা কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে জিগেস করলো, এই, এই মণি, তুই ঢাকা যাস নি ?

আমি চমকে উঠে বললাম,

–আমি ঢাকা যাবো, এটা তোকে কে বলেছে?

–স্যার তো আমাকে জিগেস করলেন, তুই আমার কাছে এপ্লিকেশন দিয়ে গেছিস কিনা। খালুজান নাকি আজ তোকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন। তোর বড় ভাইজান আমেরিকা থেকে ছুটিতে এসেছে।

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। নীতাটাকে কোনভাবেই এড়ানো যাচ্ছে না। যদিও আজকে তার কোনো ভুমিকা নাই, সে যা বলছে তা সে স্যারের কথা শুনেই বলছে, তবুও সব রাগ নীতার উপরে হচ্ছে। তারপরও বললাম,

— “বড় ভাইজান আগামীকাল দিল্লি যাবে । ট্রাভেল ট্রিপ। হঠাৎ বন্ধুদের সাথে প্রগ্রাম হয়েছে। তো এখন আমি ঢাকায় গিয়ে কি করবো? আমার মন খারাপ হবে বলে বাবা এসে আমাকে দেখে গেলেন।”

আমি জানি, নীতা থামবে না। সহস্র প্রশ্নবানে আমাকে গেঁথে ফেলবে। সে চোখ বড় বড় করে মহাবিস্ময়ের সাথে বললো,

–“বলিস কি মণি? এদ্দিন পর এসে তোর সাথে দেখা না করেই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাচ্ছে??? তাও আবার দিল্লিতে? কেন, খালুজানের সাথে তো তাহলে এখানে আসতে পারতো? কী আশ্চর্য ব্যাপার!!!”

যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বললাম,

–“উফফ, নীতা, বন্ধুরা আগে থেকেই প্রগ্রাম করে রেখেছিল। আর আজ এখানে আসলে বড় ভাইজান কি আগামীকাল সকালের ফ্লাইট ধরতে পারতো???”

— আগামীকাল সকালেই চলে যাচ্ছে?

–হ্যাঁ

নীতা একটু দমে গিয়ে বললো,

–ও আচ্ছা। তাহলে এখানে আসলে তো আসলেই কাল সকালের ফ্লাইট মিস করতো। আচ্ছা, তাহলে কবে যাচ্ছিস ঢাকা?

আমি যথেষ্ট সাবলীলভাবে বললাম,

— দেখি, ভাইজান ফিরলে যাব।

তারপরও নীতাকে সন্তুষ্ট করতে পারলাম না। সে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে লাগলো।

বললাম, “যা তো পড়তে বস গিয়ে। তুই তো রাত জাগতে পারিস না।”

নীতা খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে কিছুক্ষণ হাবিজাবি গল্প করে চলে গেল।

কোনো ভাবে নীতাকে তো সামাল দিলাম। কিন্তু মিলি আপা? আমি নিশ্চিত মিলি আপা রুম থেকে আমার আর নীতার কথা শুনেছে। এবং প্রায় সাথে সাথেই চমকে দেখি, মিলি আপা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম,

–রাশেদ ভাইয়া তো এখনও আসেন নাই।

মিলি আপার মুখ থমথমে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,

–রাশেদ সাড়ে আটটার পর আসবে। এখন সুয়া সাতটা বাজে।

তারপর চুপচাপ। আমার কেমন যেনো হাত পা কাঁপতে লাগলো। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম,

–বসবেন মিলিপা?

–চুপচাপ চেয়ারে বস

–ওহ

আমার মাথা ঘুরছে তখন।

আমি আবারও চেয়ারে বসে পড়লাম। এই মেডিকেলে আমার কলেজের কোনো ক্লাসমেট নাই। এক বছর জুনিয়র বা একবছর সিনিয়র মানে যাদের সাথে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম,তাদেরও কেউ নাই । আমি প্রাণপণে সবকিছু লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। অতীত থেকে পালাচ্ছি না, শুধু লুকিয়ে রাখছি। যেকোনো মুল্যে এখানে আমার অতীত এবং বর্তমান লুকিয়ে আমাকে চলতে হবে। সর্বদা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঘুমের মধ্যেও আমার সে চেষ্টা অব্যহত থাকে। সহস্র শতাব্দী পর একটি সহজ স্বাভাবিক বাসস্থান পেয়েছি। যেখানে আমি অন্য দশজনের মত জীবনযাপন করতে পারছি। এবং ভেতরে ভেতরে নিজেকে তৈরী করতে পারছি। শিরদাঁড়াটা ধীরে ধীরে তার খন্ডিত, ভাঙা, নুঁয়ে পড়া অংশটাকে বড় যত্নে কাছে টেনে নিচ্ছে। আমি একদিন আমার সকল “সত্য ” নিয়েই মাথা উঁচু করে প্রকাশিত হতে চাই । সেইসব “সত্য”কে বুকে চেপে ধরেই শিরদাঁড়া সোজা করে এই পৃথিবীর জলন্ত পথে হাঁটতে চাই। পথের দু’ধারের জড়ো হওয়া অসংখ্য মানুষ বা অমানুষরদের চরমভাবে অগ্রাহ্য করেই আমি সোজা হেঁটে যেতে চাই। জড়ো হয়ে থাকা মানুষরা থমকে থাকবে, কুঁজো হয়ে থাকবে, হকচকিত হবে, বাকরুদ্ধ হবে। সেদিন তাদের স্বীকার করতেই হবে, এই উন্নত শির, এই ইস্পাত কঠিন শিরদাঁড়া পৃথিবীর কোনো বাজারে কিনতে পাওয়া যায়না। এগুলো অর্জন করতে হয়। নিজেদের হীনমন্যতার আগুনে তারা নিজেদের পোড়াবে। নিজেদের ঘৃণ্য দৈন্যতায় নিজেরা চরমভাবে ভেঙে পড়বে, লজ্জিত হবে, লজ্জায় মুহ্যমান হবে। আর, আমি তখন তাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো। হয়তো কাউকে কাউকে জিগেস করবো, তোমার পায়ে কি বড্ড ব্যথা হচ্ছে? আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

চেয়ারে বসে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।

মিলি আপা বললো,

–নীতা এতক্ষণ যা বললো সেসব আমাকে বলিস নি কেন? আমিতো তোকে গতকাল থেকে দেখছি, তুই কেমন কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছিস। কি হয়েছে মণি?

একটু চুপ থেকে বললাম,

–আসলে, বাবা কষ্ট পাচ্ছেন তো তাই ভাল লাগছে না। আসলে বড় ভাইজানেরও দোষ কি বলেন? এদ্দিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছে, এদ্দিন পর একটু ঘুরতে যাচ্ছে। আহা, কতদিন পর প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলতে পারছে। কতদিন পর চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারছে। আড্ডায় হো হো করে হাসতে পারছে…

মিলি আপা কড়া কন্ঠে বললো,

–ছোটবোন রেখে বন্ধু?

আমি খানিক উত্তেজিত হয়ে বললাম,

–কখনোই না মিলিপা । একদমই না। বড়ভাইজান তো ছোট বোনের জন্য জান দিতেও পারে আবার জান নিতেও পারে।

আসলে মিলিপা, আমার সামনে পরীক্ষা তো তাই ভাইজান আমাকে এখনই ডিস্টার্ব করতে চায়নি। আমি যদি বাসায় কয়েকদিন থাকি তাহলে পড়ার ক্ষতি হবে। বড় ভাইজান এটাই ভেবেছেন। আর বাবার সাথে এখানে আসলে তো ভাইজান কাল সকালের ফ্লাইট ধরতে পারবে না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি মিলি আপাকেও সন্তুষ্ট করতে পারলাম না। মিলি আপা আর কিছু না বলে গম্ভীর মুখে রুমে ফিরে গেল। মিলি আপার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার চোখ এড়ায় নি। মনে মনে নিজেকে বললাম, মিথ্যাকথা বলা একটা উন্নতমানের শিল্প। নিম্নমানের মিথ্যা বলে বেশীদিন নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারবো না। আমাকে আরও সাধনা করতে হবে।

সে সন্ধ্যাতেও আমি চেয়ারটা বেলকুনীর ভেতরের দিকে সরিয়ে আনতে ভুলে গেলাম।

সকাল সাতটার ক্লাস মিস হলো। বিছানা থেকে উঠতে পারলাম না। আটটার ক্লাস ধরতেই হবে। কোনো ভাবে এক কাপ কফি বানিয়ে চুমুক দিলাম। এই বয়েমটা গতকাল ঢাকা থেকে বাবা নিয়ে এসেছেন। উফফ, দারুণ। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কাপড় বদলে ফেলেছি। চুলে চিরুনি করার তেমন কিছু নাই। গত পরশু রাতে দুই বেণী করেছি। সামনের শুক্রবার পর্যন্ত অনায়াসে চলে যাবে। শুক্রবার বেণী খুলে শ্যাম্পু করবো। চুল শুকোলে জট আঁচড়ে আবারও দুই বেণী। মাঝেমধ্যে বেণী গাঁথতে ভীষণ আলসেমি লাগে। ক্লান্ত বোধ করি। তখন একটি হাত খোঁপা করে রাবার ব্যন্ড দিয়ে পেঁচিয়ে দেই। সেসময় টাকার বান্ডিল বাঁধা রাবার ব্যন্ডের মত একরকম রাবার ব্যন্ড পাওয়া যেতো কিন্তু সাইজে ছোট। তবে টানলে অনেক বড় হতো। একদিন ডিসেকশন হলে খুব মনযোগ দিয়ে কাটা লাশের মাসলস, টেনডন, শিরা, উপশিরা ফরসেপ দিয়ে তুলছি আর স্যারকে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি। আইটেম পরীক্ষা নিচ্ছিলেন স্যার। হঠাৎ মনে হলো, স্যার আমার পড়া কিছুই শুনছেন না। স্যারের চোখও আমার দিকে বা লাশের দিকে নয়। স্যারের দৃষ্টি আমার পেছনে বসে থাকা আমার ব্যচমেটদের দিকে। আসলে, স্যারের চোখ ঘুরছে পুরো ডিসেকশন হল জুড়ে। আমি ঘাবড়ে গিয়ে পড়া বলা বন্ধ করে স্যারকে জিগেস করলাম , কি হয়েছে স্যার? আমি কি ভুলভাল বলছি? সব গুলিয়ে ফেলেছি?

স্যার ঝট করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, নাহ, সব কারেক্ট হয়েছে । কিছু গুলোয় নি। এবার করিডরের স্টোররুমে যাও। সেখানে বেসিন আছে। সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধোঁও। তারপর চুল বেঁধে ফেলো। নইলে লাশের উপর এসে পড়বে।

আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝলাম। তারপর প্রায় দৌঁড়ে করিডরের স্টোররুমে ঢুকে গেলাম।

সেদিন রাবার ব্যন্ড ছিঁড়ে হাতখোঁপা খুলে পিঠে চুল ছড়িয়ে পড়েছিল । ডিসেকশন হলের প্রায় সবাই আমার পিঠের দিকে তাকিয়ে ছিল।

বাবা চলে যাবার পর এক অভূতপূর্ব মিশ্র অনুভূতিতে ডুবে ছিলাম। তারপর গাঢ় ঘুম আর নীতা ও মিলি আপার জেরা। সন্ধ্যায় প্রথমে নীতা এবং পরে মিলি আপার সাথে কথোপকথনের রেশ কাটাতে পারছিনা। চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে থেকে বেলকুনীতে হাঁটতে থাকলাম। রাতে ডিনারের পরও পুরো বেলকুনীতে এপাশ ওপাশ করলাম। বেলকুনীতে হাঁটা আমার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস তাই এটাকে প্রথম দিকে অনেকে রহস্যজনক ভাবলেও এখন আর কেউ কিছু ভাবেনা।

মিলি আপা ঘুমিয়ে গেছে। আমিও বই খুলে বসেছি। কিন্তু কিছুই পড়ছি না। বাসায় ফোন করবো না। কারণ, রিসিভার মা নাও তুলতে পারেন। বারবার ঘরবাহির করতে পারছিনা। আমি ছাড়া রুমের সবাই ঘুমোচ্ছে। চেয়ারে বসেই অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে ভেবে চলেছি। এরপর একসময় পাশে থাকা রাইটিং প্যাড নিয়ে মাকে চিঠি লিখলাম।

প্রিয় মা,

আমি ভাল আছি। পরীক্ষার পর বাসায় যাচ্ছি না। মিলি আপাদের বাড়িতে যাবো।

ইতি

মণি

রাত ২ টা ৫১ মিনিট

চিঠিটা হলুদ খামে ভরে মুখ এঁটে নাজমুল ভাইকে দিয়ে বললাম, আনসার ভাই এলে চিঠিটা দিয়ে দেবেন। আমি ক্লাসে যাচ্ছি।আনসার ভাই আমাদের ডাক পিয়ন। তিনি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন দুপুর তিনটা, সাড়ে তিনটা নাগাদ হোস্টেলে আসেন। বিশ্বস্ত ছাড়া একজনের চিঠি আরেকজনকে দেয় না। মানি অর্ডার তো নয়ই।

স্যার অবাক হয়ে জিগেস করলেন,

–তুমি ঢাকায় যাও নি?

মুখ নিচু করে বললাম,

–জ্বী না স্যার। বাবা তো এসেছিলেন। বড় ভাইজান আজ সকালে হঠাৎ দিল্লি চলে গিয়েছেন। তাই, এখন আর গেলাম না।

–উনি কবে ফিরবেন? পেন্ডিং আইটেমগুলো পরে দিলেও হতো।

–আসলে ফিরতে সপ্তাহ দুয়েক বা মাসখানেক লাগতে পারে।

–কিন্তু, এরপরে তো কঠিন কার্ড পড়ানো শুরু করবো। হেড & নেক উইদ ব্রেইন।

আমি মুখ নিচু করে থাকলাম। স্যার বললেন,

–আচ্ছা, তখন দেখা যাবে।

মনে মনে বললাম, আপাততঃ তো বাঁচলাম। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

দুপুরে ফুপ্পিকে ফোন করলাম৷ ফুপ্পিকে বাবার কথা, বাসার কথা কিছুই বলিনি। তিনিও জিগেস করেননি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুপ্পি জিগেস করলেন ,

“পরীক্ষা শেষ হলে কি মিলিদের বাড়িতে যেতে চাও?” বললাম, “হ্যাঁ।” ফুপ্পি বললেন, “আচ্ছা। মিলির মা খুব সুন্দর রাঁধতে পারে। সে তোমাকে তেতুল বেগুন রেঁধে খাওয়াবে। এটা সম্ভবতঃ তুমি আগে কখনো খাওনি। এই রান্না শুধু ওখানকার মেয়েরাই রাঁধতে পারে।” বললাম, “তাহলে তো আপনিও পারেন।” আমি জানি, আমার কথা শুনে ফুপ্পি চুপিসারে মায়াময় হাসি হাসছেন। তাঁর চারধারে অপার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। বললেন, “এখন মিলির মা আমার চেয়েও ভাল পারে।”

টুকিটাকি কথা বলে ফোন রাখলাম। মনির ভাই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। একটু হেসে তাকে বললাম, “ধন্যবাদ মনির ভাই।”

ফুপ্পি এঞ্জেল।

এখন মহুয়ার মত আমিও একথা বিশ্বাস করি।

আচ্ছা, আমার আর ফুপ্পির মধ্যে কি টেলিপ্যাথি হয়?

সেদিন দুপুরে হোস্টেলে ফিরেই দেখলাম, মিলি আপা একটি চিঠি হাতে শুয়ে আছে আর অন্য রুমমেটদের সাথে গল্প করছে। আমি চিঠিটার দিকে আড়চোখে তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে বইখাতা টেবিলে রেখে হাত ধুতে যাচ্ছিলাম।

মিলি আপা বললো,

–এই যে আহ্লাদি, মায়ের চিঠি এসেছে। পরীক্ষার পর আমাদের বাড়ি যাচ্ছিস তুই।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ালাম। দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে জিগেস করলাম,

–কি বললেন আপনি?

–এহ, ঠসা! বলেই মিলি আপা আর বাকি দুই রুমমেট হো হো হেসে উঠলো।

গতরাতে অনেক ভেবে প্রায় তিনটের সময় মাকে চিঠিতে লিখেছি, আর আজ এসব কী হচ্ছে !!! অথচ, সারাদিন ক্লাসে আকাশপাতাল তোলপাড় করে ভেবেছি, মাকে তো লিখে দিলাম কিন্তু কিভাবে মিলি আপাকে বললো, আপনার সাথে আমাকে নিয়ে যান। ফার্স্ট প্রফ সামান্য কার্ড ফাইনাল পরীক্ষা নয়। পুরো শরীরের পরীক্ষা । মানবদেহকে ছয় ভাগে ভাগ করে দুবছর ধরে পড়ানো হয়। প্রতিটি ভাগের পরীক্ষাকে কার্ড ফাইনাল বলে। অন্য সাবজেক্ট ফিজিওলজিও আছে। এটাও অনেক বড়। ফার্স্ট প্রফ মেডিকেলের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ছেলেমেয়েদের চেহারা বদলে যায়। তাই পরীক্ষা শেষে সব ছেলেমেয়েরা নিজেদের বাড়িতে যায়। কারণ, তাদের টানা বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। গতরাতে মাকে চিঠি লিখে সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। সেই সিদ্ধান্তের জন্য সকাল থেকে অস্বস্তিতে ছটফট করেছি। তারপর, দৌঁড়ে হাসপাতাল এক্সচেঞ্জে গিয়েছি। ফুপ্পির সাথে কথা বলেছি। আমি কিছু বলার আগেই ফুপ্পি একই কথা বলেছেন। আর এখন মিলি আপার মায়ের চিঠিতেও একই কথা,,,

এসব ভাবছি আর হাতমুখ ধুচ্ছি। রুমে ফিরলে মিলি আপা কঠিন কন্ঠে বললো, “এবার আর কোনো অযুহাত চলবে না। কি রে, অমন থম মেরে গেলি কেন? আমরা কি সুন্দরবনে থাকি যে তোকে বাঘে খাবে?”

আমার ঘোর যেনো কাটছেই না। কাটবার কথাও না অবশ্য।

একটু হেসে দ্বিধান্বিত হয়ে বললাম, “তথাস্তু।”

আচ্ছা,

ফুপ্পি কি আমার মনে রাডার লাগিয়ে রেখেছেন?

গতবার কার্ড ফাইনালের পর যখন ঢাকায় গেলাম তখন দেখলাম, ছোট ভাইজান খুব ব্যস্ত। সে ফার্মগেটে অফিস টফিস দিয়ে একাকার কান্ড। সকালে বাসা থেকে বেরোয় আর অনেক রাতে বাসায় ফেরে। বাইকের হর্ণ বাজলে রমজান কাকু গেইট খুলে দেয়। দুপুরে খেতে বসে মাকে জিগেস করলাম,

–ছোট ভাইজান কি চাকরি করে?

মা বললেন,

–নাহ, সে চাকরি করবে না। স্বাধীন ব্যবসা করবে। তাই তিন বন্ধু মিলে ব্যবসা করছে। অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছে। সকালে বেরোয় আর ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। না খাটলে কি আর ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবে?

কিসের ব্যবসা তা জিগেস করার আগ্রহ হলো না। কিন্তু ছোট ভাইজান এতো টাকা কোথায় পেলো? সে তো কখ‌নো উপার্জন করেনি। কিজানি! আমি তো এই বাড়ির কোনো কিছুতেই আগ্রহী নই তাই কিছুই জানা হয় না।

আপার একটি মেয়ে হয়েছে কয়েকদিন আগে। ভাইয়া ফোন করে তখনই জানিয়েছে। পরে মেয়ের ছবি পাঠিয়েছে কিন্তু এখনও সে চিঠি আসে নাই। আপার মেয়েকে দেখার জন্য মনটা ছটফটিয়ে উঠলো। উফফ, ছোট্ট একখানা মুখ। ছোট ছোট গোল গোল হাত। উফফ! মা বাবাও ছোট্ট পরীর ছবি দেখার জন্য খুব উন্মুখ হয়ে আছেন। গতকাল সালমা এসেছিল। তার পেট ঢাউস হয়েছে। ডিম ভরা কই মাছের মত দেখাচ্ছে তাকে। গর্ভবতী মেয়েদের দেখতে এত্ত সুন্দর লাগে! আমি মুগ্ধ হয়ে সালমাকে দেখছি। লাল কালো ডুরে একটি সুতির শাড়ি পরেছে সালমা আপু। মুখটা ঢলঢলে হয়েছে। কানে একটি সোনার টব। হাতে দুগাছি সোনার চুড়ি। গলায় একটি সোনার চেইন। একটি হাত খোঁপা করে তাতে তিন দিকে তিনটি রূপোর কাটা গেঁথেছে। কাটার পেছনে তিনটি করে ছোট ছোট চেইন, চেইনের শেষ মাথায় মুক্তোর পুতির মত গোলকার ছোট পুতি ঝুলছে। সালমা আপুর লাবণ্য যেনো উথলে পড়ছে । আমি অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

–সালমা আপু, তুমি এতো সুন্দর!!!

উত্তরে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। এত্তো মিষ্টি লাগছিল যে আমার মুগ্ধতার ঘোর কাটছিল না। আর সে আমাকে ধরে কেঁদেই চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলেই চলেছে, কেন তার বিয়েতে আমি থাকলাম না? কেন তাকে আমি সাজিয়ে দিলাম না? কেন তার বউ সাজা ছবিতে আমি নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। মা তাকে যতই বলে, এই সালমা, কাঁদিস না তো, প্রেশার বেড়ে যাবে সে ততই জোরে কেঁদে ওঠে। মা তাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। শরীর একটু খারাপ লাগলে ড্রাইভার কাকুকে পাঠিয়ে এখানে নিয়ে আসেন মা। কিন্তু দুদিন থেকেই নাকি বরের কাছে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে সালমা আপু। বলে, “রান্না কইরা তো শেষ হইয়া যায়তেছে গো খালাম্মা। মানুষটা অফিসতে আইসা আবার রান্না ঘরে ঢুকে। আব্বাজানের আওনের তো কুনো ঠিকঠিকানা নাই। বাপবেটায় অনেক কষ্টে আছে।” মা তখন তাকে ধমক দেন, আর রূপার মা খালা মুখ টিপে হাসে। পরে মা বাবাকে ফোন করে বলেন, ফেরার সময় জামাইকে সাথে নিয়ে ফিরতে। সালমা বেশী অস্থির হলে তার প্রেশার বেড়ে যাবে। জামাইকে সাথে নিয়েই বাবা ফেরেন। সালমার শশুর মানে বাবার অফিসের ড্রাইভার কাকুও তখন এ বাসায় খাওয়া দাওয়া করেন। ড্রাইভার কাকু অবশ্য আগে থেকেই এ বাসায় খেতেন। আর এখন তো প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্ক। এ বাড়িতে তারা কয়েকদিন থেকে নিজেদের বাসায় চলে যায়। ড্রাইভার কাকু নামিয়ে দিয়ে আসেন। মা সারাক্ষণ বলছেন, সালমা, তুই আমার কাছে থাক। ওখানে তো জামাই আর তোর শশুর অফিসে চলে যায়। তুই সারাদিন একা। আবার রান্নাবান্না, ঘরের কাজও করিস। কি দরকার? এখানে থাক। উহু, সালমা আপু বরকে ছাড়া থাকতেই পারেনা। এসব কথা মুখ টিপে হাসতে হাসতে রূপার মা আমাকে বলেছে। সব শুনে আমি বলেছি, “খালা, মুখ টিপে হাসছো কেন?” বলে আমি নিজেই হেসে দিয়েছি।

আমার কার্ড ফাইনাল চলছিল তাই আমি সালমা আপুর বিয়েতে ঢাকায় আসতে পারিনি। বাবার অফিসের ড্রাইভারের ছেলের সাথে মা সালমাকে বিয়ে দিয়েছেন। আর বাবা ড্রাইভারের ছেলেকে মাস্টাররোলে পিয়নের চাকরি দিয়েছেন। জামাইয়ের কাজকর্ম ভাল হলে চাকরি একসময় পার্মানেন্ট হবে। তবে প্রথম শর্ত, সালমাকে ভাল রাখতে হবে। আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল, সালমা আপুকে আমি নিজের হাতে সাজাবো। কিন্তু, এমন সময় বিয়েটা হয়ে গেল যে আমি আসতেই পারলাম না। মা অবশ্য চিঠিতে লিখেছিলেন , বিয়ে কয়েকদিন পিছিয়ে দেবেন। আমি তাড়াতাড়ি মাকে চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, বিয়ে যেন না পিছোনো হয় । কার্ড ফাইনাল শেষ হলেই আমি ঢাকায় আসবো। তখন সালমা আপুকে আবারও বউ সাজিয়ে ছবি তুলবো। কিন্তু, যখন ঢাকায় গেলাম তখন সালমা আপু নোয়াখালীতে। তার শশুরবাড়ি নোয়াখালীতে। বাবার অফিসের ড্রাইভার কাকু পরিবার বাড়িতে রেখে ঢাকার মেসে একাই থাকতো। ছেলের চাকরি হবার পর, ছেলের বিয়ে হবার পর বাবার অফিসের ড্রাইভারকে বাবা সরকারি বাসভবনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখানে এখন সালমা আপুর শশুর, সালমা আপু আর তার বর থাকে। সালমা আপুর শাশুড়ি একবার এসেছিল। কিন্তু তিনি বাড়ির গৃহস্থালি রেখে ঢাকায় বেশীদিন থাকতে পারেন না। ঘরোয়াভাবেই সালমার বিয়ে হয়ে গেছে। মা সালমা ও সালমার বরের গায়ে হলুদও দিয়েছেন ছাদে। রমজান কাকুকে পাঠিয়ে সালমার মা আর সালমার ছোট ভাইকেও ময়মনসিংহ থেকে আনিয়ে ছিলেন মা। নোয়াখালী থেকে সালমা আপুর শাশুড়ি ও আরও অনেকে এসেছিল। তারা আমাদের বাসাতেই ছিল। গায়ে হলুদ আর বিয়েতে তারা খুব আনন্দ করেছে। বিয়ের তিনদিন পর নতুন বউ নিয়ে তারা দেশের বাড়ি গেছে। সেখানকার আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে বৌভাত করেছে। মা, রূপার মা, রমজান কাকু আর সালমার মা ও ভাইও বৌভাতে নোয়াখালীতে গিয়েছিল। একদিন থেকে ফিরে এসেছে। মা গিয়ে তাদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন দেখে এসেছেন। তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট। রূপার মা, রমজান কাকুও ভীষণ খুশী। তবে, রূপার মায়ের একটাই আফসোস, রূপার মামারা যদি রূপার বিয়েটা এতো আগেভাগেই না দিতো তাহলে রূপাও সালমার মত সরকারি চাকরি করা বর পেতো।

মাকে চিঠি দেবার সাত আটদিন পরে মায়ের চিঠি পেলাম। চিঠি হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। মা লিখেছেন,

প্রিয় মণি,

আশাকরি ভাল আছো। তোমার বাবার শরীর ভাল ছিলনা। তোমার ওখান থেকে ফিরে তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়েছিল। গাড়ি নিয়ে গেলেন না। বাসে গেলেন। এই বয়সে বাস জার্নি সহ্য হয়না। তারপর দু’রাত ঘুমান নাই।বাসে তোমার বাবা ঘুমোতে পারেন না। ওষুধপত্র ঠিকমতো খাচ্ছেন। এখন আগের চেয়ে ভাল। চারদিন হলো সালমার একটি ছেলে হয়েছে। দেখতে ভারি সুন্দর হয়েছে । সে এখন আমাদের বাসাতেই আছে। বাচ্চাটা একটু শক্ত হলে তাকে তার শশুর নিয়ে যাবে। সালমার মা আর ছোট ভাইটাও এসেছে। তোমার আপা, ভাইয়া মেয়ে নিয়ে আগামী মাসে আসবে। তার শাশুড়ি খুব লজ্জিত ও দুঃখিত । তিনি তাদের আসতে খুব অনুনয় বিনয় করেছেন। তিনি আর তোমার আপার শশুর আমাদের বাসাতে এসেছিলেন। তোমার বাবার কাছে তারা মাফ চেয়েছেন। কি আর করার। মেয়ের শশুরশাশুড়ি, তাদের তো আর খালি হাতে ফেরানো যায় না। তোমার বাবা তখনই লন্ডনে ফোন করেছিলেন। তাদের সাথে তোমার আপা ভাইয়ার সব বিরোধ চুকে গেছে। তারা তাদের বউমা আর নাতনীকে ঘরে তুলে নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছেন। তোমার আপাও খুব খুশী। এখন ফোনেও তাদের কথাবার্তা হচ্ছে। তোমার আপা গতকাল ফোন করে জানিয়েছে যে আগামী মাসে তারা দেশে আসছে। টিকিট বুকিং দেয়া হয়ে গেছে। তোমার ভাইয়ার পিএইচডি শেষ হতে আরও সময় লাগবে। এখনই না আসলে আরও বছরখানেক পর আসতে হবে।

তোমার বড়ভাইজান গত পরশু দিল্লি গেছে। সে ইউরোপের যেকোনো দেশে যাবার চেষ্টা করছে। সব দেশের এম্বাসি তো বাংলাদেশে নাই। এদিকে তাকে কানাডায় পাঠানোর জন্য তোমার বাবা খুব চেষ্টা করছেন। আশাকরি, যেকোনো এক জায়গায় হয়ে যাবে। তোমার ছোট ভাইজানের ব্যবসা বেশ ভাল চলছে। বাসার অন্যান্য সবাই ভাল আছে। ও হ্যাঁ, তোমার ড্রাইভার কাকুর এবার নাতনী হয়েছে। সে বলে, তার নাতনী নাকি একদম তোমার মত দেখতে হয়েছে । বাসাতে সালমা ও তার ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত নইলে আমি নরসিংদী যেতাম নাতনীকে দেখতে। নাতনীর জন্য একটি সোনার চেইন কিনেছি। যখন দেখতে যাবো তখন দেবো। তোমার ড্রাইভার কাকু নাতনীকে “মণি ” বলে ডাকছে। সালমার ছেলের জন্যও একটি সোনার চেইন কিনেছি। ওদিকে রূপার মা মন খারাপ করেছে তাই রূপার মেয়ের জন্যও একটি সোনার চেইন কিনেছি। রূপার মা ভীষণ খুশী হয়েছে। তোমার মালি কাকুকে এবার পুজোয় তোমার বাবা বিশ হাজার টাকা দিয়েছেন। রামানন্দ খুশীতে কেঁদে দিয়েছে। বলেছে, “ছোটআম্মা, আমার মা জননী, এবার বাড়ি ফিরে দেখবে বাড়ি ভর্তি ফুল। মা দুগ্যার কিরে দিলাম বৌঠান, এ বাড়ি আমি ফুলে ফুলে ভরে দেবো।” এবার শীতে সে সাদা চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে গেইট থেকে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত আর লনে নকশা করবে বলেছে। আর ছাদের টবে লাগাবে আরও বিভিন্ন রঙের চন্দ্রমল্লিকা। রমজানকে কখ‌নো কিছু তেমনভাবে দেয়া হয়নি মাইনে ছাড়া তাই এবার তার ছোট মেয়ের বিয়েতে কিছু টাকা দিয়েছে তোমার বাবা। স্বর্ণের জিনিস দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে বললো, সোনার জিনিসে কাজ নাই। বরং তার মেয়ে জামাইয়ের ব্যবসার জন্য টাকা দিলে ভাল হয়। তাই টাকাই দিয়েছি।

ভাল করেছি না মণি?

ইতি

তোমার মা

মা আমাকে বরাবরই বড় চিঠি লেখেন কিন্তু কখনোই সাংসারিক বা পারিবারিক বিষয়াদি সম্পর্কিত কিছুই লেখেন না। দক্ষিণে বকুল গাছটায় অনেক ফুল ধরেছে বা কদম ফুলে গাছ ভরে উঠেছে অথবা প্রতি ভোরে শিউলি তলা ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকছে, রূপার মা চোখে চশমা দিয়ে শিউলির মালা গেঁথে তোমার ঘরে রাখছে । ভোরে ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু দেখায়ে রূপার মা বলে, “ছোটআম্মা থাকলে এখন খালি পায়ে ঘাসে হাঁটতো। না গো বুজান?” কামিনী ফুলের সুবাসে পুরো বাড়ি মৌ মৌ করছে। গত পরশুর ঝড়বৃষ্টিতে তোমার বেলকুনী ভেসে গেছে। জারুল গাছের একটি ডাল ভেঙে পড়েছিল। রামানন্দকে দিয়ে ডালটা তুলে এনেছি। ডালটি দিয়ে একটি ডেকোরেটিভ গাছ বানিয়ে তোমার বেলকুনীতে রাখবো ভেবেছি। কেমন হবে বলো তো ? সুন্দর হবেনা?

কিংবা লিখেন, তোমার বেলকুনীতে একটি দোলনা লাগিয়েছি, এবার এসে দোলনায় দুলে দুলে চাঁদ দেখতে পারবে, ইত্যাদি ইত্যাদি । আজ পারিবারিক এতসব কথা লেখার কারণ ওই একটাই। কিন্তু তাই বলে “দিল্লি”!!! ওটাতো হঠাৎ করে নীতাকে বলে ফেলেছিলাম। আমার মাথা ঘুরোচ্ছে।

কী হচ্ছে এসব,,,

আমার মা।

আমার মা অতি বুদ্ধিমতী একজন নারী । নানাভাই ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের পোস্টমাষ্টার। তাদের গ্রামের অন্যান্য মুসলিম পরিবারের মেয়েরা সে আমলে স্কুলে যেতো না। কিন্তু মা খালারা তিন বোন স্কুলে যেতেন । মুসলিম পরিবারের মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে তাই ময়মুরুব্বি, আত্মীয়স্বজনরা নোংরা কটুক্তি করতো। বনবাদারে লুকিয়ে থাকা নিম্ন মানসিকতার লোকজনের ছোড়া ঢিলও খেতে হয়েছে তাদের। নানাভাই ব্রিটিশ ভারতের সরকারি চাকুরিজীবী তাই বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকতেন না। এজন্য বড়মামাসহ মায়ের দুইজন ফুপাতো ভাই তিনবোনকে পাহারা দিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন। একটি হিন্দু ছেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো মায়ের। একবার সেই ছেলে পরীক্ষায় প্রথম হলে পরেরবার মা প্রথম হতেন। তিনি পরবর্তীতে কোলকাতায় ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। মায়ের ফুপাতো ভাইয়ের সাথে তাঁর কোলকাতায় দেখা হলে তিনি মায়ের কথা জানতে চান। যখন শুনলেন, মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে তখন খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “সে পড়ালেখা করলে আমার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট হতো। আর আপনারা তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন?”

ক্লাস নাইনে পড়াকালীন মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। আমার বাবা মাঝেমধ্যে বলতেন, আরেকটু পড়ালেখা করার সুযোগ পেলে তোমাদের মা ইন্দিরা গান্ধীর মত একজন মহীয়সী লেডি হতেন। কিন্তু সংসারের জন্য সে স্কুলের চাকরিটাও ছেড়ে দিল। অথচ, সেই স্কুল এখন বাংলাদেশের নামকরা স্কুল।

বাবা যখন মায়ের এ ধরনের প্রসংশা করতেন তখন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতো। কারণ, আমি পেটে থাকতেই মা প্রচন্ড অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। অতঃপর স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আমি জন্ম নেবার পরও প্রায় দু’বছর মা ভীষণ অসুস্থ্য ছিলেন। তারপর অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেবার পর ধীরে ধীরে মা সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু ততদিনে আবারও নতুনভাবে পড়ালেখা শুরু করার মত মন মানসিকতা, শারীরিক সবলতা, সময় বা ধৈর্য্য মায়ের ছিলনা। সাংসারিক কাজও বেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও খানিক উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাদের পড়ালেখাকে প্রাধান্য দেয়া মায়ের তিনটি শপথের একটি শপথ ছিল।

১৯৪৮ সালের সেই ট্র্যাজিক জোড়া মৃত্যুর পর বাবা দু’মাস বাড়িতে ছিলেন। কারণ, মা প্রায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। মাকে নিয়ে বাবা নিজেদের বাড়িতে, মানে আমাদের দাদাজানের বাড়িতে থাকেন নাই। নানাবাড়িতে ছিলেন। কারণ, মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ক্রমশঃ অবনতির দিকে চলে যাচ্ছিল ।

মায়ের খুব দৃষ্টি ও শ্রবণ বিভ্রম হতো। তিনি দাদিজানকে দেখতেন। দুধ খাওয়ানোর জন্য ছেলেকে ডাকতেন। উঠোনে ছেলে হামাগুড়ি দিচ্ছে তাই দেখে হেসে কুটিকুটি হতেন। রাতে দাদিজানের ডাক শুনে বিছানা থেকে উঠে বাইরে চলে যেতেন। জেলা শহরের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন নানাজান আর বাবা। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন, “ঢাকায় নিয়ে ভাল ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করান।” কিন্তু, ঢাকায় ভাল চিকিৎসক কে আছেন তা বাবার জানা ছিলনা। কোলকাতা হলে সমস্যা ছিলনা। ঢাকার ভাল ডাক্তারের খোঁজ নেবার জন্য বাবা তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখলেন। বন্ধুর চিঠিতে ভাল ডাক্তারের খোঁজও পেলেন কিন্তু প্রায় অচেনা অজানা শহরে মাকে নিয়ে কোথায় থাকবেন, কি করবেন এসব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না বাবা। আর্থিক বিষয়ও ছিল। বাবা তখন বেকার। গত আট মাসের অল্পকিছু জমানো টাকা ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। মায়ের চিকিৎসা বাবদ যা লাগছিল তা নানাজানই খরচ করছিলেন। নানাজান বলেছিলেন, নিয়ে যাও ঢাকায়। খরচ যা লাগে আমি দেবো। সবকিছুর উপরে আমার মেয়ে। লাগলে জমি বিক্রি করবো। নানাজান তখনও পুর্ব পাকিস্তানের সরকারি চাকুরে। তাঁর পোস্টিং তখন বাড়ি থেকে খুব বেশী দুরে নয়। তিনি বাড়ি থেকেই আসাযাওয়া করে অফিস করতেন। তাঁর চাকরিও আর দু’তিন বছর আছে। তারপর তিনি অবসরে যাবেন।

বাবা কাঁচুমাচু করে বলেছিলেন, আরেকটু দেখি। আর, জমি বিক্রি তো আমিও করতে পারি। আপনার মেয়ের চিকিৎসার জন্য আমার সব জমি বিক্রি করতে আমি প্রস্তুত। এতে বাজান আমারে কিচ্ছু বলবেন না। বাজানও আপনার মেয়েরে অত্যন্ত ভালবাসেন।

যে মহিলা দাদিজান ও তাদের প্রথম সন্তানের লাশ ঘর থেকে নামিয়ে এনেছিলেন, তিনি বাবার মামী। বাবার মামা অকালে ক্ষয়রোগে মারা যাওয়াতে তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের সংসারে বাপের ভিটাতেই থাকতেন। বাবার মৃত মামার কোনো সম্পত্তি তিনি পান নাই। অথবা, সম্পত্তি বলতে মৃত মামার ভিটাবাড়ির অল্প কিছু অংশ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। বাপের বাড়িতে একবার বড় ভাইয়ের কাছে, একবার ছোট ভাইয়ের কাছে ঠেলাঠেলি করে একটি অনাথ শিশুকে নিয়ে চরম দুর্দশায়, অভাবে ও কষ্টে জীবনযাপন করতেন। বাবা বললেন, “মামী, এখন থেইকে তুমি এ বাড়িতেই থাকবা। এখন থেইকে এইটাই তোমার বাড়ি। তারপরও আমি তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এমনকি, আমার ছেলেমেয়েরাও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবে না। কারণ, তুমিই আমার মা আর আমার ছেলের লাশ ঘর থেকে নামিয়েছো। গোসল দিয়েছো। কাফন পরিয়েছো। আমি আমৃত্যু তোমার আর তোমার বংশধরদের কাছে ঋণী থেইকে যাবো। আমি নৌকো পাঠিয়ে দিচ্ছি, তোমার ছেলে মানে আমার ভাইকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে । এই বাড়ি তারও।”

বাবার সিদ্ধান্তে শোকে মুহ্যমান দাদাজান খুশী হলেন।

অপ্রকৃতিস্থ মাকে নিয়ে বাবা দু’মাস নানাবাড়িতে ছিলেন৷ বাবা তাঁর বন্ধুদের চিঠিতে সবকিছু জানিয়েছিলেন। বন্ধুরা অর্থাৎ সহকর্মীরা বাবার উর্দুভাষী উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। তবুও বাবার চাকরি চলে যায়। বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমে ধীরে ধীরে মা সুস্থ্য হতে থাকেন। আর বাবা তাঁর বন্ধুদের একের পর এক চিঠি লিখে তাগাদা দিতে থাকেন একটি চাকরির জন্য।

মা তখন অনেকটা ভাল। বাবা যেন ঢাকায় আবারও কোনো চাকরি পান মা সর্বদা এই প্রার্থনা করতে থাকেন। বাবার বন্ধুরা বাবার জন্য খুব চেষ্টা করছিলেন। একদিন সত্যি সত্যিই যখন বাবার এক বন্ধু চিঠিতে জানালেন, বাবার জন্য একটি ভাল চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে, বাবা যেন পত্র পাওয়া মাত্র ঢাকায় রওনা দেন তখনই মা বাবাকে ঘরে ডেকে নিয়ে তিনটি শর্ত দেন। এবং এই তিন শর্তে রাজি হলে মা বাবাকে ঢাকায় যেতে দেবেন, নইলে না। শর্তে রাজি না হয়ে এরপরও যদি বাবা ঢাকায় যান তবে মা আত্মহত্যা করবেন বলে বাবাকে বলেন। বাবা মুষড়ে পড়েন। ভাবেন, মা বোধহয় আবারও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছেন। আবারও মায়ের মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।

ঘাবড়ে গিয়ে বাবা জিগেস করেছিলেন, “কি, কি শর্ত তোমার?”

–“প্রথম শর্ত,

আমারে ঢাকায় নিয়ে যাবেন। আমি গ্রামে থাকবো না।

দ্বিতীয় শর্ত,

ঢাকায় গিয়ে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিব। যতদুর সম্ভব লেখাপড়া করবো। আর চাকরি করবো। মানা করতে পারবেন না।

তৃতীয় শর্ত,

ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বানাবো। তারা যেন অসুস্থ্য, অসহায় মানুষের চিকিৎসা দিতে পারে। আমাদের বাচ্চারা পড়ালেখা করে ডাক্তার হবে। আপনি তাদের পড়ালেখা করাবেন।”

বাবা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর বলেছিলেন, “বাকি জীবনে তুমি যা যা বলবে আমি তা সব করবো। তোমার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের মুল্যায়ন যদি না করি তাহলে আমার মহাপাপ হবে।”

মাকে নানাবাড়িতে রেখে বাবা আমাদের বাড়িতে আসলেন। দাদাজানকে সালাম করে বললেন, “বাজান, ঢাকায় আমার ভাল চাকরি হয়সে। আমি ঢাকায় রওনা দিচ্ছি।” কিন্তু বাবা যখন বললেন, “ইবার একা যাচ্ছি। তবে পরেরবার এইসে তোমাদের বউরে আর তোমারে নিয়ে ঢাকায় যাবো। তোমাগে দুজনেরই চিকিৎসা দরকার। এখানে থাকলে তোমাগে আর বাঁচানো যাবেনা।”

দাদাজান তখন মনোক্ষুন্ন হলেন।

বাবা অনুনয় করে বললেন, “বাজান, তোমারে রেইখে যেতে আমার ভয় করে বাজান। তুমিও যাবা আমাদের সাথে। আমিতো তোমারে রেইখে যাবো না।”

তখন দাদাজান গর্জন করে উঠেছিলেন।

–“তোমার মায়ের কবর ফেলায়ে আমি ফিরিঙ্গি দেশে যাবো? আমারে তুমি বিদেশে নিয়ে যাবা? এত্তবড় সাহস তোমার!!!”

দাদাজান ও বাবার মামীকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবা ঢাকায় রওনা দিলেন।

বন্ধুদের সহায়তায় বাবা ভাল একটি সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন । দু’মাস পরে ঢাকায় ফিরে নতুন চাকরিতে যোগদান করেন।

দাদাজানকে ঢাকাতে নিয়ে যাবার জন্য অনেক বুঝিয়েছেন বাবা । কিন্তু সফল হন নাই। তবে পরবর্তীতে দাদাজান দু’তিনবার বেড়াতে এসেছেন ঢাকাতে তাঁর ছেলের বাসায়। মাসখানেক থেকেছেন বড় কষ্টে। আবারও ফিরে গেছেন শেকড়ে। দাদাজান যখন ঢাকায় থাকতেন তখন সবসময় কেমন যেন আনচান আনচান করতেন। উথাল পাথাল করতেন। যেন, জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠে পড়েছে। সারাক্ষণ ছটফট করতেন।

ছোট ভাইজান জন্মানোর কয়েকমাস পরে দাদাজান মারা যান। দাদিজানের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সে সময় দাদার অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে বাবা মাকে আর তিন ছেলেমেয়েকে সাথে নিয়ে স্টিমারে করে বাড়ি চলে যান। বাবা বাড়িতে যাবার দু’দিন পর দাদাজান মারা যান।

মাকে আশ্বস্ত করে এবং কথা দিয়ে বাবা ঢাকায় আসলেন। পুর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগদান করলেন। দু’মাস পর ঢাকাতে দু’রুমের একটি বাসা ভাড়া করে মাকে আনতে বাড়িতে গেলেন। বাবার মামীর হাতে দাদাজানকে দেখাশোনা ও বাড়ির সব দায়িত্ব দিয়ে মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন। চাচাতো ভাইটিকেও গ্রামের স্কুলে ভর্তি করালেন। প্রায় দেড়দিন ট্রেন জার্নি, মাঝে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছুতে দু’দিন লেগে গেল। কমলাপুর রেল স্টেশনে বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াহিদ কাকা বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাবা মা একটি রিকশায় উঠলেন আর পাশে পাশে ভেসপায় ওয়াহিদ কাকা। ওয়াহিদ কাকা দেখতে উত্তমকুমারের মত। টকটকে গায়ের রঙ এবং কালো কোঁকড়ানো চুল। চুলের কিছু অংশ কোঁকড়ায়ে কপালে ঝুলে পড়েছে। অসামান্য সুদর্শন পুরুষ। সারারাস্তা মায়ের সাথে ফ্ল্যাট করতে করতে এসেছেন। মা গ্রামের সাধারণ মেয়ে। বয়সও অল্প। তিনি ভয়ে অস্থির। বাবার পাঞ্জাবির হাতা খামচে ধরে ভয়ে জিগেস করলেন, “ইনি ইরাম করতিছে ক্যান?” বাবা হো হো করে হেসে উঠেছিলেন।

নতুন বাসায় পৌঁছে মা দেখলেন, একটি খাট শুধু বিছানো আছে। দুই রুমের বাসাতে আর কিছুই নাই। এবার সেই সুদর্শন যুবক বাবার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন । বললেন, “তুই আমাকে বলতে পারতিস! আশ্চর্য, এখানে তো কিছুই নাই। এই অবস্থায় তুই এখানে ভাবিকে নিয়ে আসলি কিভাবে ?” তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাবি, আসেন আমার সাথে। যতদিন না সংসারের জিনিসপত্র কেনা হয় ততদিন আমাদের বাসায় থাকবেন আপনি।” মা আরও ঘাবড়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে বাবাকে নিচু কন্ঠে জিগেস করলেন, “উনি কোতায় থাকেন ? আমারে নিয়ে যেইতে চাচ্ছে কেন? আপনিই বা কোতায় থাকবেন?” ওয়াহিদ কাকা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “এইখানেই থাকবে শালা উজবুক কোথাকার। আসেন আপনি, আসেন।”

বাবার দিকে তাকাতে মা দেখলেন, বাবাও হাসছেন।

গেন্ডারিয়াতে ওয়াহিদ কাকাদের বিশাল জায়গা জুড়ে বাগানবাড়ির মত বাড়ি । বাড়িটি অবশ্য দোতলা। কিন্তু বিশাল জায়গা জুড়ে বিভিন্ন গাছ গাছালি, বাগান । চারদিকে খোলামেলা জায়গা আর আম জাম কাঠাল জারুল শিমুল বটগাছ । মাঝখানে একটি দোতলা বিল্ডিং। ওয়াহিদ কাকা অবিবাহিত। তাঁর জন্য মেয়ে দেখছে বাড়ির লোকজন। মাকে নিয়ে ওয়াহিদ কাকা সোজা তাঁর মায়ের কাছে গেলেন। বললেন, “মা দেখো, এই রকম বউ যদি খুঁজে আনতে পারো তবেই আমি বিয়ে করবো। নইলে বিয়েটিয়ের মধ্যে আমি নাই। বিয়ে নিয়ে আমাকে আর বিরক্ত করবে না।” ওয়াহিদ কাকার মাকে দেখে এতক্ষণে মায়ের বুকে যেন জান ফিরে এসেছে। মা ওয়াহিদ কাকার মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে লজ্জায় ঘোমটা দিয়ে মুখও ঢেকে ফেললেন। ওয়াহিদ কাকার মা মায়ের ঘোমটা সরিয়ে খোঁপা দেখলেন। শুধু তাইই নয়, খোঁপা খুলে পুরো চুলও দেখলেন। নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর হতাশ হয়ে আফসোসের সুরে বললেন, “এমন চুলের মেয়ে আমি কোথায় পাবো মা! আমার ছেলে আর কিচ্ছুটি চায় না। শুধু চায়, মেয়ের মাথা ভরা চুল থাকতে হবে। অনেক লম্বা চুল।”

বলে তিনি একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন।

পরবর্তীতে মা নিজের হাতে ওয়াহিদ কাকার মায়ের সাথে মিলে কাকার বিয়ে দিয়েছিলেন। বউয়ের চুল প্রায় পা ছোঁয় ছোঁয় অবস্থা। কিন্তু ওয়াহিদ কাকার মা মায়ের উপর ভীষণ রাগ করেছিলেন। বলেছিলেন, “গ্রামের মেয়ের পেটে পেটে এতো বুদ্ধি! এ মেয়েতো সাংঘাতিক!”

মা অবশ্য বৃদ্ধার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেছিলেন, “মনে দুখ নেবেন না খালাম্মা। ভাইজান ভাল থাকবেন।”

কাকার বিয়ে নিয়ে তুমুল কান্ড। মা কাকার মাকে বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত। কিন্তু কাকা যেমন একরোখা, জেদি, কাকার মা তার চেয়ে এককাঠি সরেস। ঘটনাটা ঘটেছিল এক দুপুরে অফিস থেকে ফেরার পথে। ঢাকা শহরে তখন তো উঁচু উঁচু ইমারত ছিলনা। একেকটা এলাকায় বড়জোর দুএকটি তিনতলা বাড়ি। বেশিরভাগ বাড়ি একতলা। কিছু বাড়ি দোতলা। বাড়ির ছাদগুলোই বাড়ির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল । দিনের রোদে আচারের বয়েম, গোটা হলুদ, শুকনো মরিচ ধুয়ে রোদে দেয়া হতো। আম, জলপাই, চালতা কেটে মশলা মাখিয়ে রোদে দিতেন বাড়ির গৃহিনী। কেউ একজন বিরাট একটি চিকন বাঁশ নিয়ে সিঁড়িঘরের ছায়ায় বসে কাক তাড়াতো। বিকেলের সোনারোদে বাড়ির বউ ঝিয়েরা বাড়ির ছাদে হেঁটে বেড়াতো। মাদুর পেতে মুড়ি মাখিয়ে সবাই মিলে খেতে খেতে আড্ডা দিত । কেরাম খেলতো। লুডু খেলতো। চা খেতে খেতে গল্পের বই পড়তো। বউয়েরা উল বুনতো। রোদ পড়ে গেলে নেড়ে দেয়া শাড়ি বা অন্যান্য কাপড়চোপড় তুলে ছাদেই ভাজ করতো বাড়ির মেয়েরা। শিশুকিশোর ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াতো। কিশোরী মেয়েরা অন্য ছাদের কলেজ পড়ুয়া যুবক ছেলেদের সাথে চোখে চোখে প্রেমের কবিতা লিখতো। তবে ঠা ঠা রোদের ভরদুপুরে ছাদে সাধারণত কেউ থাকতো না। মাঝেসাজে পড়ন্ত দুপুরে গোসল সেরে কেউ কেউ ধোয়া শাড়ি দড়িতে মেলে দিয়ে টুপ করে নেমে যেতো। দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব। তবে কোনো কোনো গৃহিনী সেলাই মেশিনে ব্যস্ত থাকতেন । ফ্রক, বালিসের ঝালর কাভার , ব্লাউজ, পেটিকোট,টেবিল ক্লথ, পর্দা, চেয়ার কাভার ইত্যাদি বানাতে সেলাই মেশিন চলতো। চালের গুড়ো কাই করে হাতে সেমাই কাটতেন। শীতের দুপুরে লাউ কুঁচিয়ে দুধ লাউয়ের পায়েস রাঁধতেন। এমনি এক ঠা ঠা রোদের দুপুরে অফিস ফিরতি ওয়াহিদ কাকা ভেসপা নিয়ে নিজবাড়ি গেন্ডারিয়া যাচ্ছেন। রাজপথ থেকে অলিগলি পেরিয়ে তাঁদের বাড়ি। এক গলিতে ঢুকেই দেখেন, একতলার একটি ছাদে মোড়ায় বসে রোদে চুল মেলে দিয়ে পেছন ফিরে বসে আছে একজন নারী। সেই চুল দেখে কাকা ভেসপা নিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাঁর মুখটি দেখতে পারলেন না। এভাবে অন্য গলির ছাদে, জানালায় উঁকিঝুঁকি দেয়া খুবই বিপদজনক একটি বিষয় । খবর পেলে পাড়ার দাদারা ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে। তারপরও প্রচুর রিস্ক নিয়ে কাকা মেয়েটির মুখ দেখতে সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বাড়ি চলে গেলেন।

পরদিন অফিস থেকে বাবার সাথে সোজা বাবার বাসায়। মাকে ডেকে বাবা বললেন, “সেই সকাল থেকে জোকের মত লেগে আছে। আগে খেতে দাও তারপর কাহিনী শুনে কিছু একটা ব্যবস্থা করো।” কাকা বললেন, “নো, নো খাওয়াখায়ি। ফার্স্ট কাহিনী দ্যান খাওয়াখায়ি।” মা ততক্ষণে মাদুর বিছিয়ে দিয়েছেন। কাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, খেইতে খেইতেই কাহিনী শুনবো ভাইজান। যান, হাতমুখ ধুইয়ে নিন গে।”

প্যান্ট নিয়ে মাদুরে বসেছেন কাকা। বাবা ততক্ষণে কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে লুঙ্গী স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চলে এসেছেন। কাকা পকেট থেকে কাগজে লেখা একটা ঠিকানা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললেন, “ভাবি, চুল পেয়েছি। চুল সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিন্তু, আরও সামান্য কিছু সমস্যা আছে। নেন ধরেন। কি করবেন আপনি জানেন।”

–“কি? কি সমস্যা??” খুশী এবং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মা জিগেস করলেন।

কাকা বাবার দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন। বাবা মহা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন। কাঁচামরিচে কামড় দিতে দিতে বাবা বললেন,

–বিবাহিত না অবিবাহিত, বুড়ি না ছুড়ি, টিকলো না বোঁচা, খ্যাদা না ন্যাকা, কাক না কোকিল তা সে কিছুই জানতে পারে নাই । পেছন থেকে দেখেছে মাত্র। মোড়ায় বসে ছিল ছাদে। শুধু পেছনে পিঠভরা চুল দেখেছে আর কিচ্ছুটি দেখতে পারে নাই। আরও কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিলে এখন হাসপাতালে মাথায় ব্যান্ডেজ আর ঠ্যাং ঝুলায়ে শুয়ে কু কু করতে হতো।”

মা কপট রাগ দেখিয়ে মুখ টিপে হেসে বাবাকে ধমকে বললেন, “আহ, থামেন তো আপনি । “

বাবা মুখে ভাত দিতে দিতে কাকাকে বললেন, “আগে ভাত খা উজবুক। কার বউ দেখে পাগল হয়েছিস ওইটা পরে বের করবো নে।” বাবার কথা শুনে কাকা তিড়িং করে একলাফে উঠে দাঁড়ালেন । প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বাবাকে বললেন, “তুই আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস? আমাকে ব্যঙ্গ করছিস? খাবো না ভাত।”

মা তাড়াতাড়ি কাকাকে শান্ত করার জন্য বললেন, –“আমিতো আছি ভাইজান। আপনার বন্ধু বাদ। তার কথায় কি আসে যায়? এখন একটু খেইয়ে নিন তো । বিকেলে বেরোবো আমরা। বাড়িটা দুর থেইকে আমারে দেখায়ে দিলেই হবে।” কাকুতি মিনতি করে মা বললেন

“বসেন গো ভাইজান। এই যে নিন, খেয়য়ে নিন আগে।”

কাকাদের আদিবাড়ি ঢাকার গেন্ডারিয়া হলেও দেশভাগের আগে তাঁরা ঢাকা কোলকাতা মিলিয়ে বসবাস করতেন। ওয়াহিদ কাকার বাবার বিশাল ব্যবসা ছিল। অধিকাংশ ধ্বংস হয়েছে রেঙ্গুনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বাদবাকি ধ্বংস হয়েছে বিভিন্ন সময়ের রায়টে। অল্প যা কিছু আছে তার মধ্যে এই বাড়িটি আর পুরোনো ঢাকায় একটি কাপড়ের দোকান। দোকানটা তাঁর বড়ভাই দেখাশোনা করেন। বাবা তো গত হয়েছেন আগেই। বড় ভাই বিয়ে করেছেন। তাঁর ছেলেমেয়ে দুটি স্কুলে পড়ে। ওয়াহিদ কাকা ব্যবসা পছন্দ করেন না তাই চাকরি করেন। অবস্থা পড়ে গেলেও এখনও যা আছে তা দিয়ে যথেষ্ট ভালভাবে তাঁদের সংসার চলে যায়। কাকা তাঁর মাইনের টাকা দিয়ে নতুন পুরোনো সিনিয়র জুনিয়র বন্ধুদের সাহায্য করেন। বাবাকেও প্রাথমিক অবস্থায় তিনি অনেক সাহায্য করেছেন।

ঢাকায় প্রথমে এসেই প্রায় একমাস বাবা মা ওয়াহিদ কাকাদের বাড়িতে ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন সংসারের কিছু জিনিস কিনতেন বাবা আর ওয়াহিদ কাকা। তারপর সংসার মোটামুটি গুছানো হলে বাবা মা তাদের ভাড়া বাসাতে উঠে যান ।

বিকালে বাবা মা রিকশায় আর কাকা তাঁর ভেসপায় বের হলেন। মা বাবাকে বলেছেন, রোদ থাকতে থাকতেই মা ওই মেয়েকে দেখতে চান। বাবা আবারও ইয়ার্কি করে বলেছেন, “ঠিকাছে চলো। অন্যের বউ এনে ওই শালার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেই।” মা তখন সত্যি সত্যি রেগে গিয়ে বলেছেন, “অমন আকতা কুকতা কচ্চেন কেন? চুপ থাকবেন একদম।” কাকা আরেকটু হলে বাবাকে প্রায় ঘুষি মেরে দিত। মা কাকাকে আবারও সামলেছেন।

দরজায় কড়া নাড়তে একজন প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। মা পা ছুঁয়ে সালাম করে জিগেস করলেন,

–“এইটা ফরিদা আপাদের বাড়ি না?”

মায়ের ঘোমটা টানা মুখের দিকে প্রৌঢ়া আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হতাশাগ্রস্ত কন্ঠে বললেন, “না মা। তুমি কে? কোথা থেকে এঁয়োছো?”

মা ভীষণ মন খারাপ করে বললেন,

–“এই রোদের মধ্যে সারাদিন হেঁইটে হেঁইটে ফরিদা আপার বাসা খুঁজছি। দেকুন তো খালাম্মা, ঠিকানা তো এটাই দিয়েচে। দুদিন ধইরে এই ঠিকানার বাড়ি খুঁজচি।”

প্রৌঢ়া সম্ভবতঃ পড়ালেখা জানেন না। তিনি কাগজটা হাতে নিয়ে একটি মেয়ের নাম ধরে ডাকলেন। মেয়েটি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এলো। ভদ্রমহিলার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বললো,

–“হ্যাঁ, ঠিকানা তো এই বাড়িরই।”

আমার মা চিন্তিত হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েটি চুল আঁচড়ানো ছেড়ে দিয়ে যখন কাগজটা ভদ্রমহিলার হাত নিলো তখন তার হাতে ধরে থাকা চুলগুলো গড়িয়ে পড়লো। হ্যাঁ, প্রায় পা ছোঁয় ছোঁয় চুল।

মেয়েটির কথাতে মায়ের সম্বিত ফিরলো। মা বললেন,

–“এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন? বড্ড তিয়াস লেইগেছে খালাম্মা ।” ভদ্রমহিলা অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন, “তুমি ঘরে এসো মা, একটু জিরিয়ে নাও। এই, তুই আগে পানি আন। তারপর একটু চা বিস্কুট নিয়ে আয়।”

মাকে প্রায় ধরে নিয়ে ঘরের একটি মোড়ায় বসালেন। ছোটবড় ছেলেমেয়েরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে মাকে দেখতে লাগলো। ভদ্রমহিলা একটি তাতের রঙিন শাড়ি দোঁপ্যাচ করে পরে আছেন। মা বুঝতে পারলেন, বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটি এই মুহুর্তে বাড়িতে নাই।

পানি খেতে খেতে মা ভাবছেন, কিভাবে সম্ভব?

চুল পা ছুঁয়েছে ঠিকই কিন্তু মেয়ের গায়ের রঙ বেশ কালো। খ্যাদা নাক, মোটা ঠোঁট। শুধু চোখদুটি বড়বড়। হরিণী চোখ। অন্যান্য সব যেমন তেমন গায়ের রঙ কি ওয়াহিদ ভাই মেনে নেবেন? খালাম্মা মেনে নেবেন?

মা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে জিগেস করলেন, “আপনার মেইয়ে খালাম্মা?”

–হ্যা গো মা।

–বিয়ে হয় নাই?

–না গো মা। প্রস্তাব আসে কিন্তু,,,

বাবা আর কাকা মাকে সেই বাড়িতে ঢুকতে দেখে গলির মোড়ে চলে এসেছিলেন। কাকার খুব টেনশন হচ্ছিল। বাবা সিগারেট ধরিয়ে কাকাকে দিলেন। নিজেও একটা ধরিয়ে উসখুস করতে থাকলেন। বাবারও খুব টেনশন হচ্ছিল, কি জানি কোন ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে মা।

কিছুক্ষণের মধ্যে মা চলে এসেছেন। মা বললেন, “ভাইজান, কাকলেট খাওয়ান। চা খাওয়ান।”

“হুররে” বলে কাকা মা ও বাবাকে নিয়ে রাস্তার ওপারের রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। রেস্টুরেন্টের একটি কেবিনে বসে মা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেন। সাথে মেয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠীর বিবরণও যা জেনে এসেছেন তাও বললেন।

ওয়াহিদ কাকা বললেন, “নো প্রব্লেম। কালই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মাকে সাথে করে যাবেন ভাবি। বড় ভাবিকেও সাথে নেবেন। আমরা আশেপাশে থাকবো। যদি তাদের সম্মতি হয় তাহলে আমরাও বাসায় যাবো। সরাসরি মেয়ের সাথে কথা বলবো।”

বাবা এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে মায়ের সবকথা শুনছিলেন আর মাকে দেখছিলেন। তারপর মাকে বললেন, “তুমি তো সাংঘাতিক মেয়েছেলে রে বাবা ! কি এক্টিং না করে এসেছো!!! সুচিত্রা সেন ফেইল! আমাকেও আরেকটা বিয়ে করায়ে দাও না? প্লীজ,,,”

মা চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা হো হো করে হেসে দিলেন।

পরদিন ওয়াহিদ কাকার মা ও ভাবিকে নিয়ে চুলবতী মেয়ের বাড়িতে গেলেন মা। সরাসরি বললেন, “আমি আসলে গতকাল আপনার মেয়েকে দেখতে এইসেছিলাম। আমার দেবর সরকারি চাকুরে। ইনি তাঁর মা ও উনি আমাদের বড় ভাবি।”

সেদিন বিকালে বাড়ির কর্তা ও বড়ছোট ভাইবোনরা সবাই বাসাতেই ছিল। কর্তা মশাই বললেন, “কিন্তু কোনো পুরুষ মানুষ তো আপনাদের সাথে নাই। কার সাথে কথা বলি বলুন তো।” মা বললেন, “পুরুষ মানুষ সাথে আছে কিন্তু বাড়িতে ঢুকে নাই। আপনি বললে খালাম্মার ছেলে ও ছেলের বন্ধু আসবেন। তবে কথা যা বলার খালাম্মার সাথেই বলতে হবে। উঁনির বাড়ির মুরুব্বি।”

অতঃপর মা বাইরে গিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কাকা ও বাবাকে নিয়ে আসলেন।

কাকার মা কালো মেয়ের সাথে কাকাকে বিয়ে দেবেন না বলে গো ধরে বসে আছেন। আর কাকা ওই মেয়েকেই বিয়ে করবেন বলে গো ধরে বসে আছেন। কেউ কারো অবস্থান থেকে এক চুল নড়ছেন না। মাঝখানে মা, বাবা আর কাকার ভাই ভাবি। কাকা উঁচু স্বরে বলছেন, “আমি বর্ণবাদী না। আমার কাছে সব সমান।” কাকার মা গাল ফুলিয়ে বলছেন, “তাহলে টেকো মেয়ের কি দোষ? সব যখন সমান তখন বউয়ের মাথার চুলের এতো দরকার কেন?”

অবশেষে কাকার মায়ের বরফ ভাঙ্গা গেল। কাকার সাথে কাকিমার বিয়ে হলো। তাদের ঘর আলো করে চারজন সন্তান এলো। খুব ছোট্ট বেলায় ছুটির দিনে আমরা প্রায়ই সারাদিনের জন্য কাকার বাড়িতে বেড়াতে চলে যেতাম। অথবা কাকাকাকি পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাসাতে বেড়াতে আসতেন। আমি দই ভীষণ পছন্দ করতাম তাই কাকিমা আমাকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চামচ দিয়ে দই খাওয়াতেন। কাকাদের বাড়িতে গাছের ডালে বাঁধা দোলনায় দোল খেতে গিয়ে দোলনা থেকে পড়ে একবার আমার ঠোঁট কেটে গিয়েছিল। কাকার বড় ছেলে মুকুল ভাইজান আমাকে কোলে করে এক দোঁড়ে ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন কাকা রাগে গাছ থেকে দোলনা খুলে ফেলেছিলেন।

কাকার মায়ের মৃত্যুর পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বড় কাকিমা ও এই কাকিমা তাঁদের শাশুড়ির সেবা করে গেছেন। মৃত্যু শয্যায় কাকার মা মাকে আশির্বাদ করে গেছেন। বলেছেন, “তোমার জন্য এতো লক্ষ্মী বউ পেয়েছি মা। তোমার সংসার ফুলেফলে ভরে উঠুক।”

বুড়ি বড় সুখ নিয়ে মারা গেছেন।

বাসাতে উঠেই দুদিনের মাথায় মা লেখাপড়া শুরু করেন। এভাবে ম্যাট্রিক পাশ করেন পরের বছর। তারপর আই এ তে ভর্তি হন। উত্তাল ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। বাবা সরকারি চাকুরে হলেও তিনি আন্দোলনে পরোক্ষভাবে যোগ দেন। মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন তথ্য এনে আন্দোলনকারীদের দিতেন। এ কাজে অনেক নামিদামি লোকজন জড়িত ছিলেন। সরাসরি জড়িত ছিলেন সেসময়ের সংস্কৃতি অঙ্গনের দ্বিকপালগন। ছিলেন বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক,ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতশিল্পীগন। সারাদেশ উত্তাল। বাবার অফিসে বাবাসহ আরও অনেককে নিয়ে বিশাল হইচই। অফিস প্রাঙ্গনেও তখন “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই ” শ্লোগান। অনেকের সাথে বাবাও সে আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। উত্তাল “৫২ । ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার রাজপথ,অলিগলি ভেসে যায় বাঙালির বুকের তাজা রক্তে। বাংলা রক্তাক্ত হয়। বাবাসহ আরও অনেকের চাকরি যায় যায় অবস্থা। পুরো অফিসপাড়া আন্দোলনে অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিল, “চাকরি খেলে জ্বলবে আগুন।” কারোরই চাকরি খেতে পারে নাই বর্বর শাসক গোষ্ঠী। কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে বাবার প্রাপ্য পদোন্নতি আটকে দেয়। বাবা বঞ্চিত হন। বাবা মাকে বলেন, “তাও তো বাংলায় কথা বলতে পারছি।” মা বলেন, “আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন। ডালভাত খেইয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো।”

‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে বাবার সম্পৃক্ততা এবং চাকরিতে জটিলতা আবারও তাঁদের জীবন তোলপাড় করে দেয়। একটি বেসরকারি স্কুলে মা মাস্টারী শুরু করেন। রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের তিনবছর পর মা আই এ পাশ করেন।

বি এ তে ভর্তি হয়েও মা আর এগোতে পারেন নাই। কিছুদিন পর বড়ভাইজানের জন্ম হয়। তার পাঁচ বছর পর আপা পৃথিবীতে আসেন। ছোট ভাইজান জন্ম নেয় আরও চার বছর পর। ততদিনে বাবা সরকারি বাসভবনে পেয়েছেন। চাকরিতে দুটি পদোন্নতি আর আটকে রাখতে পারে নাই পাকিস্তানের দালাল গোষ্ঠী। ছোট ভাইজানের যখন চার বছর চলে তখন আবারও মা বি এ পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি শুরু করেন । খুব জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মা। এবার তিনি পরীক্ষা দেবেনই দেবেন। কিন্তু তখনই হঠাৎ আমার উপস্থিতি টের পান মা। তারপর, অনেক ঘটনা। প্রায় সারাবছর মা অসুস্থ্য থাকেন। মায়ের ডেলিভারিতে মাকে ঢাকায় রাখবার প্রচন্ড চেষ্টা করেন বাবা। কিন্তু মা যেনো আত্মঘাতী হয়ে ওঠেন। তিনি গ্রামের বাড়িতেই যাবেন। অতঃপর বড় ভাইজানকে ঢাকায় রেখে আপা, ছোট ভাইজানসহ মাকে প্লেইনে করে বাবা প্রথমে আমাদের জেলা শহরে নিয়ে যান তারপর নৌকায় এক্কেবারে বাড়ির ঘাটে।

বি এ পরীক্ষা না দিতে পারার রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে, মর্মবেদনায় মা ভুলে গিয়েছিলেন, ওটা ১৯৪৮ সাল নয়। ততদিনে সচ্ছল শিক্ষিত মানুষেরা জেলা শহরের হাসপাতাল থেকে সরকারি ডাক্তার বাড়িতে এনে বসিয়ে রাখতে পারেন। ঘাটে নৌকো প্রস্তত রাখতে পারেন। প্রয়োজনে জেলার সরকারি হাসপাতালে ডেলিভারির সমস্ত ব্যবস্থা করতে পারেন। যা আমার জন্মের সময় বাবা করেছিলেন

বাসাতে হুলুস্থুল লেগে গেছে।

পরের মাসেই ছোট্ট পরীকে সাথে নিয়ে আপা ভাইয়া দেশে আসলেন। তারা তাদের বাসায় উঠেছে। আপার শশুর শাশুড়ি দেবর ননদ ও ওদিকের আত্মীয়স্বজনরা খুব খুশী। তাদের বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। আপার শশুর বাবাকে বিনীতভাবে বলেছেন, “বেয়াই সাহেব, আমাদের অপরাধ যদি মার্জনা করে থাকেন তবে আমি ছেলে ও বউমার রিসেপশন করতে চাই।” এটা শুনে আপা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। মাকে বলেছে, “বাচ্চা কোলে নিয়ে আবার কিসের রিসেপশন! তারচেয়ে মেয়ের আকিকাটা দিলেই ভাল হবে।” মা সেভাবেই তাদের বেয়াই সাহেবকে বলেছেন। তাদের বেয়াই বেয়াইন তো খুশীতে ডগমগ অবস্থা। নাতনীর আকিকাও হবে আবার তাদের ও আমাদের পক্ষের আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত করে বেশ বড় একটি অনুষ্ঠানও করা যাবে। তারা তাদের ছোট্ট পরীর আকিকার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। নামকরা একটি কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দিয়েছেন তারা। আপার শাশুড়ি নাকি জেদ ধরেছেন, বউমাকে আবারও বউ সাজতে হবে। তাদের আত্মীয়স্বজন ছেলের বউও দেখবেন সাথে নাতনীকেও আশির্বাদ করে যাবেন। আপা ভাইয়া মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাসাতে মাত্র দু’দিন থেকেছেন। আরও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আপার শাশুড়ি তাঁর নাতনীকে ছাড়া একদম থাকতে পারছেন না বলে ও বাড়িতে চলে যেতে হয়েছে। এদিকে সমানে দু’বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাওয়াখাওয়ি চলছে। মা ছোট্ট পরীকে গলার চেইন আর হাতের বাউটি বানিয়ে দিয়েছেন। বাবা দিয়েছেন পঞ্চাস হাজার টাকার প্রাইজ বন্ড। ছোট ভাইজানও গলার চেইন দিয়েছে। ছোট ভাইজানের ব্যবসা তাহ‌লে ভালই চলছে।

আচ্ছা, ছোট ভাইজান কবে মার্সিডিজ কিনবে?

এই প্রথমবারের মত আপা আমাকে এসব জানিয়ে চিঠি লিখেছে। বিশাল চিঠি। দিনক্ষণ ধার্য্য হলে আমাকে আবারও চিঠি লিখে জানিয়ে দেবে বলেছে। চিঠির সাথে ছোট্ট পরীর একটি ছবিও পাঠিয়েছে আপা। পরী একটি নীল রঙের ফ্রক পরে ফোকলা মুখে হাসছে। সেকি ভুবনমোহিনী হাসি রে সোনামণির! একটি হাত মুঠো করে উপরের দিকে তুলে দিয়েছে। আরেকটা হাত দিয়ে নিজের একটি পা ধরে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল সৌন্দর্য্য যেখানে কোনো খাঁদ নাই। পরীটার ছবি দেখে আবেগে চোখে জল চলে এলো। মমতায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে ছবিতে একটি চুমু খেলাম।

একইকাজ গত দুদিন ধরে করে যাচ্ছি ।

মিলি আপা বললো, যা না, দুদিনের জন্য ঢাকায়। কী এমন ক্ষতি হবে পড়ালেখার!

মনে মনে বললাম, আপার অকথ্য গালাগালি আর কিল চড় লাথির মিমাংসা হয় নাই। আপার শশুরবাড়ির জঘন্য কথাগুলোর মিমাংসা হয় নাই।

“যে মেয়ের ছোটবোন বারোভাতারি সে মেয়ের সাথে আমার ছেলেকে বিয়ে দেবো না।”

আমাকে মারতে মারতে আপা বলছিল তার শাশুড়ির কথাগুলো। এই শব্দটি আমি কখনও কারো মুখে শুনি নাই। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে পড়েছি। তখনও এই শব্দের অর্থ জানতাম না। পরে মহুয়ার কাছে জেনেছি এটি একটি জঘন্যতম গালি।

সবার সাথে সবার মিমাংসা হয়ে যায়।

বাদ থাকি শুধু আমি,,,

আচ্ছা, আমার সাথে এদের কারো কোনো মিমাংসা হওয়া কী কখনও সম্ভব???

ফার্স্ট প্রফের আর দেড়মাস বাকি। মায়ের চিঠি পেলাম।

মা লিখেছেন, কালবৈশাখীর ঝড়ে জারুলের যে ডালটি ভেঙ্গে পড়েছিল সেই ডালটি দিয়ে মা একটি ডেকোরেটিভ গাছ বানিয়ে আমার বেলকুনীতে রেখেছেন। সারাদিন আমার বেলকুনীতে খটখটে রোদ পড়ে। আবার অঝোর বৃষ্টিতে বেলকুনীতে নুপুরের রিনিঝিনি বাজে। একদম শেষে তিনটি ছোট ছোট লাইনে লিখেছেন, তোমার আপারা লন্ডনে ফিরে গেছে। আর তোমার বড় ভাইজান এতদিন দিল্লিতেই ছিল। সেখান থেকে সে সুইডেন চলে গেছে।

প্রায় দু’বছর আগের ঘটনা যখন মেডিকেলে ভর্তি হয়ে কমনরুমের চৌকিতে শুয়ে কাঁদছিলাম।

মিলি আপার সাথে অলৌকিকভাবে যে পরিচয় হয়েছে এবং তার রুমে তার সাথে থাকবার জন্য কমনরুম ছেড়ে চলে এসেছি সেকথা ফুপ্পিকে ফোন করে জানাবার জন্য আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে, কোথা থেকে ফোন করবো তা বুঝতে পারছিলাম না। পরদিন বিকালে চা খেতে খেতে মিলি আপা বললো, “কাল তোমাকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে নিয়ে যাবো। অপারেটরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। ওখান থেকে তুমি ঢাকার বাসাতে, তোমার ফুপ্পি মানে খালামণির কাছে বা যেকোনো জায়গায় ফোন করতে পারবে। জেলার বাইরে করলে ট্রাঙ্ককল বুকিং দিতে হবে। অপারেটররা সবাই ভাল। ওনারা সবাইকেই হেলপ করে। আর চিঠিপত্র লিখলে আনসার ভাইকে দিও। সরকারি খাম আমার কাছে আছে। ক্যাম্পাসের বাইরের একটা লাইব্রেরিতে খাম কিনতে পাওয়া যায়। একদিন ওই লাইব্রেরিটাও চিনিয়ে দেবো। তবে কখনও একা যাবেনা। লোকাল বখাটে ছেলেগুলো বদের হাড্ডি। আর প্রয়োজনীয় কিছু লাগলে আমাকে বলবে। আমি ব্যবস্থা করে দেবো।”

পরদিন এক্সচেঞ্জে মনির ভাইই ছিল। মিলি আপা আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, “মনির ভাই, ও আমার খালাতো বোন। মাঝেমধ্যে ফোন করতে আসবে। ফোন লাগিয়ে দিয়েন।” বলেই আমাকে রেখে মিলি আপা ওয়ার্ডে চলে গেল। আমিও অবশ্য চাচ্ছিলাম না, মিলি আপা থাকুক। ফুপ্পির অনুমতি ছাড়া এভাবে কথা বলিয়ে দেয়া ফুপ্পি পছন্দ করেন না। তাছাড়া, ফুপ্পির যা বলার মিলি আপাকে তাতো তিনি ফোনে বলেছেনই।

আমি মনির ভাইকে নাম্বার দিয়ে অপেক্ষা করছি। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই লাইন পাওয়া গেল। আমি “হ্যালো” বলতেই ফুপ্পি বললেন,

–একদম অলৌকিক কিছু নয়। এসব আমি করেছি । একটু দেরী হয়েছে কারণ মিলির মা গত সপ্তাহে গ্রামে তার মায়ের বাড়িতে গিয়েছিল নইলে আরও আগেই ব্যবস্থা হয়ে যেতো।

এখন কেমন আছো মণি?

আমি রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললাম ,

–ভাল আছি।

আমার ভারি কন্ঠস্বর ফুপ্পির কান এড়ায় নাই। বললেন,

–তাহলে কাঁদছো কেন?

আমি স্পষ্ট ফুপ্পির দীপ্তি ছড়ানো মায়াভরা মুখটি দেখতে পাচ্ছি। আবারও চোখ মুছে বললাম,

–আর কাঁদবো না।

এরপর হালকা টুকিটাক কিছু কথা বলে রিসিভার রাখলাম। মনির ভাই ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বললো, “প্রথম প্রথম এমনই হয় আপা। বাপ মা ভাইবোনের জন্য কলিজা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ফুপ্পির সাথে এক্সচেঞ্জ থেকে প্রথম কথা বলে ক্লাসশেষে

রুমে ফিরেছি। সেদিন হোস্টেলে ফিরে মায়ের চিঠি পেলাম। মা চিঠিতে লিখেছেন, এখানে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তা বাবার কাছে শুনেছেন। এজন্যে তিনি ভীষণ চিন্তিত। মা আরও লিখেছেন, এতো কষ্ট করে মেডিকেল পড়বার দরকার নাই। ড্রাইভার কাকু ও রমজান কাকুকে পাঠিয়ে আমাকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে চান। ইউনিভার্সিটিতে তখনও ভর্তি চলছে। আমি ফিরে গিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভর্তি হতে পারবো। মা লিখেছেন, আমি অনেকগুলো সাবজেক্টে চান্স পেয়েছি। আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ইংলিশ লিটারেচারসহ আরও দুয়েকটি সাবজেক্টে এবং সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে কেমিস্ট্রিসহ আরও দুএকটি ভাল সাবজেক্টে চান্স পেয়েছি। আমি ইচ্ছা করলে এ বছরই ইউনিভার্সিটির এইসব সাবজেক্টের যেকোনো একটিতে ভর্তি হতে পারবো ।

মায়ের চিঠি পড়ে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মা কিভাবে কেমিস্ট্রির কথা লিখলো!!! নাকি মা এটা জানতেন না? কিজানি!

মিলি আপার রুমে সেদিন প্রথম দিন। আগের রাতে সে রুমে উঠেছি। ছয়দিন ভাল করে গোসল পর্যন্ত করা হয়নি। পরের দিন ছুটি। শনিবার থেকে ডিসেকশন হলে লাশকাটা শুরু হবে। তার আগেই নিজেকে ভয়ঙ্কর অপরিচ্ছন্ন লাগছে। আমি ডাইনিংএ গিয়ে আগে খেয়ে নিলাম। তারপর কমনরুম থেকে আমার বাকি জিনিসপত্র নিয়ে আসলাম। মিলি আপা ইতিমধ্যে তার টেবিল দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। একদিকে তার বইখাতা আরেক দিকে আমারগুলো। ওয়াল সেটিং আলমিরার একটি তাক থেকে নিজের জিনিস সরিয়ে পরিস্কার করে দিয়েছে। বললো, “তোমার কাপড় একদিকে আর কসমেটিক আরেকদিকে রাখো।” আলমিরার একদিকে লম্বালম্বি সরু একটি জায়গায় মিলি আপার এপ্রোন ও দুটি শাড়ি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছেন। আরও দুটি হ্যাঙ্গার খালি। হাঙ্গার দুটি দেখিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “তোমার এপ্রোন একটিতে আর আরেকটিতে কাপড় রাখো।” অন্য দুজন রুমমেট রুনা আপা ও বেনু আপা দুজনেই বললো, “ওখানে জায়গা নাহলে আমাদের আলমিরাগুলোতে রেখো।” আগেই একটি বালতিতে ডিটারজেন্ট দিয়ে ময়লা, আধোয়া কাপড়গুলো ভিজিয়েছি। তারপর যথাসাধ্য সব গুছিয়ে কাপড় ধুতে ও শাওয়ার নিতে গেলাম। মনে হচ্ছে এক যুগ পর চুলে শ্যাম্পু করছি, গা ঘষামাজা করছি, শাওয়ার নিচ্ছি। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে, শাওয়ারের শীতল জলে গা ভিজাচ্ছি আর গুনগুন করছি,

“এতদিন তো ছিলনা মোর কোনো ব্যথা

সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল মলিনতা।

আজ ঐ শুভ্র কোলের তরে

ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে

দিও না গো, দিও না আর ধুলায় শুতে

দয়া, তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে,,, “

-রবীঠাকুর

এ রুমের কায়দাকানুন তখনও জানিনা। গতরাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাঁচদিন পর ঘুমিয়েছি। অঘোরে ঘুমিয়েছি। ভোরে মিলি আপা জাগিয়ে দিয়েছেন লেকচার ক্লাসের জন্য। বিছানায় উঠে বসতেই চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। মিলি আপা গলায় এক সাগর দরদ ঢেলে বলেছিল, “খাও মণি। হাতমুখ ধুয়ে পাউরুটি আর ডিম পোচ খেয়ে রেডি হয়ে ক্লাসে যাও। আর যা যা এখনও জানিনা, তুমি নিঃসঙ্কোচে আমাকে বোলো। আমি ব্যবস্থা করবো।”

রাতে মাকে চিঠি লিখলাম,

প্রিয় মা,

আমি এখানে ভাল আছি।

অন্য কোনো সাবজেক্টে পড়বো না।

ইতি

মণি

রাত ১২ টা ৩ মিনিট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সেলিনা মওলা (Selina Moula)
সেলিনা মওলা
ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান ll

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য