- উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২), অনুরণন (পর্ব-০৩), অনুরণন (পর্ব-০৪)
কোমল গান্ধার
“আমার স্বপ্নভরা ল্যাগেজ নামাও
এই কুলি, মহাকাল কাঁধে তুলে নাও
নিজেরই বৃত্তে ঘুরে মরে না যে গ্রহ
নিজেরই বৃত্তে ঘুরে মরে না যে গ্রহ
সেই গ্রহ গাড়িটাতে তুলে দিয়ে যাও
এই রোকো, এই রোকো
পৃথিবীর গাড়িটা থামাও
আমি নেমে যাবো
আমার টিকিট কাটা অনেক দূরে
এ গাড়ি যাবে না, আমি অন্য গাড়ি নেবো”,,,
–সলীল চৌধুরী।
জীবনের গতিপথ জোর করে বদলানো যায়না। পৃথিবীতে আট’শো কোটি মানুষ রয়েছে। এক আধটু মিল থাকলেও এই আট’শো কোটি মানুষ কেউ কারো মত নয়। কোনদিক দিয়েই নয়। না চেহারা, না কথা বলার ঢঙ, না চলাফেরা, না পছন্দ অপছন্দ। কারো রসায়ন কারোর সাথে এক আধটু মিলে যায় ঠিকই কিন্তু শতভাগ কখনোই মেলেনা। শতভাগ কেন, পঞ্চাশ ভাগ কি মিলে যায়? এ জগতে কেউ কারো মত নয়। এ জগতে মানুষ মুলতঃ একা। ছন্নছাড়া ঘর খুঁজে পেলেও সে ঘরে তার দম হয়ে আসে। ঘরপ্রিয় মানুষেরা অপরূপ বিচিত্র প্রকৃতির নান্দনিকতায় কিছুক্ষণ জগতের আনন্দযজ্ঞে মুগ্ধ হয়ে আপ্লুত হয় কিন্তু পরপরই তার বাড়ি ফেরার তাড়া। স্বল্প সময়ের জন্য স্বস্তি কিংবা মুক্তির বুকভরা শ্বাস নিলেও আসলে কেউই তার নিজস্ব রসায়ন ছিন্নভিন্ন করে ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনা। সে চলে, সাথে চলে তার মুদ্রাদোষ।
“পথে চ’লে পারে- পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারিপাশে !
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে !
আমি থামি,-
সে-ও থেমে যায় ;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?”
–জীবনানন্দ দাশ
নিজেরই মুদ্রাদোষে একা ঘুরে ঘুরে এক সময় বিকেল নামে।
তারপর সন্ধ্যা…
কতক্ষণ যাবৎ ঘুমোচ্ছি তা বলা মুশকিল। ঘুম ভেঙে দেখলাম, একটা নোংরা ঘরে শুয়ে আছি। সেখানে আরও কয়েকজন মেয়ে মহিলা আছেন। তাদের পরনে হরেকরকম পোষাক। স্থুলকায় একজন মধ্যবয়সী মহিলা আবার একটি নোংরা শাড়ি দোঁপ্যাচ করে পরে আছে আর রাগতঃ দৃষ্টিতে একই দিকে তাকিয়ে আছে। রঙ্চঙ্গা পোশাক পরিহিত দুটি মেয়ে অনবরতঃ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে আর খিলখিল করে হেসে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। একজন বুড়ো বয়সের মহিলা অনবরতঃ কেঁদে চলেছে। আরেকজন মাঝবয়সী মহিলা দেয়ালে মাথা ঠুকছে। আশ্চর্য, এখানে যারা আছে তারা কেউ ওনাকে ঠেকাচ্ছে না। বুড়ো মহিলা যে এমন আকুল হয়ে কাঁদছে তাতেও কারো কোনো দুঃখবোধ হচ্ছে না। কি চলছে এখানে? এটা আবার কোন জায়গা? রাগতঃ মহিলাকে জিগেস করবো? না থাক, উনি তাতে আরও রেগে যেতে পারেন। তাহলে হাস্যরতঃ মেয়ে দুটির একজনকে জিগেস করি? তাইই ভাল। অশ্লীল ভাবভঙ্গী করলেও এরা অন্ততঃ রেগে যাবেনা।
উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠুকে গেল। ঘরের সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে। দেয়ালে মাথা ঠুকছিল যে মহিলা তিনি মাথা ঠুকা বন্ধ করে আমাকে দেখছেন। বুড়ো মহিলা কান্না থামিয়ে দিয়ে আমাকে দেখছেন। রাগতঃ দৃষ্টির মহিলা আরও রেগেমেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখনই হাস্যরত মেয়ে দুটির একজন বললো,
কি খবর মহারাণী? নেশা ছুটছে?
নেশা?,,,
মানে কি?,,,
হুট করে মনে হলো, মহুয়া কোথায়?
আজকাল কলেজে আমার অনেক বান্ধবী হয়েছে। বিভিন্ন স্ট্যাটাসের বান্ধবী আছে এ তালিকায়। মহুয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। মহুয়ার বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তার মা আরেকজনকে বিয়ে করে এখন আমেরিকা প্রবাসী। মহুয়ার বাবা একজন প্রখ্যাত কবি। বেশিরভাগ সময় তিনি বাড়িতেই থাকেন। বিশাল লাইব্রেরি ঘরেই আসলে তার দিনরাত্রি কাটে। খাবারদাবার ওই ঘরেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি কখন ঘুমোন আর কখন জেগে থাকেন একথা মহুয়া জানেনা। আর্কিটেকচার তার সাবজেক্ট হলেও তিনি জীবনে কখনো এ বিষয়ে কোনো কাজ করেন নাই। ভীষণ অগোছালো মানুষ। এমনকি পিতৃপ্রদত্ত লাইব্রেরীটাও গোছানো নয়। যদিও সেখানে বিশাল বিশাল কাঠের সেলফ আছে। মই আছে। সেগুলো অবশ্য পরিপূর্ণ হয়ে এখন মেঝেতেও বইয়ের স্তুপ। দুচারটা টেবিল চেয়ার যা আছে সেগুলোও বইয়ের পাহাড়ে পরিনত হয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে। একটি ডিভানের মত আছে সেখানেও বই। সেই ডিভানের একপাশে কোনরকম জায়গা করে নাকি ভদ্রলোক ঘুমান। মহুয়ার বাবা কখনোই বসে বই পড়েন না। তিনি খুব কমই বসেন বা দাঁড়ান বা হাঁটাহাঁটি করেন। তবে ডিভানের উপর যখন উবু হয়ে বসে কিছু লেখেন তখন আলি চাচা মহুয়ার ফুপ্পিকে জানায়। পরদিন ফুপ্পি লাইব্রেরিতে ঢুকে ছেঁড়াবেড়া সদ্য লিখিত কাগজপত্র কুঁড়িয়ে নিয়ে যান। ওগুলোই তিনি কবিতার বই হিসাবে নিজেদের প্রকাশনা থেকে পাবলিশ করেন। মহুয়ার বাবা কোনো মুখবন্ধ লিখে দেন না, কোনো ভুমিকা লেখেন না এমনকি কবিতাগুলোর নামও দেন না। ওগুলো সবই মহুয়ার ফুপ্পি করে। বইয়ের মলাটের ভেতরে ছোট্ট করে কবি পরিচিতি থাকে।
মহুয়ার বাবা কখনও কোনো সাংবাদিক বা দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করেন না। তার লাইব্রেরিতে ল্যান্ডফোনের লাইন নাই। এমন কি তিনি জানেনই না, তার কবিতার বই ছাপা হয়। বর্তমানে তিনি এদেশের একজন প্রখ্যাত কবি। পত্র পত্রিকায় মহুয়ার বাবার জীবনাচরণ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়।
মহুয়া আমাকে এসব বলেছে। মহুয়া আরো বলেছে, তার এই “মহুয়া ” নামটা একদম পছন্দ নয়। কিরকম সেকেলে। বিয়ের পর বাবা মা হানিমুনে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল। বোলপুরে তারা প্রায় আড়াই মাসের মত ছিল। ওখানকার সাঁওতালদের সাথে ওঁনারা দিনরাত কাটাতেন। মহুয়ার মধু খেয়ে নাচতেন। এজন্যই মেয়ের নাম দুজনে মিলে রেখেছিল “মহুয়া “।
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করা মহুয়ার অপরূপা সুন্দরী মা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন মহুয়ার বাবাকে। ঠিক কী কারণে মহুয়ার মা তার বাবাকে ডিভোর্স দিয়েছেন তা কেউই জানেনা। কোনো পক্ষ থেকেই কোনো মামলা মোকাদ্দমা হয় নাই। কাগজে অবশ্য নারী নির্যাতনের কারণ দেখানো হয়েছে যা দেখে এই বিশাল বাড়ির অগনিত বুয়া আয়া শেফ দারোয়ান মালি ম্যানেজার, সুপারভাইজার, ড্রাইভাররাও অবাক হয়েছিল। কারণ, মহুয়ার বাবা এ জীবনে একটি পিঁপড়েও কখনো মারেন নাই।
মহুয়ার ধারণা, তার বাবা মায়ের মধ্যে পার্সোনালিটি কনফ্লিক্ট এটা। আমি জিগেস করেছিলাম, পার্সোনালিটি কনফ্লিক্ট কি? মহুয়া অবশ্য নিজেও জানেনা। দরজার আড়াল থেকে তার ফুপ্পি ও কাকুকে বলতে শুনেছে। বাবা মায়ের ডিভোর্সজনিত কারণে বছর ১৫ পর মহুয়ার কাকু দেশে এসেছিলেন। কাকু আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার। কাকীমাও ইঞ্জিনিয়ার। কাকীমা আমেরিকান হলেও মহুয়াকে খুব খুব আদর করেছেন যে কদিন ছিলেন৷। মহুয়ার কাকাতো ভাই তখন দুবছরের। কাকিমা হ্যারি মানে হ্যারল্ড আর মহুয়াকে একসাথে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। মহুয়ার মা মহুয়াকে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু জোরাজুরি করেন নাই। মহুয়ার বাবা, কাকা ও ফুপিও মহুয়াকে দিয়ে দিতেন। তাকে রাখবার জন্য জোরাজুরি করেন নাই। সবকিছু ঠিকঠাক, একদিন সকালে মহুয়ার মা এসে তার ফুপিকে বললেন,
মহুয়া এখানেই থাক। ফুপি বললেন, তোমার ইচ্ছা। মহুয়ার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাঁচ বছরের মহুয়াকে কোলে তুলে আদর করে বললেন, তোমার বাপির চুলগুলো আঁচড়ে দিও সোনা। সে চুল আঁচড়ায় না। চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়।
মহুয়া “হ্যাঁ” সুচক মাথা নেড়েছিল।
হঠাৎ আবারও আমি মহুয়াকে খুঁজতে শুরু করলাম। ওই মেয়ে দুজনকে জিগেস করলাম, মহুয়া কোথায়? তারা কিছু একটা বলতে যাবে, এরমধ্যে তালা খোলার ধাতব শব্দ। একজন মহিলা পুলিশ তালা খুলে গরাদের দরজা ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আসো।
আমি বেরিয়ে আসলাম। ও এটা তো থানা। মহুয়ার ফুপি আর আমার বাবা টেবিলের একপাশে বসে আছেন। টেবিলে ফাইলের স্তুপ সাথে চায়ের কাপ। খানিকটা চা পড়ে টেবিলে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেখানে কয়েকটা মাছি। কেউ বসে আছে কেউ বা উড়ে বেড়াচ্ছে। এতো নোংরা টেবিল আমি জীবনেও দেখিনি। অপর পাশে ভুঁড়িওয়ালা এক পুলিশ বসে আছে। পান চাবাচ্ছে একই সাথে চাও খাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। আবার একে ওকে ধমকও দিচ্ছে। ধমক দেবার সময় লোকটার মুখ থেকে পানের লাল পিক ফুলকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে। ঠোঁটের দুধার বেয়ে পানের পিকও বেয়ে পড়ছে। আমার মনে হলো, যে ঘরটাতে এতক্ষণ ছিলাম সে ঘরটা এই লোকটার চেয়েও পরিস্কার। লোকটা আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন এখনই আমাকে খুন করে ফেলবে। আমিও লোকটার দিকে সরাসরি কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকলাম। একটা গামছার মত নোংরা কাপড় দিয়ে মুখ মুছে লোকটা পান চাবাতে চাবাতে বাবাকে বললো, স্যার, মেয়েকে সামলায় রাখবেন। এমনিতেই তো আপনার বড় ছেলে জেলে। আপনার তো আর কোনো মান ইজ্জত থাকলো না।
মহুয়ার ফুপি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালো। ফুপির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। জানিনা কি হলো, লোকটা ফুপির দিকে তাকিয়ে বললো,
স্যরি ম্যাডাম,,,
বাবা আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আমি সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম।
দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিতে নিতে গুনগুন করছি।
“ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু–
দিনের তাপে রৌদ্র জ্বালায়
শুকায় মালা পুজার থালায়
এই ম্লানতা ক্ষমা করো–
ক্ষমা করো
ক্ষমা করো প্রভু,,, “
ড্যানি নামের ছেলেটা অনেককিছু জানে। সে খুব জোরে বাইক চালাতে জানে। গাড়িও চালায়। আবার মন খারাপ হলে কিভাবে মন ভাল করতে হয় এটা সবচেয়ে বেশী জানে। সে মহুয়ার দুরসম্পর্কের কাজিন। আমি মহুয়া আর ড্যানি তাই প্রায় প্রতিদিন ড্যানির এক বান্ধবীর বাড়িতে আড্ডা দেই।
ড্যানির সাথে পরিচয় হবার পর প্রথম দিন
ড্যানিকে জিগেস করেছিলে,
–ড্যানি, তুমি কি মন ভাল করার সাইকোলজিক্যাল কোর্স করেছো?
–আরেহ নাহ, এটা গড গিফ্টেড
–মানে অলমাইটি একদিকে মন খারাপের ইনগ্রাডিয়েন্টস দেন আবার আরেকদিকে গ্যার্বেজ পরিস্কার করার সুইপিং সিস্টেমও কাউকে কাউকে দিয়ে দেন, এমন কিছু?
–প্রায় এরকমই ব্যপারটা।
–তুমি তাহলে সুইপারের গুন নিয়ে জন্মেছ?
–হয়তোবা।
–তোমার কি ধারণা, আমার মন খারাপের কারণগুলো গার্বেজ?
ড্যান থতমত খেয়ে আমার হাত চেপে ধরলো।
বিরক্ত হয়ে বললাম, হাত ছাড়ো, ব্যথা পাচ্ছি।
এরপর আমরা অনেকক্ষণ চুপ করে একসাথে বসে থাকলাম।
“এই শহুরে রাতি জাগে ভীষণ একা
কোন দালানের একলা মেয়ে বেলকুনীতে দাঁড়ায় একা
একটু বসে, একটু খানি আকাশ দেখে ঢুকরে কাঁদে
কেন কাঁদে কেউ জানেনা
সেও জানেনা, তবুও কাঁদে
কেমন যেন নেশায় কাঁদে
রন্ধ্রে কাঁদে, হৃদয়খানা খুঁড়ে কাঁদে।
ঘুমের মাতাল গন্ধে কাঁদে
পাগল করা মন্দে কাঁদে
ছুঁয়ে দেখার দ্বন্দ্বে কাঁদে
বুনো নাচের ছন্দে কাঁদে
কেন কাঁদে?
চখাচখির আদিম পদ্যে একলা রাতে
একলা মেয়ের পাঁজর ভাঙা পদ্মটাতে
কেউ জানেনা, সেও জানেনা
পদ্মমেয়েও বণ্য স্বাদে
একলা কাঁদে।
পদ্মমেয়েও আদিম সাধে
একলা কাঁদে।।”
ড্যানি আমার আর মহুয়ার মন ভাল করে দেয়। অন্ততঃ চেষ্টার ত্রুটি করেনা। তার গড গিফ্টেড গুনের সাথে পার্থিব কিছু দ্রব্যসামগ্রীর সমন্নয় ঘটাতে হয়। তখন আমি ড্যানকে বলি, এগুলোও গড গিফ্টেড। শুধু এরা তোর ট্যালেন্টসকে ব্লসম করছে। ফাল্গুনে যেমন অশোক পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়া ব্লসম হয়, তেমনি।
ড্যান আমার দিকে প্রচন্ড মমতা ভরে তাকিয়ে থাকে।তারপর একসময় বলে, না রে মণি, আমি কৃষ্ণচূড়া ফোটাতে পারি না। আমি ধুতুরা ফুল ফোটাই। আমি বলি, ধুতরা ফুলও তো ঈশ্বরের সৃষ্টি।
“কোমল গান্ধার”।
এইসব বিষমধু নিয়েই অবিরাম আবর্তিত হচ্ছে এ জগৎ।
ড্যান চুপ করে থাকে। আমার হাতটা টেনে নিয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকে। আমি আবারও বলি, হাত ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি।
আমাদের সাথে অবশ্য ড্যানির বান্ধবীও থাকে। যদিও মহুয়া ড্যানিকে বারবার বলে, দ্যাখ ড্যান, আমার মন আসলে একদমই খারাপ না। মন কেন খারাপ হবে? কোনো কারণই নাই। হি হি হি,,,
মহুয়া যখন এইকথাগুলো বলে তখন পুরো ঘর ধোঁয়ায় ঝাপসা থাকে। আগেও কয়েকবার খেয়াল করেছি, ঘর ধোঁয়ায় ভরে না উঠলে, ঝাপসা হয়ে না গেলে মহুয়া একথাগুলো বলেনা। আর আমি তখন মেঝেতে আঁধশোয়া ড্যানির কোলে আমার জিন্স পরা একখানা পা তুলে দিয়ে আরামে মেঝেতে আঁড়াআঁড়ি ভাবে গা এলিয়ে দেই। ড্যান বলে, তোর পা এতো সুন্দর রে মণি!!! তারপর আমার পায়ের পাতা, পায়ের আঙ্গুল নিয়ে এমনভাবে খেলতে থাকে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে।
প্রায় মাস দুই কি আড়াই হবে মহুয়ার এই কাজিন মানে ড্যানি তার ঈশ্বর প্রদত্ত গুনের মাধ্যমে আমাদের এমন এক রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে কোনো দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনা বিরহ বিচ্ছেদ কিছুই নাই। আছে কেবল স্বপ্নিল স্বর্গরাজ্য যেখানে ড্যান পিয়ানো বাজায়, মহুয়া খিলখিল করে হেসে জলতরঙ্গের সুরের লহরী তোলে, পিউ মানে পিয়সি মানে ড্যানির বান্ধবী হেলেদুলে নৃত্যের মুদ্রায় সাগরের ঢেউয়ের ছন্দ তোলে। তখন পিউকে আমার সেই বিরহকাতর মৎসকুমারী মনে হয়। যে রাজকুমারকে ভালবেসে নিজের জাত খুঁইয়েছিল আর মানুষ হবার প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষায় মানুষ হয়ে খুঁইয়েছিল রাজকুমারের প্রেমাতুর দৃষ্টি। পিউ যেন সেই দুঃখিনী প্রেমহারা পরাজিত মৎসকন্যা।
আর আমি? আমি কেবল চোখ বুজে শব্দহীনভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি। ড্যানি অবশ্য মাঝেমধ্যে জিগেস করে, কেন হাসছিস মণি? ঠোঁট বাঁকায়ে আরও একটুখানি বেশী হেসে বলি,
–কোমল গান্ধার,,,
সেদিন কিজানি কী মনে হলো, আমি, ড্যানি আর মহুয়া ভরদুপুরে পিয়সিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আবাসিক এলাকার রাস্তা। রৌদ্রছায়ার খেলা ঝকঝকে রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে শুরু করলাম৷ মেইনরোডের কাছাকাছি আসতেই এক লকবকে পুলিশ যার কোমড় থেকে প্যান্ট প্রায় খুলে পড়ে পড়ে অবস্থা তাকে একটা মাঝারি মাপের ঘুষি মারলাম। পুলিশ বেচারা কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট টেনে তুলতে তুলতে আমাদের পথ আটকে দাঁড়ালো।
আমি জড়ানো কন্ঠে চিৎকার করে বললাম, শালা পেপেগাছ, শালা পুলিশের বাচ্চা পুলিশ আমাকে চিনিস? একদম খুন করে ফেলবো। সর, সামনে থেকে সরে যা। বলেই পুলিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মহুয়া আর ড্যানি আমাকে ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। ওদিকে, রাস্তা থেকে একটা দশ ইঞ্চি ইটের অর্ধেকটা ততক্ষণে তুলে পুলিশের মাথা বরাবর মেরে দিয়েছি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইটের আঘাত পুলিশের মাথায় না লেগে লাগলো তার বাঁ কাঁধে। পুলিশ কঁকিয়ে উঠলেও তার অন্য হাত দিয়ে আমাকে ঠেকাচ্ছে। এর ফাঁকে সে তার কৃষ্ণ বাঁশিটিও ততক্ষণে বাজিয়ে দিয়েছে । হুড়মুড় করে কোত্থেকে অনেকগুলো পুলিশ চলে আসলো। প্রথমে লাঠিচার্জ তারপর একটি জিপে তুলে ফেললো আমাদের । জিপের দুলুনীটা দোলনার মত। দারুণ লাগছিল দুলতে। এই পুলিশগুলো আমাদের মারলেও আসলে তারা এতো খারাপ নয়। কি রকম দোল দিচ্ছে। ঠিক মায়ের মত ভাল,,,
বড় ভাইজানের মত,,,
আবেগাপ্লুত হয়ে একসময় আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
মহুয়া আর ড্যানিকে মহুয়ার ফুপ্পি এসে নিয়ে গেছেন। আমাকে আমার গার্ডিয়ান ছাড়া জামিন দেবে না তাই মহুয়ার কাছ থেকে আমাদের বাসার ল্যান্ডফোনের নাম্বার নিয়ে ফুপ্পি বাবাকে জানিয়েছেন এবং থানায় নিয়ে এসেছিলেন।
থানা থেকে বেরিয়ে বাসায় ফেরার আগে মহুয়ার ফুপ্পি মুখ নিচু করে নিচুস্বরে বাবাকে বললেন,
–ভাই সাহেব, আমার অন্যায় হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন। মহুয়াকে ঠিকমতো দেখাশুনা করতে পারছিনা বলেই এরকম অঘটন ঘটেছে। মহুয়ার বাবা কাকু আর মায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। আপনাকেও মুখ দেখাতে পারতাম না। কেবল, থানাতে আসতে হলো বলে,,,
আমাকে ক্ষমা করবেন ভাই সাহেব।