উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১)
জাতিস্মর
আমার ছেলেবেলা খুবই বর্ণাঢ্য। বাবা ও তিন ভাইবোনের কাঁধে কাঁধে আমি বড় হয়েছি। কিন্তু মা কোনো আদিখ্যেতা দেখাতেন না। তবে মা তীর্যক দৃষ্টিতে যে প্রচন্ড মমতা ও তৃপ্তি নিয়ে আমাকে দেখতেন তা আমার দৃষ্টি এড়ায় নাই। ঘুমের ঘোরে টের পেয়েছি, মা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন বা চুপচাপ শুয়ে থেকেছেন। স্কুলে ক্লাস করছি অথবা বিকালে খেলছি, হঠাৎ উদাস, আনমনা হয়ে ভাবতাম, ঘুমিয়ে থাকলে মা এতো আদর করে অথচ জেগে থাকলে যেন আমাকে দেখেই না।
কিন্তু কেন?
মা কি চায় না, তাঁর আদরের কথা আমি জেনে যাই? মাকে জড়িয়ে ধরে কতবার ঘুমোতে চেয়েছি অথচ মা বিরক্ত হয়ে কঠিন কন্ঠে বলেছে, আপার সাথে ঘুমোও, পড়তে বসো! খেলতে যাও! অথবা, সেলাই করছি দেখছো না? এখান থেকে যাও।
ভয়ানক মন খারাপ করে সরে এসেছি। তারপরই মনে হয়েছে, একটি ছোট্ট পুঁজি তো আমার আছেই। রেজাল্ট ভাল হলে মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।
আহা,
“মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে”…
শৈশবে মায়ের কোলে বসতে না পারার তীব্র বেদনা ছাড়া আমার আর কোনো কষ্ট ছিলনা। ভুল বললাম, রেজাল্ট ভাল হলে আমাকে নিয়ে মায়ের আত্মহারা আনন্দের সাথে আমার জন্ম ইতিহাস মুহুর্মুহু বলে যাবার বিভৎস মুহুর্তগুলো মায়ের মধুর হাসিকে ছাপিয়ে চাঁদের বদলে আমাকে দিত ঘোরতর নিকষ কালো অমাবস্যা। একাকি ভাবতে থাকি, আমি গৌবব ফেরি করার এক ফেরিওয়ালা মাত্র।
কেবল মেধা দিয়ে, বিদ্যা দিয়ে, গা ভরা রূপ দিয়ে মাকে মুগ্ধ করবার জন্যই আমি যুদ্ধ করে এই পৃথিবীতে এসেছি। একটু এদিক সেদিক হলেই খসে পড়া তারার মত আমাকেও খসে পড়তে হবে। চাঁদ মুখের চাঁদহাসি দেখবার, ছুঁয়ে দেবার কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এখানে নাই। মানুষের সাথে ফড়িং কিংবা দোয়েলের ইস্পাত কঠিন দেয়ালের অবিরাম বিভক্তি এ নির্মম গ্রহের নিয়তী ।
“যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের –
মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা” ।।
ক্লাস সেভেন/এইটে একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম। ছেলেটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অসম্ভব সুন্দর গান গাইতো। পাড়ার বড় ভাইদের সাথে আড্ডা দিতে আসতো প্রতি বিকালেই। বিকালে আমরা মানে ছোটরা মাঠের একদিকে খেলতাম আর বড়ভাইয়ারা অন্য প্রান্তে আড্ডা দিতো। তারা মুরুব্বিদের লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে কোনো বাড়ির পেছনের জঙ্গলার আড়ালে যেতো। আমাদের ক্রিকেট বল বা ফুটবল মাঝেমধ্যে সেই জঙ্গলায় চলে যেতো। আমাদের মধ্যে কেউ দৌঁড়ে সেখান থেকে বল নিয়ে আসতাম। আমি সুযোগে থাকতাম, যখন ঐ ভাইয়া একা সিগারেট টানতে যাবে তখন উরাধুরা লাথি, পাঞ্চ কিংবা ফিল্ডিংয়ে বল উইকেটের দিকে না ছুড়ে জঙ্গলার দিকে ছুড়ে দিব। যেন হাত বেঁকে বল জঙ্গলায় চলে গেছে। আর আমি আনতে যাব।
একদিন এমন করেছি, বল আনতে গেছি, তখন আমার জীবনের প্রথম প্রেমিক গানওয়ালা ভাইয়া আমাকে ডেকে ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, তুই আর বল নিতে আসবি না, অন্য কাউকে পাঠাবি। আর শোন, সন্ধ্যায় গানের আড্ডায় আমি আর কখনই গান গাইবো না। কারণ, তুই যে ইচ্ছা করে জানালার পাশে বসে পড়ার ভান করে আমার গান শুনিস, মাঝেমধ্যে পর্দা সরিয়ে যে আমাকে খুঁজিস আমি তা জানি। তোকে যেন আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।
সেদিনের পর আমি আর বিকালে খেলতে বেরোয় নাই।জানালার পাশে পড়তে বসি নাই। মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত কোনো গান শুনি নাই। টিভি দেখি নাই।
গরমের সন্ধ্যায় মা জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেন আর আমি নির্দিষ্ট সেই জানালার পর্দা টেনে দিতাম। মা বিরক্ত হয়ে জিগেস করতেন, টেনে দিলে কেন? আমি মনে মনে উত্তর দিতাম, তোমার মত আরও অনেকেই আমার উপর বিরক্ত মা। আমি বুকভরা ভালবাসা, মমতা, স্নেহ, প্রেম, আকুলতা নিয়ে ভুল গ্রহে চলে এসেছি। পথভোলা পথিকের জন্য এ গ্রহে কোথাও মল্লিকা-মালতীগুচ্ছ নেচে ওঠে না। কেউ তার সুরের ধারার পাশে আমাকে একটু বসতে দেয় না। আমি তোমাদের পৃথিবীতে অপাংতেয়, অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর এক অনাবশ্যক, বোঝা ।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট ভাল হলো। সবাই খুশী। চারদিকে মিষ্টি দিচ্ছেন মা। ঘরে এসে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকেও মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে। মা বিরিয়ানি রেঁধে আশেপাশের কয়েকঘর প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। মনে হচ্ছে, বাসায় লাগাতার ঈদ চলছে। ভীষণ ভাল লাগছে এই ভেবে যে, এই বিরামহীন আনন্দের উপলক্ষ “আমি”।
কিন্তু কী আশ্চর্য, পুরো দুবছর পর আমি গান শুনতে শুরু করলাম৷ টিভির ইংরেজি সিরিয়ালগুলোও দেখতে শুরু করলাম। এমনকি, একদিন আপার লাল পেড়ে সাদা গরদের শাড়িখানাও পরে ফেললাম। চোখে মোটা করে কাজল আর কপালে সিঁদুরের টিপও দিলাম। আপা তখন ভার্সিটিতে। ভাইয়েরাও ভার্সিটিতে। আব্বা অফিসে, মা রান্নাঘরে। বুয়া কাজ করে চলে গেছে। বাসা মোটামুটি শুনশান,নিরব।
নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নায় দেখছি, বারবার দেখছি, বিভিন্নভাবে দেখছি। নায়িকাদের মত মুখভঙ্গি করে দেখছি। অপর্ণা সেনের মত রোমান্টিক দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে দেখছি। সুচিত্রা সেনের মত ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছি। কবরীর মত মিষ্টি হাসি দিয়ে দেখছি । একবার খোঁপা করে দেখছি তো আবার খোঁপা খুলে চুল এলো করে দেখছি। চুলে গোঁজা গন্ধরাজ দুটো ক্লিপ দিয়ে আটকেছি কিন্তু চুলের ভারে তারা ঝুলে পড়ছে বারবার, তাও দেখছি। ওমা, আমার চুল এতো লম্বা হলো কবে! খোঁপা যখন খুলে পড়ছে তখন পিঠ ভর্তি কালো ঘন ঢেউ খেলানো চুল। হ্যাঁ, সত্যিই তো! আমি পেছন ফিরে সুচিত্রা সেনের মত ঘাড় বেঁকিয়ে আয়নায় দেখছি। এদ্দিন তো খেয়াল করিনি!! গন্ধরাজগুলো খোলাচুল আঁকড়ে ধরে দুলছে । আনাড়ি সাজে কপালের লাল টিপ কি খানিক বেঁকে গেছে? হ্যাঁ, তাইতো! আয়তনেত্রে মোটা কাজল তখন মোটামুটি লেপ্টে ছ্যারাব্যারা অবস্থা ।
“আয়তনেত্র,..
আ_য়_ত_নে_ত্র…”
শব্দটি পড়েছি, লিখেছি বাংলা পরীক্ষায় কিন্তু কখনও দেখিনি। “আয়তনেত্র” দেখতে কেমন? আয়নায় যে চোখদুটি দেখছি এখন, সেই রকম?
কিজানি, আমার কোনো ধারণা নেই।
কিন্তু হতেও তো পারে।
অবাক বিস্ময়ে নিজেকে দেখছি। কোন অমরার অমরাবতী এই মুহুর্তে, আজ, এখানে দাঁড়িয়েছে এই আয়নার সামনে! আমার বিস্মিত চোখগুলো আরো বড় বড় হয়ে তাকে দেখছে। আমার বিব্রত, কাজল ল্যাপ্টানো চোখদুটো বিস্ময়ে বিহ্বল…
স্বর্গের অপ্সরাদের রূপের কথা পড়েছি।
তারাও কি এতো রূপসী?
কিজানি, জানিনা আমি। তাদের তো মুনি-ঋষি-দেবতারা ছাড়া আর কেউ দেখেনি। আর ইন্দ্রের সভায় যারা থাকেন, তারা দেখেছেন।
আচ্ছা, ইন্দ্রের সভায় সবচেয়ে রূপসী কে?
ইন্দ্রানী? উঁহু উর্বশী? উঁহু, মেনকা, রোহিনী,,,
উফ, আমি কি করে জানবো!!!
আচ্ছা, ইন্দ্রের বাড়ি কোথায়?
ইন্দ্রপুরীতে?
ইন্দ্রাণী সে রাজ্যের রাণী?
ইন্দ্ররাজের পাশে সিংহাসনে বসে অপ্সরাদের নাচ দেখেন?
নৃত্যের তাল কেটে গেলেই তো শাস্তি।
এক্কেবারে ছুড়ে ফেলবেন মর্তলোকে।
তারপর স্বর্গ থেকে নির্মম বিদায়, করুণ বিচ্ছেদ।
“ভরা থাক, ভরা থাক স্মৃতিসুধায়
বিদায়ের পাত্রখানি–
ভরা থাক, ভরা থাক,
মিলনের উৎসবে তায়
ফিরায়ে দিয়ো আনি।।
ভরা থাক, ভরা থাক”…
আচ্ছা,
আমাকেও কি শাস্তি দেয়া হচ্ছে?
কিন্তু, কেন?
নৃত্যে তাল কেটেছিলাম?
প্রিয়তম প্রেমিক সুর্য্য প্রদক্ষিণে গিয়েছিল তাই উদাস ছিলাম? মন ছিলনা নাচের তাল_লয়_মুদ্রায়?
হায়, কী নিদারুণ মর্মবেদনা নিয়ে সভায়ে নাচতে গিয়েছিলাম!
“তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে
চলে এসেছি।
কেউ কি তা জানে,
ওগো, কেউ কি তা জানে।।
তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,
আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া–
মনে মনে মনের কথাখানি
বলে এসেছি
কেউ কি তা জানে॥”…
কেউ কি তা জানে
বলো, কেউ কি তা জানে …
আচ্ছা,
ইন্দ্রপুরীই কি তাহলে আমার আসল ঠিকানা???
চুলগুলো আঁচড়ে সামনে একপাশে, বাঁ কাঁধে এনেছি ।
অনবরতঃ এটা সেটা ভাবছি। আজকের দিনটা একান্তই আমার। আজ আমার “আমি”কে আবিষ্কারের দিন। আবিস্কারের উল্লাসে কেঁপে কেঁপে উঠছি। আজ ক্ষণে ক্ষণে এই মহাবিশ্বের সব না ভাবা ভাবনাগুলো ভেবে নেবো। যেন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ডানা মেলছে।
আমি গুনগুন করছি–
“ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে
আমারে কোন কথা সে যায় শুনিয়ে–
ঘরেতে ভ্রমর এলো উ হু হু হু হু,,,, “
কলিং বেল বেজে উঠলো।
এই এক যন্ত্রনা হয়েছে আজকাল। আমার রেজাল্ট হবার পর সময় নাই অসময় নাই, লোকজন বাসায় আসছে। কবে যে এটা থামবে? ইন্টারে আর তেমন পড়বোই না। রেজাল্টও ভাল করবো না। এই যন্ত্রনা থেকে তো বাঁচা যাবে অন্ততঃ ।
আবারও কলিং বেল।
–দরজায় কে দেখো তো মণি ?
মা আমাদের দু ‘বোনকে নাম ধরে ডাকেন না।
“মণি” বলে ডাকেন।
আমি মোটামুটি বিপদে পড়ে গেলাম।
এই কিম্ভূত কিমাকার সাজগোঁজ নিয়ে দরজা খুলবো কিভাবে?
যে কলিংবেল বাজাচ্ছে সে তো ভড়কে যাবে।
অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
উফফ, তখন আবার বাথরুম থেকে পানি ভর্তি বালতি আনো, মাথায় পানি ঢালো…
যাক, আজ আমার দিন।
মা আবারও বললেন,
–দরজাটা দেখো না মণি,,,
অগত্যা দরজা খুললাম।
দরজা খুলেই হীম হয়ে গেলাম।
আমার বিস্ফারিত চোখদুটো যেন কোটর থেকে ছিঁটকে পড়ছে। দরজার ওপারে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনিও ঘাবড়ে গেলেন।
ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন গানওয়ালা ভাইয়া ।
অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন…
শত সহস্র বছর ধরে দেখছেন তো দেখছেনই।
ইতস্ততঃ
বিব্রত,,,
বিক্ষিপ্ত —
আমি আর পারলাম না।
চোখ নামিয়ে নিচু করে একপাশে মুখ কাত করে থাকলাম।
সহসাই তিনি কম্পিত কন্ঠে নিচু স্বরে বললেন,
–কী রে, ভয় পেয়েছিস? ইয়ে মানে, ভয় পেয়েছো?
আবারও ইতস্ততঃ, বিব্রত,,,
–এদ্দিন বরিশালে ছিলাম। চাকরি হয়েই পরদিনই জয়েনিং। তাই খালাম্মাকে সালাম করা হয় নাই। আরেহ, জানানোই তো হয়নি।
–খালাম্মা কই? রান্নাঘরে?
উনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। মাকে সালাম করবেন বলে।
আমি একপায়ে গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। মা সহ উনি ঘরে আসলেন। আমাকে দেখে মা তো থ! নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, যাও মণি, মিষ্টি নিয়ে এসো। আমার পা চলছে না। মেঝের সাথে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে।
মা যেন অনেক দুর থেকে আবারও বললেন,
-মণি, মিষ্টি নিয়ে এসো তো ।
আমি ফ্রীজ থেকে মিষ্টি বের করে কাঁচের পিরিচে সাজাতে লাগলাম। চুলোয় কি জানি ছিল, মা তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসলেন। মা আবারও একটু অবাক হয়ে থমকে আমাকে এক ঝলক দেখলেন। বললেন,
–মিষ্টি নিয়ে যাও আমি তরকারীটা দেখি।
আমি সোফার একধারে থতমত খেয়ে বসে আছি আর উনি মিষ্টির পিরিচ আর কাটা চামচ হাতে বসে আছেন।
মা মনে হয় ডালে ফোড়ণ দিয়েছেন। ঝাঁঝালো গন্ধে আমার দম আটকে আসছে। আমি প্রাণপণে হাঁচি ঠেকানোর চেষ্টা করছি।
হঠাৎ আমাকে জিগেস করলেন, তুই, মানে, তুমি না ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলে?
—হ্যা হ্যা হ্যা চ্চু…হ্যাঁ।
— পাশ করেছো ?
— জ্বী।
— খু-উ-উ-ব ভাল।
উনি তোতলাচ্ছেন কেন!!?
বুঝবার চেষ্টা করছি।
এবার আমার দিকে সরাসরি তাকালেন।
— এতো সেজেছো যে?
আরেহ, তোমাকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আগে তো কখনোই তোমাকে সাজতে দেখিনি!
এরপর আরও অবাক হয়ে আমার খোলা চুলের দিকে তাকালেন।
— একি, তোমার চুল এতো লম্বা !!!
আমার মনেই নেই, কখন আমার হাত খোঁপাটা খুলে পিঠে কাঁধে, সামনের দিকে চুল এলিয়ে দিয়েছিলাম । আমি বুঝতে পারিনি , আমার চুলে ক্লিপ দিয়ে আটকানো গন্ধরাজদুটো খানিক আলগা হয়ে আমার বাঁ গাল বরাবর দুলছে ।
উনি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে আবারও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমাকে দেখছেন। আমার ভারি অস্বস্তি হচ্ছে । ছি ছি কী লজ্জা, কী লজ্জা। এভাবে সাজবার কী দরকার ছিল? এখন নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। সাবলীল হবার অভিনয় করছি।
চটপট করে স্মার্টলি জিগেস করলাম,
–চা খাবেন? চা বানিয়ে আনবো ?
–উঁহু, না …
উনি তাকিয়ে আছেন এখনও।
আমি এবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।
শত শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাকে দেখা ওনার শেষ হচ্ছে না। মহাকাল যেন থমকে গেছে। আমি অযথা পায়ের নখ দিয়ে মেঝের মোজাইক খুঁটছি।
আমার মন তখনও গুনগুন করে যাচ্ছে,
“ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে”..
আর পারলাম না।
যাকে এক পলক দেখবার জন্য কতই না ছল করেছি, জঙ্গলার নোংরা জমে থাকা পানিতে পা নোংরা করেছি, জংলি গাছের কাঁটায় পা ক্ষত বিক্ষত করেছি, কাঁটার ঘায়ে ব্যথায় “উফফফ” করে উঠেছি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে জঙ্গলা থেকে একপায়ে লাফিয়ে বেরিয়েছি। সবই ওনার সামনে। উনি তো কখনোই জিগেস করেনি, কাঁটা বিঁধেছে? কই, দেখা তো?
এই দুটো শব্দ শুনবার জন্য কী করুণ আকুলতা!
কী ব্যকুল প্রতীক্ষা!
কী প্রেমাতুরা নীরব প্রার্থনা!!!
বাসায় ফিরে সুঁই দিয়ে কাটা তুলতে গিয়ে রক্তে পা মাখামাখি করেছি। অথচ তিনি আমাকে চরম অপমান করেছেন। তিনি আমাকে আজকেও, এখনও অপমান করেছেন ।
অবজ্ঞাভরে জানতে চেয়েছেন,
আমি ম্যাট্রিক দিয়েছি কিনা!
জানতে চেয়েছেন, পাশ করেছি কিনা!!!
এতো উদাসীনতা?
এতো উপেক্ষা?
এতো…
আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম । বললাম, চা নিয়ে আসি। মনে মনে ভাবছি, উনি বলবেন, থাক, আরেকদিন এসে খাবো। আজ উঠি। কিন্তু কী আশ্চর্য, উনি এমন কিছুই বললেন না। আমি যথেষ্ট ধীরগতিতে ঘর থেকে বের হলাম। শেষ পর্যন্ত সুযোগ দিলাম। কিন্তু নাহ, উনি এমন কিছুই বললেন না। আমি টের পাচ্ছি, উনি এখনও আমাকে দেখছেন।
“হংস গমনে চলিল রাই
যায় গো রূপের বালাই
যায়।
হংস গমনে চলিল রাই”..
রান্নাঘরে গিয়ে ধীরে সুস্থ্যে চা বানালাম। চুলোর গরমে আমার চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল আরও ল্যাপ্টালো। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে ভুলেই গেলাম, সিঁদুরের টিপ পরেছিলাম। ডাইনিং এর আয়নায় চোখ পড়লো। টিপের উপরের দিকটা হালকা বেঁকে কপালের বাঁ দিকের উপর পর্যন্ত মেখে গেছে।
থাকুক অমন।
আমাকে ভুতের মত দেখাক।
আমি এভাবেই যাব সামনে।
তিনি আমাকে অপমান করতে পছন্দ করেন তো।
ঠিক আছে,
আবারও সুযোগ দেবো।
করুক অপমান।
চোখেমুখ শক্ত করে ট্রে তে চায়ের কাপ নিয়ে ধীর শান্ত পায়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। চায়ের পেয়ালা তুলে ধরলাম। উনি হকচকিয়ে গেলেন।
চা নিলেন।
আমি অপেক্ষা করছি ওনার অপমানের সেশন কখন শুরু হবে। আর ভাবছি, এবারের অপমানের সিলেবাস কতটা খারাপ হতে পারে? কতটুকু এঁফোড় ওঁফোড় করতে পারে? কী পরিমাণ বিষ থাকবে সে অপমানের সিলেবাসের ভাঁজে ভাঁজে?
চায়ে চুমুক দিয়ে ডিভানের উপর রাখা হারমোনিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–এভাবে পড়ে আছে? গায় না কেউ?
— না।
চায়ের কাপ হাতে নিয়েই তিনি ডিভানে গিয়ে বসলেন।
পাশের টি-টেবিলে কাপ রেখে হারমোনিয়াম কাছে টেনে নিলেন।
উনি বাজাচ্ছেন,,,
উনি গেয়ে উঠলেন,,,
“এই নীল মণিহার
এই স্বর্ণালী দিনে
তোমায় দিয়ে গেলাম, শুধু মনে রেখো”,,,
আমার কি যেন হলো হঠাৎ —
আমি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থের মত, মণি হারানো কাল-নাগিনীর মত হিসহিস করে বলে উঠলাম,
–স্টপ সিঙ্গিং,
স্টপ ইট,
জাস্ট স্টপ,
স্টপ…
তারপর বলতে শুরু করলাম,
–আমি গান শুনিনা গত দুবছর।
এই গানটা লাকী আকন্দের গলায় শোনার আগেই আপনার গলায় শুনেছিলাম।
এই গানটা আপনার গলায় অসংখ্যবার শুনেছি। আপনি গানের আসরে গাইতেন। পড়তে বসলে মনে হতো আপনি ড্রয়িং রুমে বসে আছেন আমাকে এ গানটি শুনাবার জন্য। চোখ বুজলেই মনে হতো আপনি আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এই গানটি শুনাবার জন্য। ঘরে বাইরে যেখানে যাই সেখানেই আপনার ছায়া। সেখানেই নীল মণিহার। ভরা পূর্ণিমার রাতে গলে পড়া জ্যোৎস্নার ঢেউ দেখে দৌঁড়ে বেলকুনীতে গেছি, ভেবেছি, এইতো স্বর্ণালী রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন । আমি পাগলের মত নিজের ভেতরের অলিগলি, রাজপথে ছুটে বেড়িয়েছি, আপনাকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। সবখানে আপনি আবার কোথাও আপনি নেই। ছুঁতে গেলে দেখি আপনি নেই।
আমি রোজ রাতে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতাম, আপনি শুধু আমাকে, শুধুই আমাকে, একা আমাকেই,
নীল মণিহার শুনাবেন। কোনো এক স্বর্ণালী দিনে আপনার কন্ঠের এই নীল মণিহার আমার কন্ঠে অগাধ, অবাধ আবেগে পরিয়ে দেবেন। আমার হাত ধরে,গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলবেন,
মনে রেখো …
সম্ভবতঃ এই প্রথম কারো মুখের উপর এভাবে কথা বলতে পারলাম। উনি প্রচন্ড অবাক হলেন। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। সম্ভবতঃ একটু কাঁপছি। উনি আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠলেন।
কঠিন কন্ঠে বললাম, চলে যাচ্ছেন?
মাকে ডেকে আনি? বলে যান?
উনি কিছু বললেন না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। কী আশ্চর্য, আবার ফিরেও আসলেন। আমি প্রায় পাথরের মত বসে আছি। সরাসরি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
–তোর কি ধারণা, আমি এসব জানতাম না?
বুঝতাম না?
আমি সব জানতাম—
রাতের পর রাত সিগারেট আর আকাশের তারা নক্ষত্র গুনে খোলা আকাশের নিচে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।
পালিয়ে গেছি রে…
আমি পালিয়ে গেছিলাম …
হতভম্ব হয়ে মুখ তুলে চেয়ে আছি। কিছু একটা খুঁজছি তাঁর মুখে। হ্যাঁ, কারণ খুঁজছি।
আমার চোখ দিয়ে কাজলমাখানো কালো জল গড়িয়ে পড়ছে। অনেক কষ্টে পাথরের মত ভারি একটা হাত তুলে তাঁর শার্ট খামচে ধরলাম। শক্ত করে ধরলাম। এতোদিন মায়ামৃগের মত ফাঁকি দিয়েছে। আমি মৃগনাভ কস্তুরীর সুগন্ধিতে মাতাল হয়েছি। উন্মাদের মত মাঠে ঘাটে জঙ্গলে মরুতে ছুটেছি। পাইনি। আজ যখন মায়ামৃগ ধরা পড়ে গেছে তখন আমৃত্যু তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকবো। ছাড়বো না, পৃথিবী উল্টে যাক, ভুমিকম্প হোক, তুফান উঠুক, সাগরে সুনামি হোক। তাও ছাড়বো না।
তিনি আমার কপালে উড়ে পড়া চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। আর শার্ট থেকে আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
ব্যর্থ হয়ে আমার দিকে অসহায়ের মত তাকাচ্ছেন।
ক্রুদ্ধ হয়ে বললাম,
–ছেড়ে দেবো?
এতো সহজে?
একদম না।
মিনতি করে বললাম,
–আপনি আমাকে নিয়ে যান
আমি আপনার সাথে যাবো
কোনো একটা নাম পরিচয়হীন মরা গাঙের চরে নিয়ে যান। যেখানে সারারাত দুজনে বালিতে শুয়ে আকাশের তারা গুনবো। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। আমরাও কাউকে চিনি না।
আপনার আমার সামাজিক অবস্থানের যে কংক্রিটের দেয়াল তা ওই মরা গাঙের বানই ভেঙে দেবে। ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হবে আমাদের ইন্দ্রপুরী।
আমি হবো ইন্দ্রাণী
আপনি ইন্দ্ররাজ…
যাবেন না প্লীজ
যাবেন না…
আপনি আমাকে ছেড়ে…
মা গা ধুয়ে এসেছেন ততক্ষণে।
ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন।
সব শুনছেন।
তিনি অস্থিরতার সাথে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, খালাম্মা!
মা ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আমার সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়েছে। আমি আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি তখনও তাঁকে খাঁমচে ধরে আছি।
মা সামনে এসে দাঁড়াতেই আমি মাকে মিনতি করে বললাম,
–মা, তুমি উঁনার সাথে আমাকে যেতে দেবে না?
মা, মা, মা…
মা শান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে অপার মমতায় বললেন, দেবো।
তখন ভর দুপুর।
বৈঠকখানায় মা আর তিনি মুখোমুখি বসে আছেন।
মায়ের অনুমতি পেয়ে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম। তারপর দৌঁড়ে আমার ঘরে মানে আমার আর আপার ঘরে ঢুকেই আলমারির উপরে রাখা ট্রাভেল ব্যাগটা নামিয়েছি। আলমারি খুলে আমার দু ‘সেট দামি স্যালোয়ার কামিজ বের করে ব্যগে ঢুকালাম। আলনা থেকে ঘরে পরার দুটো সেট আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস।
ব্যগ হাতে বসার ঘরে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললাম,
ব্যস, আমি একদম তৈরী।
মা উঠে এসে আমাকে জাপটে ধরলেন।
বললেন,
–মণি, ও তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।
মুহুর্তে আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম। মার কাছ থেকে হুলুস্থুল করে নিজেকে ছাড়ায়ে ওনাকে জাপটে ধরলাম।
হুলুস্থুল ধস্তাধস্তি করতে লাগলাম। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়েছে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি।
এমন সময় মা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন,
–আরে হতভাগী, যার জন্য পাগল হলি, তোকে নিয়ে যাবার ক্ষমতা তার নাই ।
তোর ভাইয়েরা তাকে জবাই করে ফেলবে।
আবছা আবছা মনে পড়ে, বড় ভাইজান কোথা থেকে যেন প্রায় উড়ে এলো। ঘরে ঢুকেই তাঁকে বেধড়ক পেটাতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। তারপর ঠিক কি হয়েছিল?
মনে পড়ছে না।
আমি কি চিৎকার করেছিলাম ?
আমি কি বলেছিলাম,
ভাইজান, তোমার পায়ে পড়ি
ভাইজান মেরো না
ভা_ই_জা_ন …
ওঁনার দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্ত।
নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
উনি মেঝেতে পড়ে গেলেন
দুই ভাই মিলে তখনও ওনাকে লাথির পর লাথি মারছে।
আমার আকাশ পাতাল উথাল পাথাল করে উঠলো। ঘরের ছাদটা নিচে নেমে আসছে,,,
আমি শ্বাস নিতে পারছি না
বুকের উপর ছাদ চেপে বসলো …
আমার দম আটকে আসছে…
মা কি আবারও ডাল ফোঁড়ণে দিচ্ছেন?
চারদিক অন্ধকার …
রক্তের নালা…
কেউ একজন রক্তের নালায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে …
সারা গা রক্তে মাখামাখি
রক্তের নালায় ভাসছে …
আমি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম।।
কি এক মিশ্র অনুভূতিতে আমি সবসময় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি । রক্তের নালায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছি, এ স্বপ্নটা প্রায় প্রতিরাতেই দেখি। ছটফট করে ঘুম ভেঙে যায়। মা আমাকে এখন জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দেন। আপাও মাঝেমধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ আপাকে কাঁদতে দেখি। আপা আমার মুখটা বুকে চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমি জিগেস করি, আপা, তুমিও কি স্বপ্নে রক্তের নালা দেখো? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আপা আবারও আমাকে বুকে চেপে ধরে। ফুঁপিয়ে ওঠে। এক রাতে আবার খানিক লম্বা স্বপ্ন দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। মা তাড়াতাড়ি আমাকে আরেকটা ওষুধ খাইয়ে দিলেন। কিন্তু মাকে তো বলতে হবে, আমি কি দেখেছি।
মা, মা, ওমা …
–ঘুমোও মণি ।
— ঘুম আসছে কিন্তু আগে আমার স্বপ্নটা শোনো। ঘুমিয়ে গেলে তো আর মনে থাকবে না। তখন ডাক্তার কাকুকে কি বলবে?
মা সজাগ হয়ে বসেন। আমাকে কোলে টেনে নিয়ে বললেন , আচ্ছা বলো মণি ।
–মা, আমি না আজকে রক্তের নালায় আমার সাথে আরেকজনকে দেখেছি। পুরো মুখ রক্তে মাখানো। না না, পুরো শরীর। আমার সাথে এটা আবার কে? আমিতো চিনি না। কোত্থেকে আসলো হঠাৎ?
আজ মাও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।
মাকে ওভারে কাঁদতে আমি কখনো দেখিনি। ইশ, স্বপ্নটা না বললেই তো হতো।
মায়ের কান্না দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
পরদিন আমাকে ডাক্তার কাকুর কাছে নিয়ে গেলেন বাবা। সাথে মা আর আপা। ডাক্তার কাকু জিগেস করলেন,
— মা মণি সোনা, তুমি কি তাকে চেনো?
–নাআআ তো কাকু
–গুড
–লোকটা কে কাকু?
–লোক বলছো কেন? তোমার মত অন্য কেউও তো হতে পারে মাই লিটল ফ্রগ।
–উঁহু, আমার মত জামা পরা না। শার্ট পরা।
আমি বুঝি শার্ট পরি?
কাকু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ওষুধ লিখে দিলেন।
এবারের ওষুধগুলো কেমন জানি।
আমি সারাদিন ঝিমোই। মাঝেমধ্যে মা, আপা বাবা ভাইজান, ছোট ভাইজান কাউকে চিনতে পারিনা। ইদানিং আবার ওই রক্তমাখা শার্ট পরা লোকটাকে ঘনঘন দেখছি স্বপ্নে। মাঝেমধ্যে স্বপ্ন ছাড়াও দেখি। আমার রুমের মেঝেতে উপুড় পড়ে আছে …
একজন মহিলা খুব কাঁদছে। কে উনি? উঁহু, এখন আবার দুজন মহিলা কাঁদছে। উঁহু, একজন মহিলা আরেকজন মেয়ে। এরা কারা? কাঁদছে কেন? আমি তাদের জিগেস করলাম, আপনাদের কি হয়েছে? কাঁদছেন কেন? আপনারা কোথায় থাকেন? ওহ, আপনারাও বুঝি আমার মত হারিয়ে গেছেন?
আহা,আহা। হারিয়ে গেলে খুব কষ্ট হয়। ভীষণ ভয় লাগে। কি আর করবেন? প্রথম প্রথম এমনই হবে। আমারও হয়েছিল। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনও ভয় পাবেন, তখনও কান্না পাবে কিন্তু মেনে নিতে পারবেন।
আহা আহা। কাঁদবেন না প্লীজ, কাঁদবেন না ।
এই যে দেখেন, আমি তো কাঁদছি না। এক একবার এক এক জায়গায় হারিয়ে যাই। সব নতুন নতুন মানুষ। নতুন নতুন জায়গা। তাদের কাউকে চিনি না। তারাও আমাকে চেনে না। কই, তবুও তো আমি কাঁদি না।
ভয়ও পাইনা।
এই দেখেন আমার চোখে কোনো পানি নেই।
আমাকে ছুঁয়ে দেখেন, আমি কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছি না।
দেখেন, দেখেছেন, আমি হাসছি …
আহা, থাক থাক, আর কাঁদেনা।
এরমধ্যে একটা লোক আসলো। লোকটার হাতে ইঞ্জেকশন। লোকটাকে বললাম, শুনেন ভাইয়া, এনাদের ইঞ্জেকশন দেন। এরাও আমার মত হারিয়ে গেছে তো তাই খুব কাঁদছে। ভীষণ ভয়ও পেয়েছে।
আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়া লাগবে না। আমিতো এখন আর কাঁদিনা, ভয়ও পাই না।
এই দেখেন, আমি ভয়ও পাচ্ছি না আবার কাঁদছিও না। অনেকদিন হলো হারিয়ে গেছি তো।তাই আর ভয় পাই না।
এরপর, আর কিছু মনে নাই । সব অন্ধকার।
এখন আমি সুস্থ্য। যদিও, এখনও দুয়েক্টা ওষুধ খাইয়ে দেয় মা। একবছর পর আবারও কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলেজের সবাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। আমি জানি, ওরা কেন আমাকে এভাবে দেখে। আমার অসুখ হয়েছিল তো, তখন কিছু মনে থাকতো না। মায়ের কাছে জেনেছি। ওরাও জানে। তাই দেখে।
ওহ, আরেকটা কথা, আমরা একটা দোতলা বাড়িতে উঠেছি। আগের বাসাটা ছোট ছিল তো তাই ওখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। এই বাড়িটা যে কী সুন্দর! সবচেয়ে সুন্দর হলো ছাদটা। আমি রোজ রাতে ছাদে যাই। মাদুর বিছিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আকাশটা নিচে নেমে এসেছে। এতো এতো তারা নক্ষত্র যেনো হাত বাড়ালেই মুঠোতে ধরা যাবে। হীরক খন্ডের মত জ্বলজ্বলে তীব্র নীলাভ নক্ষত্রমালা। যেন, নীল মণিহার।
কিছুদিন পর আপার বিয়ে।
আপার জন্য আলাদা ঘর গোছানো হয়েছে।
উফ, কী সুন্দর করে যে সাজিয়েছে।
আপা এখন থেকেই তাঁর রুমে থাকছে। আর এই রুমটা এখন আমার একার। উফ, কী দারুণ ব্যাপার না। আমি এখন আমার রুমের একচ্ছত্র অধিকারী। যা ইচ্ছে করতে পারি। কবিতা আবৃত্তি করতে পারি, গল্পের বই পড়তে পারি, জোরে জোরে কারণে অকারণে হেসে উঠতে পারি, নাচতে পারি, সাজ…তে পা…রি…,??? গা..ন গা…ই..তে পা..রি???
আবারও কী যেন একটা মিশ্র অনুভূতি আমাকে স্থবির করে দেয় । সুস্থ্য হবার আনন্দের চেয়ে বিষাদগ্রস্থ করে বেশী।
“আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!”
আমি বিছানায় শুয়ে পড়ি।
মা যেন কিভাবে বুঝতে পারেন।
মা তখন আমাকে একটা ছোট্ট ট্যাবলেট খাইয়ে দেন।
আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
কিন্তু, আমার কী হয়?
আমার কেমন লাগে?
ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা…
মাকে বলেছি, মা, আমার কেমন জানি লাগে।
কিন্তু কেমন লাগে তা বলতে পারি না।
এমনকি, ঠিক বুঝতেও পারিনা।
মা স্নেহ মাখা কন্ঠে বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে মণি।
আসলেই, কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে গেল। যদিও এখনও ওষুধ খাই। ডাক্তার কাকু বলেছেন,
–মাই ডেয়ার লিটল ফ্রগ
ইউ শুড বি দ্য স্ট্রঙ্গেস্ট এঞ্জেল অব দিস গ্যালাক্সি।
ইউ শ্যুড…
অনুভূতিটা যে কি এখন আমি তা জানি।
কিন্তু কাউকে বলিনি।
মাকেও না।
আপাকেও না।
আরেহ, বললে আপার পরিবর্তে মা আবার আমার সাথে ঘুমানো শুরু করবেন।
তাহলে তো তাঁকে আমি আর দেখতেই পাবো না …
প্রতিরাতে তো সেও আর আসবে না…
তাহলে কিভাবে আমি আমার ওড়না দিয়ে তাঁর মুখের রক্ত মুছে দিবো?
বুকের পিঠের জমাট রক্তগুলো যে কী শক্ত।
আর, তলপেটেরগুলো?
ইশ, সারাক্ষণ গলগল করে বেরুচ্ছে!
আমি প্রথমে ওড়না দিয়ে চেপে ধরি। ওমা!!
পুরো ওড়না ভিজে লাল হয়ে যায়!
এরপর তোয়ালে
এরপর বিছানার চাদর ..
সে হো হো করে হেসে ওঠে।
আমি রেগে যাই।
বলি, খুব মজা লাগছে না আমাকে এভাবে খাটাতে।
সে বলে, আচ্ছা, পেটে চাদর আমি চেপে ধরছি।
তুমি আদর করে আমার কপালটা মুছে দাও।
আমি তখন ওর কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুনো তাজা রক্ত কাঁথা দিয়ে চেপে ধরি।
ও আমার গাল দুটো ওর রক্তাক্ত হাত দিয়ে আলতো করে ধরে বলে,
–গান শুনবে?
–হ্যাঁ তো
–আবার, স্টপ সিঙ্গিং বলবে নাতো?
লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেই।
বলি,
–উঁহু। আর কক্ষনো বলবো না।
ও বাঁকা করে মিষ্টি হেসে জিগেস করে,
–কোন গানটা আজ গাইবো?
আমি আকুল হয়ে বলি,
—ওই, ওই গানটা ।
ওই যে,
এই নীল মণিহার,
এই স্বর্ণালী দিনে,
তোমায় দিয়ে গেলাম, শুধু মনে রেখো,,,