উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন – অনুরণন (পর্ব-০১), অনুরণন (পর্ব-০২), অনুরণন (পর্ব-০৩), অনুরণন (পর্ব-০৪), অনুরণন (পর্ব-০৫), অনুরণন (পর্ব-০৬), অনুরণন (পর্ব-০৭), অনুরণন (পর্ব-০৮), অনুরণন (পর্ব-০৯), অনুরণন (পর্ব-১০)
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
সেলিনা মওলা
সামনে সদ্য অস্তমিত সুর্য্যের সর্বশেষ রাঙা সরু আভার আকাশ দেখছি। হাতে বেঢপ সাইজের মোটা একটি চায়ের কাপ নিয়ে হোস্টেলের বেলকুনীতে বসে চা য়ে চুমুক দিচ্ছি। লেডিস হোস্টেল জমে উঠতে শুরু করেছে। একটু পরই শুরু হবে নাজমুল ভাই মানে হোস্টেলের দারোয়ান ভাইয়ের সুরালো মায়ামাখা কন্ঠে ওমুক আপা তমুক আপা বলে নাম ধরে ডাকার আসর। সন্ধ্যার পর এখানে প্রায় সবার গেষ্ট আসে। গেষ্টদের একটি বড় অংশের বাসস্থান বয়েজ হোস্টেল। মিলি আপারও গেষ্ট আসে তবে রাত সাড়ে আটটার পরে। আমাকে ঘুম থেকে ঠেলেঠুলে ডেকে তুললেন মিলি আপা । আমি ধড়ফড় করে উঠে বসতেই মিলি আপা অবাক হয়ে জিগেস করলেন, “কিরে? কি হয়েছে তোর? এতো গাঢ় ঘুম তো এতদিনে কখনও দেখি নাই!” আমি আবারও ধপ্পাস করে শুয়ে পড়লাম। স্মিত হাসি দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে লাগলাম। হাই ছাড়তে ছাড়তে গলা দিয়ে কমপক্ষে তিনচার রকম আওয়াজে ভেঙে ভেঙে বললাম, “উফফ, ঘুমোতেই তো দিলেন না। এতো ডাকাডাকি করলে মানুষ ঘুমোয় কেমনে!” মিলি আপা খেঁকিয়ে উঠলেন। বললেন, “তাইলে এতক্ষণ কি করছিলি? লাফাচ্ছিলি?”
বিছানার যেদিকে মারমুখী হয়ে মিলি আপা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে গড়িয়ে এসে মিলি আপার শাড়িতে নাকমুখ ডুবিয়ে তাঁর পা দুটো সজোরে জড়িয়ে ধরে বললাম, “হ্যাঁ তো, ঘুমের মধ্যে লাফাচ্ছিলাম ।” আমার পিঠে একটি মিষ্টি কিল দিয়ে রেগেমেগে কি যেনো বলতে গিয়ে মিলি আপা হেসে দিলেন। আমার অন্য দুই রুমমেটের একজন বললো, “নেন, এখন ফিডারে দুধ খাওয়ান আহ্লাদিকে।” বাকি সবাই রুমের ছাদ ফাটিয়ে হেসে উঠলো।
এটি একটি মিষ্টি খেলা। প্রথমে মিলি আপাকে ক্ষেপিয়ে তাঁর রাগ মাথায় তুলি তারপর এমন আহ্লাদ করি যে, মিলি আপা না হেসে থাকতেই পারেনা। আজকেও রাগে ফুঁসে উঠতে গিয়ে হেসে ফেললো।
আকাশের দিকে পুর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতেই সন্ধ্যার লেডিস হোস্টেল সরগরম হয়ে উঠলো। দুরে, বহুদূরে সুর্য্যের শেষ রক্তাক্ত রাঙা আভাটুকু দেখতে দেখতে বাবার কথা ভাবছিলাম । মিশ্র অনুভূতির দোলাচলে নিজেকে বুঝা দায় হলেও আমি অনড় । হিমালয়ের মত অনড়। ন্যায় অন্যায়ের সংজ্ঞা এই “আমি”র কাছে সম্পুর্ন ভিন্ন। ভাবছিলাম, বাবা কী আসবেন? সম্ভবতঃ আসবেন। বাবার মুখোমুখি হতে ভয় নেই এখন। মুখোমুখির ভয়ঙ্কর অংশটি আগেই মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। তারপরও কেন মনে হচ্ছে বাবা আসবেন? আসবেন, তাঁর নিজস্ব অপরাধবোধের জন্য। আসবেন, আরও খানিক প্রায়শ্চিত্ত করতে। যদিও ওই ন্যায় অন্যায়ের মতই পাপপূণ্য, প্রায়শ্চিত্তের সংজ্ঞাও আমার কাছে আজ ভিন্ন।
কখন যে সব কোলাহল থেকে অপার নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছি জানিনা। চারদিকে বিস্ময়কর নিরবতা নেমে এসেছে । লেডিস হোস্টেলের আনন্দমুখর সন্ধ্যার শোরগোল কিছুই আমার কানে আসছে না। সন্ধ্যাগুলো বড় নির্মম,বড় মর্মান্তিক। বড় বেশী “সত্য” নিয়ে বারংবার প্রকট হয়। যতই সেসব এড়াতে চাই ততই তারা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই “আমি” তখন আমারই আরেক সত্তার “আমি”কে খুঁজে ফিরি। ঠিক যখনই সেই “আমি”র খোঁজ পাই তখনই মাঝামাঝি অন্য আরেক “আমি” ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে যায় । যে আমাকে নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সে অন্য একজন, যে আমার “আমি”রই কেউ, যে সর্বদা আমার ভেতরেই বসবাস করে। সে হঠাৎই প্রকট হয়ে ওঠে । সে আমাকে দ্বিধান্বিত করে। আমাকে বিপন্ন করে। ভয়ঙ্কর সব সত্যের ঘূর্ণিপাকে, দুর্যোগে, অসীম অসহায়ত্বে আমি তার সামনেই হাঁটুগেঁড়ে বসি। আকুল হয়ে জিগেস করি, “কে তুমি? তুমিই কী আমি? কোন “আমি” সত্য? “তুমি” না তোমার আড়ালে যে নিভৃতে বাস করে, সে?” উত্তর পাইনা কখনও । সে নিরবে আমার হাতদুটি ধরে অনন্ত শূন্যে ভাসতে থাকে । আমি শূন্য থেকে মহাশূন্যে তার সাথে ভাসতে ভাসতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব নিদারুণ সত্যগুলোর মুখোমুখি হই। তখন সে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি হিমালয়। তুমিই হিমালয়। আমিই হিমালয়। আমরা হিমালয়ের মত অনড়,অবিচল।”
সন্ধ্যাটা শেষ পর্যন্ত নেমেই গেল।
মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে বছর দেড়েক আগের সে রাতের নির্মম,মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো । যে রাতে বাবা আমাকে মায়ের ঘরে ডেকে পাঠালেন। রাত সাড়ে ন’টার মত বাজে তখন । আমি ডিনার করে নিজের ঘরে বিছানায় গড়াচ্ছিলাম। ঘরের লাইট অফ করে দিয়েছি। আমার ঘরে একটি কর্নার ল্যাম্প আছে যা আমি মাঝেমধ্যে জ্বালাই। রুমের দেয়াল ও সিলিংয়ে ল্যাম্পের জাল জাল ছোপ ছোপ আলোছায়ায় সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থাকি। এমনটা করি যেদিন আমার অতীত খুঁড়ে কষ্টগুলোতে শান দিতে হয়, সেদিন। “কষ্টগুলোয় শান না দিলে ওগুলোতে একসময় মরচে পড়ে যায়। তখন নিজেকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেকে নিজের কাছে অতি দৈনন্দিন, আটপৌরে মনে হয়। আসলে যা আমাদের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করে, কষ্টগুলোকে অপমান করে, সত্যকে অস্বীকার করার মত ঘৃণ্যতম পাপে নিমজ্জিত করে। অস্তিত্বহীনতার চরম বিপন্নতায় আমরা খেই হারাই, বিচলিত হই, বিক্ষিপ্ত হই। এইসব বিপন্ন অনুভূতি আমাদের উপর জীবনের নিষ্ঠুরতম আঘাতের বিপরীতে প্রতিঘাত করার তীব্র প্রত্যয় থেকে সরিয়ে আমাদেরকে বোধহীন, বিকলাঙ্গ, ব্যঙ্গাত্মক, অসন্মানজনক স্তরে নামিয়ে আনে। আমাদেরকে খুব নিম্মস্তরের গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলে। যদিও বোধহীন, বিকলাঙ্গ অনুভূমিক জীবনযাপন অনেক সহজ কিন্তু এই অপরূপ সুন্দর পৃথিবীর কারো কারো প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য সে জীবন ভয়ানক অপমানজনক । সে জীবন ক্রিতদাসের জীবন। সে জীবন যাপন করা মানে প্রতিমুহূর্তেই নিজেকে অপদস্থ করা। নিজের আত্মসন্মানকে বিসর্জন দেয়া। নিজেকে তিলে তিলে খুন করা। এমন বিকলাঙ্গ, বোধহীন, মৃত জীবনযাপন অপার সুখশান্তির মেকি আবরণে আবৃত থাকে , বিত্তবৈভবের ধার করা নিয়নে তিলোত্তমা হয় কিন্তু তা মুলতঃ অন্তঃসারশূন্য। ফাঁপা, সন্মানহীন। সন্মানহীন জীবনযাপন করার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।”
কথাগুলো মহুয়ার ফুপ্পি বলেছিলেন। আমি আর ফুপ্পি মুখোমুখি বসে আছি ফুপ্পির রুমের একটি খোলা কর্নারে যেখান থেকে আকাশ দেখা যায়। ফুপ্পি আকাশের দিকে তাকিয়ে এ কথাগুলো বলছিলেন। আমি তখন ফুপ্পিকে জিগেস করলাম, “তাহলে ফুপ্পি, আমার সুইসাইড করা উচিৎ। কারণ, এইসব বিকলাঙ্গ, ব্যক্তিত্বহীন, বোধহীন, অন্তঃসারশূন্য জীবনযাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” ফুপ্পি আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, “আমি কি সুইসাইড করেছি মণি?
নট এট অল। হোয়াই শ্যুড ইউ কমিট সুইসাইড? ইউ শ্যুড ফেইস দ্যাট ব্ল্যাডি লাইফ এন্ড স্টে এট ইউর ওন ইউনিভার্স হোয়ার এ রিয়েল মণি লিভস উইদ ফুল অব লাভ এন্ড লাভ । আ লাভলি বোল্ড এন্ড দ্য বিউটিফুল পার্সোনালিটি, দ্যাট উইল বি দ্য গিফট অব ন্যাচার হুইচ গিভস ইউ দ্য পাওয়ার টু উইন ইউর ওন রিয়ালিটি। মেকস ইসট্যাবলিশ ইউর হলি এন্ড ওয়েটি ফিলোসফি।”
মহুয়া আমেরিকায় চলে যাবার পর একদিন কলেজ শেষে বেরিয়ে দেখি, ফুপ্পি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি প্রথমটায় ঘাবড়ে গেছিলাম। মহুয়া কি ফিরে এসেছে? ফুপ্পি কিন্তু এগিয়ে এসে আমার সামনেই দাঁড়ালেন। বললেন, “অনেকদিন তোমাকে দেখিনা তাই দেখতে এলাম। কেমন আছো মণি?” কথাগুলো বলতে গিয়ে ফুপ্পির গলা কেঁপে উঠলো। কন্ঠে স্পষ্টতঃ বেদনার ছাপ। আমি সালাম দিয়ে বললাম, “ভাল আছি ফুপ্পি, আপনি কেমন আছেন?” ফুপ্পি একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, “কেক বানিয়ে এনেছি, খাবে? আমার চোখে হঠাৎই পানি চলে এলো। পেছনে কলেজ, যেখানকার মেয়েরা আমাকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে। আর সামনে মহুয়ার ফুপ্পি বুকভরা মমতা ঢেলে জিগেস করছেন , কেক খাবে? পৃথিবীর এইসব অপার বিস্ময়ের মানে আমি কখনও খুঁজে পাইনি। হয়তো পাবোও না কখনও।
ফুপ্পির গাড়িতে বসেই কেক খেলাম। খেলাম মানে ফুপ্পি মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। রাস্তার ওপারে আমাদের গাড়ি। ড্রাইভার কাকু ফুপ্পিকে চেনে। ফুপ্পিই যে বাবাকে খবর দিয়েছিলেন আর বাবাকে সাথে নিয়ে আমাকে হাজত থেকে বের করে এনেছিলেন তাতো ড্রাইভার কাকু জানেই। তাই ড্রাইভার কাকুও ফুপ্পির কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁর আদরের ছোটআম্মাকে যে এই আশ্চর্যরকম মমতাময়ী মহিলাটি অতি আদর করেন তা ড্রাইভার কাকু উপলদ্ধি করতে পারেন।
এরপর থেকেই আমি মাঝেমধ্যে ফুপ্পির সাথে দেখা করতে যাই। ফুপ্পির সাথে আমার আর আমার সাথে ফুপ্পির আসলে তেমন বিশেষ কোনো গল্প হয় না। কেবল দুজন দুজনের সান্যিধ্য প্রখরভাবে অনুভব করি। প্রথম প্রথম মহুয়ার পছন্দের খাবারগুলো বানিয়ে খাওয়াতেন আমাকে। ধীরে ধীরে এক পর্যায়ে আমার পছন্দের খাবার বানাতে শুরু করলেন। কয়েকদিন আমাকে দেখতে না পেলে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। আমি নিজেও । ড্রাইভার কাকুই নিয়ে যেতেন। এমনও হয়েছে, আমাকে উদাস দেখে কাকু নিজেই বলেছেন, “ছোটআম্মা, চলেন ওই ম্যাডামের বাড়িতে যাই। আপনার মন ভাল হয়ে যাবে।”
কিন্তু বাসার কেউ কখনোই একথা জানতে পারেনি।
মহুয়ার ফুপ্পির সাথে আমার আশ্চর্যরকম মধুর, বিমূর্ত এক অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।
দেড় বছর আগের সেই রাতের কথা আবারও মোচড় দিয়ে উঠছে। লেডিস হোস্টেলের লনের চখাচখির মেলায় কোলাহলমুখর আজ এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায় ।
সে রাতে অবশ্য ঘরের বাতি নিভিয়ে বেলকুনীর খোলা দরজা জানালা দিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নীলাভ রাতের সৌন্দর্য্যে নীববে বিভোর হয়ে ছিলাম।
ভীষণ গরম পড়ছিল সে দিনগুলোতে । রোদও খুব চড়া ওঠে তখন । আকাশে অপরূপ সুন্দর সাদা মেঘের ভেলা আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে ঝকঝকে নীল রঙের মোহিনী আকাশ। বাংলায় কি মাস ছিল ওটা? ভাদ্র মাস? হু, ভাদ্রের শেষদিক। তাই-ই হবে। আগের রাতেও তো তারা নক্ষত্রগুলো এমনভাবে জ্বলজ্বল করছিল যেন হাত বাড়ালেই মুঠোয় মুঠোয় ভরে আনা যাবে। বাঁকা চাঁদের আলো আহ্লাদি মেয়ের মত বেলকুনীতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। নক্ষত্রের আলোয় পুরো লন,বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে এপাশের সারি সারি গাছগুলো,তাদের ডালপালাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ধবধবে সাদা গন্ধরাজে ভরা গাছটার প্রতিটি ডাল পর্যন্ত পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, আকাশ দেখবো নাকি গন্ধরাজের ফুলে ফুলে ভরে যাওয়া গাছটি দেখবো। এইসব সৌন্দর্য্য ভরা রূপোলী রাতে আমি খুব দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। ইচ্ছে ছিল সে রাতেও বেলকুনীতে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। কিন্তু কিসব আবোলতাবোল যে ভাবছি আর গড়াচ্ছি, বেলকুনীতে আর যাওয়া হচ্ছে না। আজকের রাতটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। শুক্লাপক্ষের চাঁদ রূপো গলিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের লনে। আমার বেলকুনীতে গলে পড়া রূপোর বন্যা । চন্দ্রস্নানে যাবার আগেই গলানো রূপোর গলে পড়া সৌন্দর্য্যে আমি বিহ্বল। বিহ্বল হয়েই ভাবছি, আর্টস ফ্যাকাল্টির ভর্তি পরীক্ষা ভালই তো দিলাম। যদি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে চান্স হয়ে যায় তো ব্যস। ওখানেই ভর্তি হয়ে যাব। আর সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সয়েল সায়েন্স, জিওলজি হলেই যথেষ্ট। যেকোনো একটিতে ভর্তি হয়ে যাব। সোশিওলজিতে হলে সবচেয়ে ভাল হবে। দারুণ এঞ্জয় করবো ইউনিভার্সিটি লাইফ। বন্ধুদের সাথে খুব আড্ডা দেবো, পিকনিকে যাবো । টিএসসিতে বসে চেয়ার টেবিল, টুল পিটিয়ে গান গাইবো। আচ্ছা, যদি কেমেস্ট্রিতে হয়? না না ওখানে যেন না হয়। হলেও ভর্তি হবো না। ওখানে তো মিথুন ভাইয়া পড়ে। ওখানে সেও পড়তো। ওখানকার সবকটা সিঁড়িতে তাঁর ছোঁয়া। ক্লাশের প্রায় সব বেঞ্চিতে তাঁর স্পর্শ,শার্টের গন্ধ । করিডর, ল্যাব, পেছনের লনের বাতাসে তাঁর গান। ইথারে তাঁর সুরের ঝংকার। তাহলে কি আমি কেমিস্ট্রিতেই ভর্তি হবো? তাঁর কাছাকাছি থাকবো সবসময়। কিন্তু কিভাবে? ওই ডিপার্টমেন্টের সবাই আমাকে ক’দিনেই চিনে ফেলবে। তখন সবাই আমাকে আঁড়চোখে দেখবে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখবে আর ঘেন্না করবে । কিছুদিন পর ক্লাসমেটরাও তীর্যকভাবে তাকাবে। আমার সাথে কেউ মিশবে না। প্র্যাক্টিক্যাল একা একাই করতে হবে। কোনো একদিন ল্যাবে একাই হয়তো কোনো রিয়াকশন মেলাতে মেলাতে বিকেলের আলো শেষ হয়ে যাবে। নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন ল্যাবে আমি একা । চারদিকে আলো আঁধারের পরাবাস্তব ছায়া ছায়া আলো । কিছুতেই একটি রিয়াকশন মিলাতে পারছি না। একের পর এক সম্ভাব্য কেমিক্যাল,রিয়াজেন্ট জারে ঢালছি। গোলাকার জারটার ভেতর আজব রঙের কেমিক্যাল থকবক করে উঠছে । হয়তো তখনই কেউ একজন আতঙ্কিত হয়ে সশব্দে সতর্ক করে বলবে ” এই মণি, করছো কী? মণি, মণি, সাবধান! সাবধান মণি। ওটা ঢেলো না। ব্ল্যাস্ট করবে। এক্সিডেন্ট করবে তো! সরে এসো ওখান থেকে। এই, এই যে দেখো, এদিকে তাকাও, আমার সবগুলো নোটস নিয়ে এসেছি। এখানে স্টেপ বাই স্টেপ মেজারমেন্ট, টাইমিংসহ সবকিছু লেখা আছে। এগুলো দেখে ঢালো।”
আমি চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখবো, রক্তমাখা হাতে একগাদা নোটস নিয়ে ছেঁড়া ফাঁড়া রক্তাক্ত দেহে সে দাঁড়িয়ে আছে। নোটস গুলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে ,,,
দরজায় টোকা পড়তেই চমকে উঠে বসলাম।
রূপার মা ডাকছে।
“ছোটআম্মা, ও ছোটআম্মা, ভাইজান আফনারে ডাকতেছে। ও ছোটআম্মা,,,”
দরজা খুলে রূপার মাকে বললাম, “এভাবে চিৎকার করছো কেন খালা ? জানো না, শব্দে আমার মাথা ধরে যায়?”
রূপার মা মুখ নিচু করে বললো, “ভুল অইছে গো ছোট আম্মা।”
আমি কিছুটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলাম। বহুদিন বাবার সাথে আমার তেমন কথাবার্তা হয়না। অবশ্য ঘরের কারোর সাথেই তেমন কথা হয়না। মায়ের সাথে প্রয়োজনে দু’একটি কথা হয় দিনেরাতে। সালমাকে দারোয়ান চাচা নিয়ে এসেছেন। মেয়েটি আর আগের মত কথাও বলেনা, হাসেও না। নিরবে আমার ঘরদোর গুছিয়ে রাখে। আমার চুল আঁচড়ে দেয়।
মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই বাবা বললেন, “ভেতরে এসো।” ভেতরে ঢুকলাম। বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম নিরব আজ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে বাড়ি। আপা ভাইয়া, ছোট ভাইজান কোথায়? ভাইয়া লন্ডন থেকে এসেছেন আপাকে নিয়ে যাবেন এবার। তারা হয়তো কোথাও গেছে। ভাইয়া লন্ডন থেকে আসার পর বিশাল আয়োজন করে তাদের রিসেপশন হয়েছে। ছোট খালু আর বড় মামাকে সাথে নিয়ে বাবা নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছেন। মিমাংসার চেষ্টা করেছেন। তারা অনড়। রিসেপশনে ভাইয়ার বাড়ির কেউ আসে নাই। তাতে ভাইয়ার মন কিছুটা খারাপ হলেও কোনো আফসোস নাই। ভাইয়া একাই তাদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে সালাম করে এসেছেন। আপাও যেতে চেয়েছিলেন। উত্তরে ভাইয়া বলেছেন, “ধৈর্য্য ধরো, ওরাই তোমার কাছে আসবে।” একথা শুনে আপা অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। আপার কান্না দেখে আমার খুব মায়া লেগেছিল। আহারে, একটি লাল টুকটুকে নতুন বউ তার শশুর শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারলো না। তাঁদের বুকভরা আশির্বাদ থেকে বঞ্চিত হলো। আবারও মনে পড়ে গেল এসবের জন্য আমিই দায়ী। আবারও কি আপাকে “স্যরি” বলে আসবো? কিন্তু গেলাম না। মনে মনে বললাম, “ওইসব অমানুষদের আশির্বাদ তোমার দরকার নাই আপা। তুমি এমনিই ভাল থাকবে, অনেক ভাল থাকবে। ভাইয়া তোমাকে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসে। এই আশির্বাদটুকু শুধু যত্ন করে রেখো। ভাইয়ার এই অকুণ্ঠ ভালবাসাই তোমার শিবমন্দির । তোমার কৈলাশ।” রিসেপশন শেষে বাসায় ফিরেও আপা কাঁদছেন। কী সুন্দর করে সাজানো হয়েছে আপাকে। এত্তবড় একটি খোঁপা। ডানদিকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। সিঁথি বেয়ে নেমে এসেছে জড়োয়া টিকলি। কপাল জুড়ে এত্তবড় একটি টিকলি। আপাকে আজ পরীর মত দেখাচ্ছে। পরীর চোখের জলে কাজল ধুয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মাথার স্বচ্ছ জড়োয়া সোনালী ওড়না ঘাড়ে এলিয়ে পড়েছে। সজ্জিত অথচ খানিক আলুথালু আপাকে স্বর্গের দুঃখী কোনো অপ্সরার মত দেখাচ্ছে। আমার মন আরও খারাপ হয়ে গেল। অপরাধবোধের দহনে পুড়ে খাক হতে থাকলাম। হঠাৎ নজর গেল আপার কপালের শ্বেত চন্দনের শৈল্পিক নকশার দিকে। কিই যে অপুর্ব নকশা করেছে। মধ্যে, কপালের ঠিক মাঝখানে লাল টকটকে একটি টিপ। লাল টিপের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি।
” আমারও স্মরণ শুভ সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো তোমার ললাট চন্দনে।”
টিপের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে মনে মনে নীরবে গুনগুন করে উঠলাম ।
ভয়ে ভয়ে আমি আপার সামনে গিয়ে বসলাম। আমাকে আবারও কিছু লাথি চড় থাপ্পড় দিলে যদি আপা শান্ত হয়। যদি আবারও আমি আপাকে “স্যরি ” বলার সুযোগ পাই। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না।
বুঝাই যাচ্ছে, এই মুহুর্তে ছোট ভাইজানও বাড়িতে নাই। অদ্ভুত রকম নিরবতা বিরাজ করছে আজ বাড়িটিতে । ঝড় ওঠার আগে যেমন সব থমকে যায়, হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে, কোনো পোড়ো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ নিজের শোকার্ত অতীত , দুঃসহ বেদনা, বিরহ বিষাদ বিচ্ছেদ, অকাল, অস্বাভাবিক মৃত্যু আর ভয়াবহ স্মৃতির ভার নিজস্কন্ধে নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিরবতা ভেঙ্গে বাবা বললেন, “বসো।”
আমি ধীর পায়ে বিছানার একপ্রান্তে বসলাম। অপর প্রান্তে মা চুপচাপ বসে আছেন। বাবা সোফায় হেলান দিয়ে ছাদের দিকে চেয়ে আছেন। ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছি না। আবারও কি কেউ খুন হয়েছে? নাকি আবারও আপার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে? দু’তিন বছর যাবৎ আমি ভাবতে শুরু করেছি, এ বাড়িতে যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। আবারও কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে??? এই প্রচন্ড গরমেও আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
বাবা নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, “তুমি কি জানো, তোমার দাদি কিভাবে মারা গেছেন ? তোমার মায়ের প্রথম ছেলেটির মৃত্যু কিভাবে হয়েছে? তুমি কি জানো, তোমার দাদি আর আমাদের প্রথম ছেলে যার বয়স হয়েছিল মাত্র ছ’মাস, তারা দুজনেই সম্পুর্ন বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে?”
আমি না সুচক মাথা নাড়লাম। মনে করার চেষ্টা করলাম, তারাও কি আমার কোনো অপকর্মের কারণে মারা গিয়েছিল? আমি কি তাদেরও মৃত্যুর জন্য দায়ী??? কিন্তু, আমিতো তখন জন্মাই-ই নাই। ততক্ষণে দাদিজান আর মায়ের প্রথম সন্তানের মৃত্যুর জন্য আমি কিভাবে দায়ী হতে পারি তা খুঁজতে শুরু করে দিয়েছি।
তারপর, বাবা বলতে শুরু করলেন।
বললেন এক নির্মম দুঃসহ বেদনার্ত কাহিনী।
১৯৪৮ সালের জোড়া মৃত্যুর মর্মস্পর্শী কাহিনী।
কাঁপা কাঁপা আর্দ কন্ঠে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন বাবা আর বিছানার একপ্রান্তে বসে নিরবে কেঁদেই চলেছেন আমার মা। বিছানার অপরপ্রান্তে বসে আমি বাবার বিবরণ শুনছি আর মাঝে মাঝে ক্রন্দনরতা মায়ের দিকে বেদনার্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি। মায়ের ঘরের সোফায় বাবা বসে আছেন। রাত পোনে এগারোটার মত বাজে তখন। বাবার বিবরণ শেষ হতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। বাবা বারবার থামছেন। স্প্রে পাফ নিচ্ছেন। বাবার এজমা আছে। তারপর নিজেকে সামলে আবারও শুরু করছেন। একসময় তাঁর অতীতের বেদনার্ত দুর্ঘটনার বিবরণ শেষ হলো।
চারদিকে সুনসান নিরবতা। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। বাবা মুখ নিচু করে কাঁদছেন। মা মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদছেন। মাঝখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি।
কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৪৮ সালে। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এমন ঘটা করে এই নির্জন রাতে অতীতের এইসব দুঃসহ মর্মভেদী কাহিনী কেন বাবা মা যৌথভাবে আমাকে শুনালেন? দাদিজান আর তাদের প্রথম পুত্রের মৃত্যুর সাথে তো আমার কোনো কথিত অপকর্মের যোগাযোগ খুঁজে পেলাম না। অকথিত অপকর্ম থাকলেও থাকতে পারে, যা আমি জানিনা।
মুখ নিচু করে অস্ফুটে বললাম, “আই এম স্যরি বাবা।” বিস্ময়ে খেয়াল করলাম, আমার কন্ঠ একটুও কাঁপলো না । এটুকু বলতে আমার গলাও ভারি হয়ে উঠলো না । আমি যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবেই অন্য দশজনের মতই বললাম, “ট্রাজিক হিষ্ট্রি। ভেরি স্যাড। আই এম স্যরি ওয়ান্স এগেইন বাবা ।” আবার খানিক চুপ থাকলাম। আসলে আমি তাদের কাছ থেকেই আমার দায়টি জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা দুজন কিছুই না বলে অনবরতঃ কেঁদেই চলেছেন।
একসময় আমি আমতা আমতা করে বললাম, “কিন্তু, বাবা, আমার তো তখন জন্মই হয় নাই। তারপরও দাদিজান আর তোমাদের প্রথম ছেলের মৃত্যুর জন্য কি তোমরা আমাকে দায়ী করতে চাও ?”
বাবা মা দুজনেই কান্না বন্ধ করে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তাঁদের চোখে এখন বেদনার্ত অশ্রুর পরিবর্তে অপার বিস্ময়। কেউ কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একবার বাবার দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছি। দুজনের কাছ থেকেই উত্তর আশা করছি। আমি দায়ী হলে আমাকে শাস্তি দিক। মারুক। আবারও বলুক, “মরিস না কেন তুই”।
বাবা চশমার কাঁচ মুছে চশমা চোখে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা কেমন দিয়েছো?”
কিসের মধ্যে কী!!! ছিল ১৯৪৮ সালের ট্রাজেডিতে এখন হুট করে একলাফে চলে এলো আমার ইউনিভার্সিটির এডমিশন টেস্টে!!! আজব তো! তাও এই মধ্যরাতে!!! কী হয়েছে আজ এনাদের?
বললাম, “ভাল খারাপ মিলে দিয়েছি। ঠিক বলতে পারছি না কোন পরীক্ষা কেমন হয়েছে।”
—“কিসে পড়বে ঠিক করেছো?”
–“যেখানে চান্স পাবো সেখানেই ভর্তি হয়ে যাব।”
–“যদি কোথাও চান্স না পাও, তবে?”
–“তবে সামনের বছর ট্রাই করবো। আর ইডেনে ভর্তি হয়ে থাকবো। ইডেনের পরীক্ষা ভাল হয়েছে। চান্স পেয়ে যেতে পারি। যদি ইডেনে ভর্তি হতে পারি তবে সামনের বছর আর ইউনিভার্সিটি ট্রাই করারই দরকার নাই। ইডেন আমার জন্য যথেষ্ট ভাল।”
বাবা নিরাসক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। মা খানিক অস্থির হয়ে বললেন, “তোমাকে এই রাত দুপুরে কেন তোমার দাদিজান আর আমাদের প্রথম ছেলের মৃত্যুর কাহিনী শোনালেন তোমার বাবা তা কি আসলেই বুঝতে পারছো না?”
ধীরে ধীরে বললাম, পুরোপুরি বুঝতে পারছিনা। তবে দাদিজান আর তোমাদের প্রথম ছেলের মৃত্যুর জন্য যে আমিই দায়ী এটুকু বুঝতে পারছি। আমাকে শাস্তি দাও। গালাগাল করো। আমাকে মরে যেতে বলো।
আমাকে মারো। লাথি কিল ঘুষি চড় থাপ্পড় মারো, জোরে জোরে মারো। ছোট ভাইজান ভাল মারতে পারে। তাকে ডাকবো? আপাও ভাল পারে। তারা বাইরে কোথাও গিয়েছিল। গাড়ির শব্দ শুনলাম । মানে তারা ফিরেছে।
ডাকবো?”
বাবা মা দুজনেই বিব্রতবোধ করছেন। তারা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, এরপর কি হবে বা আমার কী করা উচিৎ । ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়ালাম। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললাম, “মনে হয় তোমাদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার শাস্তি নির্ধারন করতে হবে। তাহলে আগামীকাল রাতে আবার ডেকো। সকালেও ডাকতে পারো। আমার ক্লান্তি লাগছে , এখন যাই, ঘুমোবো।”
বাবা বললেন, “বসো।” বাবার নরম কন্ঠ শুনে চমকালাম না। এরা তো একদা ঠান্ডা মাথাতেই আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। অতএব, এদের নরম কন্ঠ আমার জন্য আরও বেশী ভয়ঙ্কর কিছু। তাদের নরম কন্ঠে আমি আর বিভ্রান্ত হই না।
আমি আবারও বসলাম।
বাবা বললেন,
“তুমি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা যে ইচ্ছে করেই খারাপ দিয়েছো তা আমি জানি। কিন্তু তোমার জন্য দুঃসংবাদ, তারপরও তুমি চান্স পেয়েছো।”
বাবার দেয়া তথ্যে আমি নির্বিকার, নির্লিপ্ত । মেডিকেল সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ নাই। সেখানকার ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টও আমার জন্য দুঃসংবাদ বা সুসংবাদ ইত্যাদি কোনো অনুভূতির মধ্যেই পড়েনা। মুলতঃ আমি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে চাইনি। নেহাতই ছোট ভাইজান ফর্ম এনেছিল তাই পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
নিস্পৃহ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে নিরাসক্ত কন্ঠে বললাম, “ও আচ্ছা।”
বাবা জিগেস করলেন , “মেডিকেলে পড়তে চাও না?
নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম,
–“নাহ”
–“কেন?”
–“আগ্রহ নাই”
–“ডাক্তার হলে অনেক রুগীকে সুস্থ্য করে তুলতে পারবে। বাঁচাতে পারবে। তোমার দাদিজান আর আমাদের প্রথম ছেলের মত অনেকেই আর বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেনা হয়তো।”
এতক্ষণে বাবা মায়ের আসল উদ্দেশ্যটা ধরতে পারলাম।
এটাই তাহলে এবারের শাস্তি।
এবারের শাস্তিটিতে বেশ নতুনত্ব আছে। মোটামুটি হাই লেবেলের ইন্টালেকচ্যুয়াল সাইকোলজিক্যাল পানিশমেন্ট। ভুল করে যে ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ফেলেছিলাম ,ভুল ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম, এবার সে ঘর থেকে আমাকে বিতাড়িত করা হবে। শাস্তির আভিজাত্যে আমি মনে মনে চমকে উঠলাম। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসলাম। শীতল কন্ঠে বললাম, “দাদিজান আর তোমাদের ছেলের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে সেজন্য আমি যথেষ্ট দুঃখিত, ব্যথিত। কিন্তু তাঁদের এমন নির্মম মৃত্যুর দায় আমি কেন নেবো? তোমাদের জীবনের সব ট্র্যাজেডির দায় নিয়ে আমি কেন আমার জীবনকে নরক করে তুলবো? ডিড আই কিল দেম? ডু ইউ ওয়ান্ট টু ব্লেইম মি ফর দেয়ার ট্র্যাজিক ডেথ? নো নো, ইট’স রং। টোটালি রং। ইউ কিলড ইউর বিলাভড মাদার & ইউর কিড। ইউ ডিড নট মিট দেম নট আ সিঙ্গেল মোমেন্ট ফর লং এইট মান্থস। ইভেন ইউ ডিড নট থিঙ্ক এবাউট দেয়ার সিচ্যুয়েশন উইদাউট ইউ। ইউ অয়ার বিজি ফর ইউর জব, রানিং আফটার ইউর ব্রাইট ফিউচার এন্ড মেকিং মানি। ডিডেন’ট ইউ?”
মা দৌঁড়ে এসে আমার মুখ চেপে ধরলেন। বাবার মুখটা নুঁয়ে পড়েছে। বাবা হাপাচ্ছেন। কাশি উঠেছে। হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরেছেন। কিন্তু পাশেই স্প্রে বটল পড়ে আছে সেদিকে খেয়াল নেই। মা আমাকে টেনে ঘর থেকে বের করে দিলেন । তারপর, দৌঁড়ে বাবার কাছে গেলেন।
আমি ধীর পায়ে আমার ঘরে চলে গেলাম।
আমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বেলকুনীতে দাঁড়ালাম।
শরতের ঝকঝকে স্বচ্ছ আকাশে কার মুখ ভেসে ওঠে? তাঁর দিকে তাকিয়ে বিষন্নভাবে হাসলাম। বললাম, “কাঁশফুলেরা মন্দমধুর হাওয়ার দুলছে। আমি কাঁশবনে যাবো।
নিয়ে যাবেন?”
সেরাতে বাবাকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলার পর থেকে নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলেও বিছানায় গড়াগড়ি করছি আর ভাবছি, ফুপ্পির সাথে কথা বলা দরকার। দরজায় টোকা দিয়ে সালমা বিষন্ন মিহিকন্ঠে বললো, “আফু, আফনের চা।” বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে সালমাকে ফিসফিস করে বললাম, “সালমা আপু, আজ চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, এক কাপ ব্ল্যাক কফি দেবে?” সালমা মাথা কাত করে সম্মতিসুচক ইশারা করে চলে গেল। অথচ, আগে সালমা ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে বলতো, “ইছ ছি রে, প্যাট ফুটা হইয়া যাইবো তো আফু। রাইতে ঘুম অইতো না। বিছানায় খালি মুড়ামুড়ি করতেন, না না, আফু, খালাম্মায় বকপো। আমি দিতাম ফারতাম না।” তখন আমি বলতাম, “চুপ করে রূপার মাকে বলো, সে চুপিচুপি দিয়ে যাবে।” এখন আর এসব অভিব্যক্তি সালমার নাই। আমার আসলে কফি খাবার ইচ্ছা ছিলনা। কফির কথা বলেছিলাম, সালমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। মেয়েটি কবে স্বাভাবিক হবে!!! ভাবতে গিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল ।
ব্রেকফাস্ট ঘরেই দিয়ে গেছে সালমা । আমি ঘরেই অপেক্ষা করছি। ফুপ্পির কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তা এখনই সম্ভব নয়। কারণ, গাড়ি বেরিয়ে গেছে। কোথাও গেলে আগের দিন বলতে হয়। কোনো না কোনো কাজের কথা বলে বেরোতে পারি। আর গাড়ি ছাড়া মা বেরোতে দেয় না। আমি বাসার ল্যান্ডলাইন থেকে কখনও ফুপ্পিকে ফোন করিনা। অবশ্য এখন মা ছাড়া আর কেউ বাড়িতে নাই। তবুও ল্যান্ডফোন থেকে ফুপ্পিকে ফোন করবো না। আর ফুপ্পি তো বলেছেন, “সবসময় নিজের বিবেকের কথা শুনবে। তোমার বিবেকই তোমার বেষ্ট টিচার, বেষ্ট ডক্টর, বেষ্ট ফ্রেন্ড ।” আপা ভাইয়াও বেরিয়ে গেছে। গাড়ির শব্দ শুনেছি। বাবাকে অফিসের গাড়ি আনা নেওয়া করে। ছোট ভাইজান আবার আমাদের গাড়িতে চড়ে না। সে লেটেস্ট মডেলের বাইক চালায়। আর বলে, অমন রদ্দামার্কা গাড়িতে সে চড়বে না। সে মার্সিডিজে চড়বে। হুট করে মনে হলো, আচ্ছা, ছোট ভাইজান কী দাদিজান আর বাবামায়ের প্রথম সন্তানের মৃত্যুর মর্মান্তিক কাহিনীটা জানে?
মিলি আপার গেষ্ট এসেছে। নিচের থেকে মুখ উঁচু করে আমার নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডেকেছেন। আমি আসলে কিছুই শুনতে পাইনি। রুম থেকে মিলি আপা ডাক শুনে বেরিয়ে এসেছে। আমার মাথায় একটা টোকা দিতেই আমি এমনভাবে চমকে উঠলাম, আমার হাত থেকে চায়ের কাপ পিরিচ পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মিলি আপা থতমত খেয়ে বললো, “এটা কি হলো!!! কিই যে হয়েছে না তোর আজ? খালি চমকাচ্ছিস? দেখতো, এতো সুন্দর কাপটা পড়ে ভেঙে গেল!” আমি একটু হেসে বললাম, “ঢেপসি ভেঙেছে, কিন্তু কারো হাত পা বুক তো চেরেনি। আপনি নিচে যান, রাশেদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।”
মিলি আপা রুমে ফিরে চুলের উপর দিয়ে হালকা আঁচড়ে নিচে গেল। আমি ততক্ষণে কাপ পিরিচের ভাঙা টুকরোগুলো তুলে খালি চানাচুরের প্যাকেটে সাবধানে রাখলাম। ডিনারের সময় ডাইনিং এর ডাস্টবিনে ফেলে দেবো।
দেড়/দুই বছর আগের ঘটনা থেকে আজ আর বেরোতে পারবো না মনে হচ্ছে। আমি আবারও সে অতীতে ডুবে গেলাম।
মিলি আপা আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছে। তখনও আমি একইভাবে বেলকুনীতে চেয়ারে বসে আছি। অন্যান্য রাতেও বসে থাকি তবে লেডিস হোস্টেলের নিচে যখন লোকজন বেশী হয়ে যায় তখন চেয়ারটা ভেতরের দিকে সরিয়ে রুমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসি। একনাগাড়ে বসে থাকার অভ্যাস আমার নাই। তাই মাঝেমধ্যে উঠে দাঁড়াই, বেলকুনী জুড়ে হাঁটি। আমাদের রুম দোতলায়। তাই বিল্ডিংয়ের সামনে সরু পিচঢালা হাঁটাপথ ও সামনের লন থেকে বেলকুনীর সামনের দিকটা সহজেই সবার চোখে পড়ে।
মিলি আপা বললেন, “তুই একইভাবে বসে আছিস? নিচের সবাই তোকে দেখছে। তোর রাশেদ ভাই জিগেস করলো, কি হয়েছে মণির?”
আমি তখন সম্বিত ফিরে পেলাম। এতক্ষণ তো দেড়/দুই বছর আগের সেই কঠিন যুদ্ধের ময়দানে ছিলাম। তাড়াহুড়ো করে দাঁড়াতে গিয়ে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো । মিলি আপা “আরে, কি হলো ” বলে ঝটপট আমাকে ধরে আবারও চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ক্লান্ত ভঙ্গীতে হেসে বললাম, “কিছু হয়নি মিলি আপা। ফার্স্ট প্রফ সিন্ড্রোম।”
আমি সাধারণতঃ ডিনারের পর কিছুক্ষণ বেলকুনীতে হাঁটাহাঁটি করে রাত দশটার দিকে পড়তে বসি। সন্ধ্যারাতে আমার পড়া হয়না। রুমমেট আপারা বলে, “ওই যে নাইই গার্ড পড়তে বসলেন।” মিলি আপা কখনোই রাত জেগে পড়তে পারেনা। তার এখন ফোর্থ ইয়ার চলছে। তিনি বড়জোর ১১ টা পর্যন্ত খুব কষ্টে পড়েন। তারপর বিছানায় এলিয়ে পড়ে। এটাতেই আমার সুবিধা। মিলি আপার সারা আর আমার শুরু। আমি আর মিলি আপা সিঙ্গেল চৌকিতেই ডাবলিং করি। দুজনেই তালপাতার সেপাই। গরম বেশী পড়লে অবশ্য মিলি আপা মেঝেতে গড়াগড়ি করে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
হোস্টেলের প্রতিটি রুমে তিনটি করে বেড। তিনটি বেড সাথে তিন সেট চেয়ার টেবিল। প্রতিটি টেবিলের সাথে ওয়াল সেটিং শেড দেয়া টেবিল ল্যাম্প। অর্থাৎ, কেউ একজন ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়লে অন্যদের ঘুমের সমস্যা হবেনা। সেন্ট্রাল লাইট সন্ধ্যারাতে জ্বালানো হয়। পরে রাত দশটার দিকে নিভিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া, কারো প্রচন্ড মাথা ধরলে, সে একটু চোখ বুজে বিশ্রাম নিতে চাইলে সেন্ট্রাল লাইট বন্ধ করে দেয়া হতো। তাই মিলি আপার পড়া শেষ হলে আমি নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে পড়তে বসতাম। প্রতি রুমে চারটি ওয়াল সেটিং আলমিরাও আছে । ওয়াল সেটিং আলমিরা তিনটি তিনজনের জন্য। চার নম্বরটি কমন। সেটি ব্যবহৃত হয় প্লেট, গ্লাস, পানির জগ, কাপ পিরিচ, চামচ, সসপেন, ভাতের ডেকচি, ছোট কড়াই, তাওয়া,পিড়ি বেলুন, খুন্তি, চা পাতির কৌটা, গুড়ো দুধের কৌটাসহ গুড়ো হলুদের কৌটা রাখা হয় সেখানে। তখনও বাজারে গুড়ো মরিচ, গুড়ো জিরে আসে নাই। ঝুড়িতে সবজিও রাখা হয়। চাল ডাল, আলু, শুকনো মরিচ, কাঁচা মরিচ, পেয়াজ রসুন, আদা ইত্যাদিও ওই আলমিরায় রাখা হয়। মিলি আপার বেডের আড়ালে ইলেক্টিক হিটার ফিট করা হয়েছে। এ রকম সব রুমেই আড়ালে আবডালে ইলেক্ট্রিক হিটার আছে। যেখানে আমরা চুরি করে চা বানাই, রান্না করি। হোস্টেল সুপার ভিজিটে আসলে হিটার তারসহ গুটিয়ে চৌকির নিচে ট্রাঙ্কের পেছনে ঢুকিয়ে দেই।
হোস্টেলে ইলেক্ট্রিক চুলো হিটার ও ইলেক্ট্রিক ইস্তিরি নিষিদ্ধ।
তবে সিলিং ফ্যান ও টেবিল ফ্যান দেখলেও সুপাররা কিছু বলেন না। ইলেক্ট্রিক ইস্তিরির বদলে প্রাগৈতিহাসিক আমলের লোহার ইস্ত্রি ব্যবহার করে মেয়েরা। কিচেনের চুলো থেকে জলন্ত কয়লা কিচেনের খালারা মাটির মালসায় তুলে দিতো লোহার বিশাল চামচ দিয়ে। মালসার উপরে লোহার ইস্ত্রি রেখে গরম করা হতো তারপর ডাইনিং এর পরিস্কার টেবিলে সুতির ওড়না ভাজ করে তার উপরে এপ্রোন, জামাকাপড় ইস্ত্রি করা হতো। তবে তা লোক দেখানো। মুলতঃ হিটারের উপর রেখে আমরা ইস্তিরি গরম করতাম। এপ্রোন ইস্ত্রি না করে ক্লাসে গেলে সবকিছুর সঠিক উত্তর দেয়া সত্ত্বেও আইটেমে শুণ্য দিতেন স্যাররা।
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে কেউ রুমের সিট পায়না। নতুন ভর্তি হয়ে মেয়েরা দোতলা ও তিনতলার কমনরুমে আর প্রেয়ার রুমে চৌকি পেতে লঙ্গরখানার মত থাকে। তারপর তৃতীয় বর্ষে বিভিন্ন রুমের সিট খালি হলে মেয়েদের নামে সিট এলোট হয়।
সেরাতে আর পড়তে বসলাম না। ডিনার করে বেলকুনীতে বসে আছি। মিলি আপা বললো “ঘুমো। আজ আর পড়ার দরকার নাই।” আমাকে একটি পিরিচে ডিম পোচ দিয়ে গেল মিলি আপা। বললো, “খেয়ে নে। প্রেশার ফল করেছে তোর।”
রাত দশটার মত বাজে। লেডিস হোস্টেলের নিচে এখন আর কেউ নাই। ভিজিটিং আওয়ার ন’টায় শেষ । তারপরও অনেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত থাকে। ওদিকে থার্ড ইয়ার, ফোর্থ ইয়ার, ফিফথ ইয়ারের আপাদের হাসপাতালের ওয়ার্ড ক্লাস মাঝেমধ্যে অনেক দেরীতে শেষ হয়। তারা দশটার পর দল বেঁধে ফেরে। যদিও তাদের পৌঁছে দিতে তাদের কয়েকজন ছেলে ক্লাসমেট তাদের ঘিরে লেডিস হোস্টেলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। মাঝেমধ্যে নোটস এর জন্য কেউ কেউ মেইন গেটের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো আপা রুম থেকে নোটস নিয়ে গেটে ওই ভাইয়াকে দিয়ে আসে।
এতোকিছু ভাবছি কিন্তু তখনও দেড় বছর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছি।
ব্রেকফাস্ট করে বেলকুনীতে এসে দাঁড়িয়েছি।
তুজো তুজো তুলোর মত শ্বেতশুভ্র মেঘেদের ফাঁকে অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল নীল আকাশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে হাসছে। মধুমাখা মিষ্টি হাসি । আমি যেন তার ছেলেবেলার সই। তার হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো গোপন মিষ্টি কথা। কানে কানে বলার আগে মুখ টিপে একচোট হেসে নিচ্ছে। তার কান্ড দেখে আমি রেগেমেগে বললাম, “কিরে ভাই, খবরটা দিলে দে না? এতো ঢং করার কি হলো!”
ঝকঝকে উজ্জ্বল রোদের সকাল হাসতে হাসতেই বেহায়ার মত দুপুরের গায়ে ঠেশ দিয়ে হেলে পড়লো।তারপরও আমার দিকে তাকিয়ে কেমন নিলজ্জের মত হাসছে। আমি লাঞ্চ করে ঘরে ফিরে দেখি, আমার ঘরে আলোর বন্যা। সে আলোয় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করলাম,
“আকাশ আমায় ভরলো আলোয়,
আকাশ আমি ভরবো গানে”।
খাটের কোণায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরো ঘরটি দেখছি । আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া ঘরটিকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। অপার্থিব কিছু একটা । কিছুই অদলবদল হয়নি তবুও ঘরটির প্রতিটি অংশ অন্যরকম লাগছে। ঘরের কোণের জাল জাল বাঁশের ল্যাম্পটাও হাসছে।
আমি গীতবিতান খুলে বসলাম।
আমার সকল অনুভূতির জনম জনমের সাথী “গীতবিতান”।
বড় যত্নে গীতবিতানের পাতা উল্টোচ্ছি।
“নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে
বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে
জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা”
“মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা
পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা”
ঘরে, বেলকুনীতে হাঁটতে হাঁটতে আমি গুনগুনিয়ে উঠলাম।
সকাল, দুপুর, শরতের সোনারং লম্বা বিকেল এভাবে একসময় লাজে রাঙা গোধূলিকেও হাসিয়ে নাচিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে কানে কানে কি যেন বলে গেল।
“সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে…
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত”
আমি অস্থিরভাবে গীতবিতানের পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি ।
“সে যেতে যেতে চেয়ে গেল
কী যেন গেয়ে গেল…
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে”
পাগলের মত আমার গোপন আনন্দের কারণ খুঁজছি—
“সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে…
চাঁদের আলোর দেশে গেছে
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে…”
এইতো এখানে?
“মনে হল আঁখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব
ভাবতেছি তাই একলা বসে,,,”
এইখানে?
“সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর
সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর কুসুমবনের উপর দিয়ে
কী কথা সে বলে গেল,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেল রে।
হৃদয় আমার আকুল হল,
নয়ন আমার মুদে এলে রে…
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে
আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে??? ,,,”
জীবনে এই প্রথম কোনো সন্ধ্যায় আমি বিষন্নবোধ করলাম না। এই সোনাঝরা স্বর্ণালী সন্ধ্যাটিই যেন নতুন কোনো প্রাঞ্জল মন্দমধুর স্নিগ্ধ ভোরের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে আমাকে। কি যেন এক অজানা, অচেনা, বিহ্বল সুখানুভূতিতে আমি ভিজে একাকার হয়ে গেলাম।
আমি তখনও জানিনা, কোন মেডিকেল কলেজে আমার চান্স হয়েছে। ইউনিভার্সিটির রেজাল্টগুলো জানা দরকার। সন্ধ্যায় সালমা চা দিতে আসলে তাকে জিগেস করলাম, “মা কি একা আছে, নাকি আর কেউ মায়ের সাথে আছে?” সালমা বললো “খালায় বড় আফুর লগে কিজানি গুছায়।” সালমাকে বললাম, “রূপার মাকে পাঠিয়ে দাও।” রূপার মা রুমে আসলে বললাম, “খালা, মাকে বলো, আগামীকাল আমার গাড়ি দরকার। ইউনিভার্সিটিতে যাবো।” কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপার মা জানালো, “গাড়ি বড়আম্মার লাগবে। বড়আম্মা আর জামাই বাবা কোথায় নাকি যাবে।”
অনেক দিন ছাদে যাওয়া হয়না। অনেকদিন সপ্তর্ষিমন্ডল দেখা হয়না। অনেকদিন ছয়টা তারা গুনে সাত নম্বর তারাটির খোঁজে দিশেহারা হইনা। অনেকদিন ছাদে মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখিনা। আকাশের অজস্র অসংখ্য তারা নক্ষত্রদের সাথে গল্প করিনা। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আজ ছাদে যেতে। কিন্তু ছাদে আজকাল আপা ভাইয়া যায়। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা ছাদেই থাকে। রোমান্স করে। ছাদের দোলনায় বসে দুলে দুলে গল্প করে। মাঝেমধ্যে ওদের ফিসফিসানি আর মধুর হাসি বেলকুনীতে দাঁড়ালে আমি শুনতে পাই। ওরা দুজন চাঁদের রূপালি আলোয় ভেসে যায়, হেসে যায়, মিশে যায়। ময়ুরকন্ঠী রাতের নীলে, আকাশে তারাদের ওই মিছিলে গভীর আবেগে রূপকথার দেশে যায়।
আপা ভাইয়ার বিভিন্ন ফর্মালিটি করতে হচ্ছে। আপাকে লন্ডনে নিয়ে যাবার জন্য আর পারিবারিক ফর্মালিটি। ভাইয়া হয়তো এখনও আশায় আছেন, তার মা বাবা তাকে ডেকে পাঠাবেন। আজও হয়তো তারা ছাদে যাবে। তারাদের নীলাভ আলোয় পূণ্যস্নান করবে। দোলনায় দুলে দুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেলকুনীতে দাঁড়ালাম। আমার সুখানুভূতি ধীরে ধীরে অস্থিরতায় বদলে যেতে লাগলো । বাবা মা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা জানবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত এমন অস্থিরতা থাকবে। আসলে ঠিক তাও না। আমার নিজের, একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত এই অস্থিরতা থাকবে। ভাদ্র বা আশ্বিনের উজ্জ্বল ঝকঝকে নীলাকাশ তো কেবল হেসে চলে গেল। সোনাঝরা গোধূলিও কী সে সুখবর দিয়ে গেলনা? আমার সারাশরীরে আনন্দ মেখে দিয়ে গেল যে! সে আনন্দের সুগন্ধ আমাকে সুখের নেশায়, মুক্তির নেশায় একটু একটু করে মাতাল করে তুলছে । চোখে চোখে নেশা ধরে আসছে। অজানা নেশায় আমি আবারও বিপন্নবোধ করছি। আমার বিপন্নতায় যিনি সবসময় আমার মাথায় তাঁর হাত রাখেন,
তিনি কোথাও?
আমার গীতবিতান কোথায়?
অস্থির হয়ে ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ বেড সাইড টেবিলে রেখে আবারও গীতবিতানের কাছে ছুটে যাই । গীতবিতান তো পুরো বাড়ি আলোকিত করে আমার সিথেনেই রয়েছে। সারাদিন আজ গীতবিতানের পাতা উল্টে যাচ্ছি।
গীতবিতান, আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। আমার আনন্দ, বেদনায় সেই-ই মুর্ত হয়। দুর্যোগে আমাকে শোনায়,
“মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে
ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে,,,”
বিপন্নতায় বলে, “সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে, যাক না সুখ জ্বলে, জ্বলে।” ঈশ্বরের কাছে হাঁটুগেঁড়ে বসে বলি, “দয়া, তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে। নইলে কি আর পারবো তোমার চরন ছুঁতে? দয়া, তব দয়া,,, “
আমার সকল বিপন্নতায় রবীঠাকুর আমার পাশে এসে দাঁড়ান। রবীঠাকুর আমার শেষ আশ্রয়। দুঃসময়ে তিনি মাথায় হাত রেখে বলেন, “এখুনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা,,,”
রাতেও ডাক এলো না। আমি নিরবে ডিনার করে আবারও আমার ঘরে চলে এসেছি। বাসায় আজ সবাই আছে । রাত বারোটা বাজতে চললো, কিন্তু ডাক এলো না। তাহলে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাকে আর গাড়ি দেবে না? হতেও পারে। এই সিদ্ধান্ত আমাকে ডেকে নিয়ে ঘটা করে শোনানোর কিছু নেই বলেই হয়তো ডাক আসছে না। আমি গীতবিতান কোলে নিয়ে আকাশের নীলাভ আলো দেখছি। গুনগুন করছি,
“আমি মারের সাগর পাড়ি দেব
বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে,,,”
পরদিন খুব ভোরে মা এলেন কফি হাতে। ব্ল্যাক কফি। আমি তখনও বেলকুনীতে বসে আছি। ভোর তখন কেবল জাগছে। মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি বললাম, “মা, মেডিকেলের ভর্তি কবে থেকে শুরু?”
মা বিস্ময়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলেন। কফির কাপ হাতে ধরেই আছেন। কাপটা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে ভুলে গেছেন। সে হাত একটুও নড়ছে না। মাও নড়ছেন না। এমনকি, মায়ের শরীরের কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গও নড়ছে না। কিংবা মা আমাকে কঠিন করে বলছেন না, “মণি, এই নাও ব্ল্যাক কফি। রূপার মাকে দিয়ে চুরি করে আর ব্ল্যাক কফি খাবার দরকার নাই। যখন খাবে তখন বলবে। রূপার মা অথবা সালমা এনে দেবে।”
আমি মুচকি হেসে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে মায়ের হাত থেকে কফির কাপ নিলাম। ধোঁয়া উড়ছে। কফির মৌ মৌ গন্ধ বুকভরে নিলাম। নেশা আরও চড়ে গেল। একটু চুমুকও দিলাম। আহ, কী অপার শান্তি। আহ, কী সৌম্য, সুন্দর ভোর। আহ, কী মিষ্টি হাওয়া! যদিও খুব গরম পড়েছে কিন্তু ভাদ্র শেষের ভোরটা ভীষণ স্নিগ্ধ। ভীষণ শুদ্ধ। ভীষণ সিদ্ধ। শরৎ ভোরের স্নিগ্ধ মদে আমি তখন স্নান করছি।
আমার ভেতরে রবীঠাকুর গাইছেন,
“অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া,
দেখি নাই আমি দেখি নাই, এমনও তরণী বাওয়া।’
লনে, শিউলি তলা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। কফি খেয়েই আমি শিউলি কুড়োতে যাব। লনের শিশির ভেজা ঘাসে নগ্ন পায়ে আজ কিছুক্ষণ হাঁটবো। আচ্ছা, ভাদ্র মাসে কি শিশির পড়ে? নাকি আশ্বিন এসে গেছে? কিজানি। তবুও যাবো। বহু বহু বছর পর আজ ভোর দেখছি। ভোর যে এতো সুন্দর হয় তা আজকের আগে কখনও জানতাম না। ভাগ্যিস, গতরাতে ঘুমোয় নি। ঘুমিয়ে গেলে তো সেই আটটা, ন’টা। কিন্তু, মা কেন এতো ভোরে কফি নিয়ে আমার ঘরে?
ঠিক তখনই মা বললেন , “রমজান বললো, তুমি নাকি সারারাত বেলকুনীতে বসে ছিলে?”
রহস্যজনক হাসি হেসে বললাম, “না তো। বেলকুনীতে খানিক হেঁটেছিও। ঘরেও হেঁটেছি।”
–“কি হয়েছে তোমার?”
–“কি হবে আবার? কিছু হয়নি তো! কেন?
–“ব্রেকফাস্ট কি এখন করবে না পরে?”
–“উঁহু। এখন কফি খেতে খেতে লনে হাঁটবো। শিউলি কুড়োবো। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করবো।”
মা আরও কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।
আকাশে তখন রঙের ছটা।
আমি আকাশের দিকে চেয়ে গীতবিতান গুনগুন করেছি ,,,
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে
এই আকাশে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…”
খালি পায়ে লনের ঘাসে হাঁটছি। ডাইনিং থেকে ফুল কুড়োনো বেতের ঝুড়ি নিয়ে এসেছি। ঝুড়িতে হাতলও আছে। আপা কিনে এনেছিল কোত্থেকে জানিনা। শিউলি কুড়িয়ে ঝুড়িটা গাড়ি বারান্দার সিঁড়ির একধারে রেখেছি। ঘরে যাবার সময় নিয়ে যাবো। পায়ের পাতায় শিশির ভেজা ঘাস। ভোরের শিশিরে পা ভিজে একাকার। সারাশরীর শীতল হয়ে উঠছে। দুর থেকে ঘাসের মাথায় শিশির বিন্দুগুলো হীরের মত উজ্জ্বল আলোর ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি তাদের দেখছি আর ভাবছি, পৃথিবী এত্ত সুন্দর!!! আকাশের দিকে তাকালাম। পুব আকাশের ভোরের কুয়াশাবৃত সুর্য্য কুয়াশার ওড়না ছিঁড়েফুঁড়ে মিষ্টি রোদে পুরো আকাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। আকাশে আজ আলোর বন্যা। পশ্চিম আকাশে হালকা কিছু সাদা মেঘ তাদের শারদীয় যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আচ্ছা, এবার কি দেবী দুর্গা সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসবেন? কিজানি! মালি কাকুকে জিগেস করতে হবে। উত্তরে হালকা রোদের খেলা শুরু হয়ে গেছে। মধ্য গগন পুরোই নীল, গাঢ় নীল। আমি লনের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে উপরের দিকে চেয়ে রবীঠাকুরের মত বললাম,
“আকাশ ভরা, সুর্য্য তারা,
বিশ্বভরা প্রাণ।
তাহারই মাঝখানে, আমি পেয়েছি,
পেয়েছি মোর স্থান—
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।
আকাশ ভরা,,,”
ব্রেকফাস্ট করতে বসে সালমাকে বললাম, “সালমা আপু, গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে ঝুড়ি ভরা শিউলি ভুলে রেখে এসেছি। যাও না, নিয়ে আসো না। আজ আমাকে শিউলির মালা গেঁথে দিতে হবে কিন্তু।” সালমার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা। সে নিরস মুখে শিউলি ভরা ঝুড়ি আনতে চলে গেল। আমি নীরবে তার চলে যাওয়ার দিকে উদাস হয়ে চেয়ে থাকলাম।
আজ সারাদিন গান শুনছি। একটি গানই শুনছি। “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে। আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।” সুচিত্রা মিত্রের সে কি মুন্সিয়ানা। যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, তখন নিজেকে পাখি মনে হয়। মনে হয়, আকাশে উড়ছি। অনন্ত অসীম নীল আকাশে কোথাও কোনো খাঁচা নেই। সর্বত্র মুক্তির উন্মাদ আনন্দ-নৃত্য। প্রজাপতি কিংবা ঘাস ফড়িংও মনে হয় নিজেকে। মনে হয় ঘাসে ঘাসে উড়ে বেড়াচ্ছি। যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে উড়ছি। প্রজাপতির মত এ ফুল ও ফুল ছুঁয়ে দিয়ে আবারও আরেক ফুলের দিকে উড়ে যাচ্ছি। আজ সবকিছুই ভাল লাগছে। আজ সকালের হাওয়াও বলছে,
“ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভাল
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো,,, “
আচ্ছা, আজ রাতে কি পূর্ণিমা?
সন্ধ্যায় ব্ল্যাক কফি হাতে সালমা এলো। আমি হাসি মুখে কফির কাপ হাতে নিলাম। বললাম, “সালমা আপু, তুমি গীত গাইতে জানো? সে শুকনো মুখে বললো, “না আফু”। আমি বললাম, “আমি জানি, আমি গাই, তুমিও আমার সাথে গাইবে, চলো।” সালমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে কখনো আমাকে এমন উচ্ছল দেখে নি। তার কাছে আমাকে অপরিচিত লাগছে। অদ্ভুত লাগছে। সে অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। তারপর ঘোর কাটিয়ে জিগেস করলো , “আফনে সত্য গীত জানেন আফু?” বললাম, “জানি তো। শুনবে?” সে বেশ আগ্রহ নিয়ে ঘাড় কাত করে লম্বা টানে বললো, “হ্যাঁ,,,”
সালমা আপুর হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালাম। বললাম, “এইখানে বসো। আমার সামনে বসো। আমি যা যা বলবো, তুমিও তা তা বলবে। ঠিক আছে?” সালমা আপু সম্মোহিতের মত মাথা কাত করে সায় দিল।
“স্বপ্নে আইলো রাজার কুমার স্বপ্নে গেল চইল্যা
দুধের মতন সোন্দর কুমার কিছুনা গেল বইল্যা
কুমার কিছুনা গেল বইল্যা।”
আমি রিপিট করলাম৷
এবার সালমা নিজেই আমার সাথে গীত ধরলো। তারপর লজ্জা পেয়ে দু’হাতে চোখমুখ ঢেকে হেসে ফেললো।
আমিও জোরে হেসে সালমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “দ্যাট’স মাই লাভিং সালমা আপু।”
–“সালমা আপু, তোমাকে হাসলে এতো সুন্দর দেখায় তাতো আগে খেয়াল করিনি! আরেক্টু হাসো না সালমা আপু, প্লীজ, সালমা আপু ।” সালমা আপু আবারও হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, “এমনে এমনে কি হাসন যায় আফু। হি হি হি। আফু যে কি কয় না!!! হি হি হি।”
–“আইচ্ছা আফু, রাজার কুমার কি সত্যই দুধের মত সোন্দর? হি হি হি,,,”
আমিও হাসতে হাসতে বললাম, “হ্যাঁ তো। রাজপুত্র যে, সুন্দর তো হবেই। ফর্সা,গোলাপ ফুলের মত গায়ের রঙ আর কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো টেরিকাটা চুল।” সালমার চোখদুটো জ্বলে উঠলো আনন্দে। বুকে তার দোলা লেগেছে । চোখেমুখে একরাশ স্বপ্ন থই থই করছে। সে ফিসফিস করে জিগেস করলো, “রাজপুত্তুর বিয়া করে নাই?”
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আমি কি জানি? তুমিই ভালো জানো, তুমিই বলো।” আমার কথা শেষ হবার আগেই সালমা তার দু’হাতে আমার দুটো হাত ধরে দোলাতে দোলাতে খুশীতে টগবগ করে গাইতে শুরু করলো,
“কেমন তুমার পিতামাতা কেমন তাগো হিয়া
এতো ডাঙর হইছো কুমার না করাইছে বিয়া গো নাগর, ছাইড়া দেও কলসি আমার যায় বেলা,,,”
সাথে সাথেই আমি ধরলাম,
“ভালই আমার পিতামাতা ভালই তাগো হিয়া
তুমার মতন সোন্দর কইন্যার লগে দিব বিয়া গো কইন্যা, যাক যাক যাক বেলা–“
আমার শেষ হতেই সালমা আপু শুরু করলো,
“জল ভরো যইবতি কইন্যা জলে দিলা ঢেউ
হাসিমুখে কওনা কথা, ও কইন্যা,
হাসিমুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ গো কইন্যা”
তারপর আমরা দুজনেই,
“ছাইড়া দেও কলসী আমার যায় বেলা,,, “
ঠিক এ সময় সালমা আর আমি চমকে উঠলাম। দরদ ভরা কন্ঠে গাইতে গাইতে রূপার মা খালা ঘরে ঢুকছে,,,
“আমার হাড় কালা করলাম রে ও হো ও ও
দেহা কালার লাইগ্যা রে এ এ এ
অন্তর কালা করলাম রে দুরন্ত পরবাসী,,,”
রূপার মা খালা বেশ কিছুক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে যে আমাদের গীত শুনছিল আমরা তা জানতেই পারি নাই। হঠাৎই সে গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকলো।
তারপর তিনজনই জোরে জোরে হেসে উঠেছি। আর আমি তখন ভাবছি, সুর কোথায় নাই? রূপার মা খালা যার বাসন মাজতে মাজতে জীবনটাই পার হয়ে যাচ্ছে, তারও বুকভরা সুর। হঠাৎ সালমা বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। মা এসেছে। রূপার মাও জড়সড় হয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। মা একবার ওদের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে তিনিও হেসে দিলেন। তখন আমরা সবাই আবার একসাথে হেসে উঠলাম। সালমা লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। বহুদিন পর সালমাকে হাসতে দেখে আমার ভেতরে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার দৌঁড়ে পালিয়ে যাবার দৃশ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করতে থাকলাম। সে পালিয়ে যাবার পরও পরম মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে তার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
মনে মনে বললাম,
ইয়েস, আই ডিড ইট,
ফাইনালি, আই ডিড ইট।
রূপার মা কখন বেরিয়ে গেছে টের পাইনি। মা আমার দিকে গভীর স্নেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণের জন্য আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মা এসেছেন, আমাদের সাথে হেসেছেনও। সালমার এই অপরূপ উচ্ছলতা, চঞ্চলা হরিণীর মত দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার অসাধারন সৌন্দর্য্য আমাকে কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন করে রাখলো। আজ সালমা অনেকদিন পর হেসেছে, গেয়েছে, লাজে রাঙা হয়েছে। চঞ্চলা হরিণীর মত দৌঁড়ে পালিয়ে গেছে। সালমা ফিরে এসেছে। আজ রাতে আমি শরতের পূর্ণচন্দ্রের জোছনায় ভিজবো। চাঁদের গলে গলে পড়া রূপো সারা গায়ে মাখবো। আজ আমি জ্যোৎস্নার সাতনরি হার কন্ঠে দোলাবো। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আমি আরও আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
মা আমার দু’গালে দু’হাত রেখে আমার মুখটা তুলে ধরলেন। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, “জানো মণি, আমি সালমার জন্য ছেলে দেখছি। ভাল ছেলের সাথে এবার ওকে বিয়ে দেবো। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেবো। তুমি দেখে নিও, সালমা রাজরানী হবে।”
আমি প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে মাকে বললাম,
“থ্যাংকিউ মা ,,,”
এরপর মা ইতস্ততঃ করতে থাকলেন। আমি মুচকি হেসে মাকে জিগেস করলাম , “কিছু বলবে মা?”
–“হ্যাঁ।”
মা বিছানায় আমার সামনে বসলেন।
–“তোমার বাবা তোমাকে ডেকেছেন। যাবে?”
–“সেকি? যাবো না কেন? তুমি এভাবে বলছো কেন?”
–“না, মানে, মণি, একটি বিষয় তোমার কাছে স্পষ্ট করা উচিৎ আমার।” মা আবারও ইতস্ততঃ করতে থাকলেন।
আমি আবারও হালকা হেসে বললাম, “এতো সংকোচের কি আছে মা? বলেই ফেলো না।”
–“সংকোচ নয়, ভাবছি কিভাবে বলবো।” মা থামলেন। “মণি, তুমি মেডিকেলে না পড়তে চাইলে, পড়বে না। তোমার উপর আমাদের কোনো চাপ নেই। কিন্তু তোমার বাবাকে আর ওভাবে বোলো না প্লীজ! প্লীজ মণি,,,”
মা ভিখিরির মত যেনো আমার কাছে ভিখ চাইছেন। আমার খুব খারাপ লাগছে। আসলেই খুব খারাপ লাগছে । মায়ের হাত মুঠো করে ধরে বললাম,
–“আই এম স্যরি মা। ভেরি, ভেরি স্যরি। আর কখনোই বাবাকে এসব বলবো না। স্যরি, স্যরি মা।”
মা একটু হেসে আমার গাল ছুঁয়ে বললেন, “তাহলে এসো বাবার ঘরে। তিনি ওয়েট করছেন।”
সেদিনের মতই বাবা সোফায় বসে আছেন। বাবাকে খুব অবসন্ন দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাবা দু’রাতেই অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। বুড়ো মানুষদের মত সোফায় পা তুলে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছেন। আমাকে দেখে বাবার নুহ্যভঙ্গী একটুও বদলালো না। শুধু চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ তুলে বললেন, “বসো।”
তারপর সব চুপচাপ।
একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে বাবা বললেন ,
–“তুমি আগামীকাল ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট জানতে যাবে?”
–“হ্যাঁ বাবা।” মিথ্যে বললাম। আসলে আমি যাব ফুপ্পির কাছে।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তোমার উপর আমাদের কোনো চাপ নাই। তুমি ইউনিভার্সিটির যেখানে যেখানে চান্স পাবে, তোমার পছন্দ সই সাব্জেক্টে ভর্তি হতে পারো। ইডেনে ভর্তি হতে চাইলেও ভর্তি হতে পারো। তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর আমরা শ্রদ্ধাশীল।”
এটুকু কথা বলে বাবা হাঁপিয়ে গেলেন। পাশে রাখা স্প্রে পাফ নিলেন দু’বার। বাবার তো এজমা আছে। আমি বাবাকে স্পেস দিলাম। বাবার কথা এখনও শেষ হয়নি।
বাবা একটু সময় নিয়ে জিগেস করলেন, “তুমি নাকি সকালে তোমার মাকে জিগেস করেছো, মেডিকেলে ভর্তি কবে থেকে শুরু ?”
–“হ্যাঁ”
–“কেন?”
–“আমি মেডিকেলে ভর্তি হতে চাই?”
–“কেন?”
— “নোবেল প্রফেশন, তাই। মানুষের সেবা করার সুযোগ আছে।”
–“মানুষের সেবা করার জন্য পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, তারা করছেন, করবেন । তোমাকে কেন এ দায়িত্ব নিতে হবে?”
একটু থেমে বললাম,
–“বিকজ, ন্যাচার সিলেক্টস মি।”
–“কিভাবে বুঝলে?”
–“কিভাবে বুঝলাম জানিনা, তবে বুঝেছি।”
–“জীবনটাকে নরক বানিয়ে মেডিকেল পড়তে চাও? এই পেশায় সারাক্ষণ রোগশোক, জরা, জীর্ণ, মৃত্যু দেখবে। সহ্য করতে পারবে?”
আমি মুখ নিচু করে বললাম,
— “যা যা বললে, তার সবই অমোঘ বাস্তব। বাস্তব মেনে নেবার শক্তি হয়তো আমাকে আরও খানিক অর্জন করতে হবে। আমি নিশ্চিত , শক্তিটুকু আমি অর্জন করতে পারবো। আমার সে আত্মবিশ্বাস আছে।
আর বাবা, শুধু এসবই তো নাই এ পেশায়। রুগীকে বাঁচানোর আকাশচুম্বী আন্তরিক আকাঙ্খা আছে, সুস্থ্য করে তোলার গভীর তৃপ্তি আছে, চিকিৎসায় রোগমুক্তির অনাবিল আনন্দও তো আছে। সদ্য জন্মানো শিশুর কান্নায় বাবামায়ের উচ্ছ্বসিত, মমতা ভরা আনন্দাশ্রুও আছে।
বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
–“তাহলে, ভার্সিটির রেজাল্ট দেখতে যেতে চাইছো কেন?”
–“কৌতূহল বাবা।”
বাবা আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
–“তুমি কনফার্ম?”
–“কি বিষয়ে?”
–“মেডিকেলে ভর্তি হবার বিষয়ে।”
–“হ্যাঁ, কনফার্ম।”
আবারও খানিক থামলেন।
–“তুমি কি আমাদের কথা চিন্তা করে এমন ডিসিশন নিচ্ছো? যদি এমন কিছু হয়, খোলাখুলিভাবে বলতে পারো। আমাদের বিষয় যদি কোনো ভুমিকা রাখে তবে আমি বলবো, চেইঞ্জ ইউর ডিসিশন। কারণ, আমি চাইনা, ভবিষ্যতে তুমি আমাদের ব্লেইম করবে।”
বাবার এতগুলো কঠিন কঠিন কথায় এবার আমিও হাঁপিয়ে উঠলাম। একটু সামলে নিয়ে বললাম,
–“বাবা, এটা ১৯৪৮ সাল নয়। দাদিজান আর তোমাদের প্রথম ছেলে যেভাবে মারা গেছেন, এখন সেভাবে মৃত্যুর পার্সেন্টেজ খুব কম। তারপরও সে ঘটনা আমাকে প্রচন্ডভাবে উদ্বেলিত করেছে। ব্যথিত করেছে। এটা স্বীকার্য্য যে, ওই ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করেছে।
বাবা, মৃত্যুর কোনো চিকিৎসা নেই, অসুখের চিকিৎসা আছে। আমি জরাগ্রস্থ মানুষের কষ্টে, দুঃখে, যন্ত্রনায় তাদের পাশে থাকতে চাই। সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা করতে চাই।”
বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,
–“আচ্ছা। তবুও কাল দিনটা সময় নাও। ভেবে দেখো। যদি ডিসিশন চেইঞ্জ না করো তাহলে পরশুদিন ভোরে আমরা রওনা দেবো। ব্যগ গুছিয়ে নিও। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে ভুলো না। যদিও আমি রাতে ফাইনাল চেক করবো। ওখানে আমার কলিগ মানে তোমার বাচ্চু কাকুর বোন সরকারি স্কুলের টিচার। তাকে ফোন করে দেবে তোমার বাচ্চু কাকু। আমরা প্রথমে তার বাসায় উঠবো। তোমাকে নিয়ে তো অজানা অচেনা জায়গায় হোটেলে ওটা যাবেনা। মফস্বল শহর।”
–“আচ্ছা, বাবা।”
হোস্টেলের বেলকুনীতে হাঁটতে হাঁটতে দেড় বছর আগের কথা ভাবছি। বাবা আমাকে একদিন সময় দিয়েছেন ভাবতে।বাবার সাথে আগের রাতে কথা হবার পরদিন আমি গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। ফুপ্পির কাছে গেলাম। ফুপ্পি তাঁর অফিস রুমে কি যেনো ফাইল টাইল দেখছিলেন। আমাকে দেখে ফাইল থেকে মুখ তুলে বললেন, “আমার ঘরে গিয়ে বসো, আমি আসছি।”
আমি আর ফুপ্পি কফির কাপ হাতে নিয়ে মুখোমুখি বসে আছি। ফুপ্পি বললেন, “তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। হোস্টেলে নিজের মত করে থাকতে পারবে। নিজেকে আবিস্কার করতে পারবে। তোমার মনের লোহার শেকল ছিঁড়ে ফেলতে পারবে। মায়ার বন্ধন ঘুচে যাবে। যে আকুলতা এখনও তোমার মনের গভীরে গোপনে তোমাকে পুড়িয়ে যাচ্ছে সে আকুলতার বিনাশ ঘটবে। মানসিক দৈন্যতা আর থাকবে না। নিজেকে অপাংতেয়,অতিরিক্ত মনে হবে না। জড়বিষাদের ইস্পাত কঠিন দেয়াল ভেঙে আগুনের পরশমণির ছোঁয়া পাবে। এই বিশাল মহাবিশ্বের মাঝে নিজস্ব স্থান খুঁজে নিতে পারবে। ওটা তোমার অধিকার। মানুষের কষ্টে তাদের পাশে থাকতে পারলে তুমি অফুরন্ত তৃপ্তি পাবে। তুমি প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিতভাবেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।”
আমি চুপচাপ মন্ত্রমুগ্ধের মত ফুপ্পির দিকে চেয়ে থাকলাম।
বাবা আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর টেবিল চেয়ার চৌকি তোষক বালিশ চাদর প্লেট গ্লাস জগ চামচ ইত্যাদি কিনে লেবার মারফৎ সেগুলো দোতলায় তুলে দিয়ে গেছেন। মা আসতে চেয়েছিলেন সাথে গুছিয়ে দেবার জন্য, আমি মানা করেছি। বলেছি, আমিই গুছিয়ে নিতে পারবো। আমার সাথে অবশ্য বাবার কলিগের বোন ছিলেন। তিনি সরকারি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী এবং অবিবাহিতা। বয়স পঞ্চাচের মত হবে। খটমটে মেজাজের মহিলা হলেও তিনি আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেছিলেন। অতি আশ্চর্যের বিষয়, তিনি আর কখনোই আমার খোঁজ নিতে আসেন নাই।
একদিনের মধ্যে এসব করে বাবা ঢাকায় ফিরে গেলেন।
হোস্টেলের প্রথম দিনেই আমি বুঝলাম, এখানে থাকলে আমি মারা যাবো। লঙ্গরখানার মত সারি সারি বিছানা পাতা। বিছানার সামনে পড়ার টেবিল। কারো চেয়ার রাখার জায়গা আছে তো কারো নাই।বিছানার নিচে টিনের কালো ট্রাঙ্ক। পাশে বাইরে পরার স্যান্ডেল। সামনে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। এপ্রোন চেয়ারে ঝুলানো। আর যাদের চেয়ার নাই তাদের এপ্রোন ভাজ করে বালিশের পাশে রাখা। ঘরের পোষাক বাইরের পোশাক সবই ওই ট্রাঙ্কের ভেতর। ধোয়া ভেজা পোশাক বেলকুনীতে দড়ির উপরে শুকতে দেয়া হয়। ভেজা কাপড়ের বোটকা গন্ধ আর ডিসেকশন হলের লাশের গন্ধ মিলেমিশে অদ্ভুত এক বিটকেলে গন্ধের উদ্ভব ঘটেছে। এ রকম গন্ধ ইউনিভার্সিটির কোনো হলে পাওয়া যাবেনা। একমাত্র মেডিকেল কলেজের হোস্টেলগুলোতে এই অদ্ভুত উৎকট গন্ধ জায়গা করে নিয়েছে। ডাইনিং এর খাবার, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হরেকরকম আচার আচরণের মেয়েরা, বিভিন্ন রুমের ওয়াশরুম ব্যবহার করার সময় বড় আপাদের বকুনি, ডাইনিং এর খালাদের জঘন্য ব্যবহার। সবমিলিয়ে আমি দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। একমাত্র দারোয়ান নাজমুল ভাইয়ের মমতা ভরা ব্যবহার ও সাহায্য ছাড়া সেখানে আর কোনো মানসিক আশ্রয় ছিলনা । ভোর সাতটায় লেকচার ক্লাস টানা দুঘন্টা। পরপর দুটো লেকচার ক্লাস । এনাটমি আর ফিজিওলজি । লেকচার শেষ হলে হোস্টেলে ফিরে বিস্কুট দিয়ে নাস্তা করে আবার দোঁড়। ফিজিওলজি টিউটোরিয়াল ক্লাস দশটা থেকে টানা বারোটা পর্যন্ত। বারোটা থেকে এনাটমি ডিসেকশন ক্লাস। ডিসেকশন ক্লাস চলে টানা দুটো আড়াইটা পর্যন্ত। হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে বিকাল তিনটা। সেসময় ডাইনিং খোলা থাকলেও হাড়ি পোড়া ভাত, হলদে গ্যালগ্যালা ভেজিটেবল, ইয়োলো সি ডাল আর নলা মাছের এক ইঞ্চি টুকরো কিংবা মুরগির বুকের খাঁচা।
ছয়দিন কেবল পার হয়েছে। আমি কাঁদছি আর বিছানায় পেছন ফিরে শুয়ে ভাবছি , এখানে আমি ছয়বছর কাটাবো কিভাবে!!! এমন সময় কমন রুমে একজন বড় আপা ঢুকে দরজার পাশের বিছানার মেয়েটিকে জিগেস করলো, “তোমাদের মধ্যে মণি কে?” মেয়েটি আমাকে দেখিয়ে দিল। আবার ডেকেও বললো, “মণি, তোমাকে এই আপা ডাকছে।” আমি তখন দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে কাঁদছি। চা খাওয়া হয়নি গত ছয়দিন। চোখে মুছে ওদিকে তাকাবার আগেই আপা একেবারে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন। সাদা নীল ডুরে শাড়ি পরা শ্যামলা রঙের মায়াভরা মুখের একটি আপা আমার সামনে দাঁড়ানো। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন সব নিয়মকানুন, কোনো অন্যান্য করে ফেলেছি কিনা এই ভয়ে সিঁটকে গেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আপাটি ভারি মিষ্টি করে দরদভরা কন্ঠে জিগেস করলেন, “তুমি মণি?” ততক্ষণে আমি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। দেখলাম, বড় বড় মায়াময় দুটো চোখ দিয়ে শ্যামলা রঙের মিষ্টি মনোরম শান্ত মুখের একজন আপা আমাকে জিগেস করছেন , “তুমিই মণি? ঢাকা থেকে এসেছো?”
ভয়ে ভয়ে বললাম, “জ্বী আপা।” তাঁর মুখাবয়ব আরো কোমল ও মায়াময় হয়ে উঠলো। বড় বড় চোখদুটো মমতায় ভরে গেল । আমাকে বললেন, “আমি মিলি। এসো আমার সাথে।” আমি হকচকিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে, কিছুই বুঝতে না পেরে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর পেছনে হাঁটতে শুরু করলাম৷
মিলি আপার রুমে বসে আছি। ডিম পোচ, বিস্কিট আর কলা খাচ্ছি। তিনি খুব সুন্দর করে চা বানিয়ে দিয়েছেন। বললেন, “এগুলো খেয়ে চা খাও।”
আমি চায়ে চুমুক দিলাম। ছয়দিন পর চা খাচ্ছি। বিশ্বাস হচ্ছে না, ছয় ছয়টা দিন চা ছাড়া আমি কিভাবে বেঁচে আছি! কলেজের ক্যান্টিনে চা পরোটা, সবজি ভাজি, বুটের ডাল, সিঙ্গাড়া, পুরি পাওয়া যায়। দুপুরে ভাত মাছ মুরগিও পাওয়া যায়। দ্বিতীয় দিনেই আমি ক্যান্টিনে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সাথের একটি মেয়ে মুখ বেঁকিয়ে বললো, “ছিহঃ ওখানে সব খারাপ মেয়েরা যায়। আর ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়।
ছিহঃ,,,”
সাথের অন্যান্য মেয়েরাও তার সাথে সহমত পোষণ করলো। আমার আর ক্যান্টিনে যাওয়া হলো না। মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই একসাথে হোস্টেলে ফিরছি। হোস্টেলে ফিরে শুধু বিস্কিট খাবো। মাথাটা টনটন করছে।
ছেলেদের সাথে আড্ডা দিলে মেয়েরা খারাপ হয়ে যায় একথা আমি এই প্রথম শুনলাম। আপা ও তার বান্ধবীরা তাদের ছেলে বন্ধুদের পিকনিকে যায়, টিএসসিতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়, আমাদের বাসার লনে মিনি পিকনিক করে, পূর্ণিমা রাতে লনে চুটিয়ে আড্ডা চলে আর মা রান্নাঘর থেকে পোলাউ রোষ্ট, রেজালা, কাবাব, বোরহানি সাপ্লাই দেয়। লনে মাদুর বিছিয়ে সব্বাই মিলে খায়। ছোট ভাইজানের বন্ধু বান্ধবীরাও দল বেঁধে আসে। তারাও একইভাবে আড্ডা দেয়।
আপা কি খারাপ মেয়ে?
ছোট ভাইজানের বান্ধবীরা কি খারাপ মেয়ে?
ছিহঃ কি নোংরা মানসিকতার মেয়ে এরা!!!
মিলি আপা বড় মায়াময় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। তার রুমমেটরাও আমাকে ঘিরে বসে আছেন। একজন তালপাখা দিয়ে আমাকে বাতাস করছেন। যেন সন্মানিত কোনো গেস্ট আমি। আমার খেতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। একসময় মিলি আপা বলতে শুরু করলেন। বললেন, “আমি মহুয়ার ফুপ্পির স্কুল বান্ধবীর মেয়ে। আমার মা আর তোমাদের ফুপ্পির খুব বন্ধুত্ব। আমি আর আর আমার ছোট ভাইকে রেখে বাবা ক্যান্সারে মারা যান। তখন আমরা দু’ভাইবোন খুব ছোট। নানাভাইয়ের অবস্থা তেমন ভাল ছিলনা। মা একটি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছিলেন। মহুয়ার ফুপ্পিদের পারিবারিক স্কুল ওটা।”
কিছুক্ষণ থেমে মিলি আপা বললেন, “খালামণি নিজেই আজ সকালে প্রিন্সিপাল স্যারের টেলিফোনে ফোন করে প্যাথলজির প্রফেসর স্যারের সাথে কথা বলেছেন। স্যার খালামণির ক্লাসমেট, বন্ধু। পরে স্যার আমাকে ডেকে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে খালামণির সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। মায়ের ফোন করার সুযোগ নাই। দু’এক দিনের মধ্যেই মায়ের চিঠিও পেয়ে যাবো।” একটু থেমে কি যেনো ভাবলেন মিলি আপা। মিলি আপার চোখে জল। অন্য দুজন রুমমেট ওড়না দিয়ে চোখ মুছছেন। আমি বুঝলাম, আমার চোখদুটোও ভিজে যাচ্ছে।
তারপর গলায় অপার স্নেহ ঢেলে বললেন,
“এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকবে। আজ রাতের জন্য দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে আসো। আগামীকাল তোমার সবকিছু নিয়ে আসবে।”
মিলি আপার শেষ কথাটা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেছি। মিলি আপা বড় মমতায় বললেন, “চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, চা খাও মণি।
“খালামণি বলছিল, তুমি কফি খেতে পছন্দ করো। আগামীকাল শহর থেকে কফি কিনে আনবো। কিন্তু আমিতো কফি বানাতে পারিনা।”
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে লজ্জিত হয়ে বললাম, “আমিও পারিনা। আপাততঃ চা-ই চলুক আপা।”