সেলিনা মওলা
ইন্টার পাশ করে ভার্সিটি লেবেলে ভর্তি হবো হবো সময়ে আমি আমার এক বান্ধবীর মামার প্রেমে পড়লাম । যিনি চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসেছেন। এমনই অস্থির প্রেম যে ওঁনাকে প্রতিদিন এক ঝলক না দেখলে আমি কোনো কাজেই মন দিতে পারতাম না। তিনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছিলেন। অসম্ভব সুন্দর আবৃত্তি করতেন। তাঁর ক্লাসমেটের সাথে দীর্ঘ বছরের সম্পর্ক। একটি চাকরি পেলেই তাদের বিয়ে হবে। ওঁনার ক্লাসমেট পাশ করেই স্থানীয় একটি বেসরকারি কলেজে যোগদান করেছেন। যার ছবি ওঁনার মানিব্যাগে সবসময় থাকে। আমার সাথে খুব সাবলীল হয়ে যাওয়াতে আমাকে তাঁর ফিঁয়াসের ছবি দেখিয়েছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। কারণ মেয়েটি অপরূপা সুন্দরী ছিল।
আমি প্রতিদিন আচানক বন্ধুর বাসায় যাই। কারণে অকারণে যাই। ছলে বলে কৌশলে ভদ্রলোকের সাথে গল্প করার সুযোগ খুঁজি এবং সুযোগ পেয়েও যাই। অতি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি যে, তিনি কথায় কথায় কবিতা আওড়াচ্ছেন। মাঝপথে থেমে জিগেস করছেন, এই কবিতাটি আগে শুনেছ?
বলতাম, না না শুনিনি, শেষ পর্যন্ত বলেন। পুরোটুক বলেন। এভাবে কবিতায় কবিতায় আমাদের দীর্ঘ প্রহর কেটে যেতো। এমনকি শোনা কবিতাও, প্রায় মুখস্থ কবিতা হলেও একই কথা বলতাম। আবারও শুনতাম।
একদিন ভর দুপুরে গেছি। ততদিনে আমার সব ভর্তি পরীক্ষা শেষ কিন্তু কোনোটিরও রেজাল্ট হয় নাই। দুএক দিনের মধ্যে হবে। উঁনি বিছানায় চোখ বুজে আঁধশোয়া হয়ে আছেন। ঘরে ঢুকেছি আর উঁনি চোখ না খুলেই বললেন, বসো।
বসলাম।
বললেন, আমার একটি সরকারি কলেজে চাকরি হয়েছে। রাজশাহীতেই পোষ্টিং। আমি কালই চলে যাচ্ছি। যে মেয়েটির ছবি দেখেছো আমার মানিব্যাগে সে আর আমি ভার্সিটিতে পড়তেই গোপনে বিয়ে করেছি। ফিরে গিয়ে তার বাড়িতে দুজনে মিলে বিয়ের কথা জানিয়ে দেবো। বাড়ির লোকেরা মেনে নিলে ভাল, না মেনে নিলে কিছুই করার নাই। আমরা আমাদের মত সংসার পাতবো। দুজনের আয়ে সংসার ভালই চলে যাবে, কি বলো?
কিছুই বলতে পারলাম না। সংসার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা নাই। ওঁনার ফিয়ান্সে আছে তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ফিয়ান্সেকে বিয়ে করে স্ত্রী বানিয়ে সংসার করলেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমার একমাত্র সমস্যা, ওঁনাকে প্রতিদিন দেখতে পাবো না। ওঁনার আবৃত্তি শুনতে পাবো না। ওঁনার স্মিত হাসি দেখবার জন্য প্রতীক্ষা করবো না!
আমার পায়ের নিচে পৃথিবী টলে উঠলো। মনে হলো, মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। মনে হলো চিৎকার করে কেঁদে উঠবো, টেবিলের কাঁচের ফুলদানিটা আছাড়ে ভেঙে ফেলবো। মনে হলো, ওঁনার পায়ে ধরে মিনতি করে বলি, প্লীজ, যাবেন না।
কোথাও যাবেন না।
প্লীজ প্লীজ প্লীজ,,,
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, আমি এসবের কিছুই করলাম না। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম কেবল।
যেন হারিয়ে গেছি।
হারিয়ে গেছি অসংখ্য নামহীন, পরিচয়হীন, কুয়াশাচ্ছন্ন তারা নক্ষত্রের ভিড়ে।
নির্বাক হয়ে বসে আছি। যেন অনন্তকালের জন্য আমি স্থবির হয়ে গেছি। আমার বোধশক্তি আমার দেহ ছেড়ে কোন দুর্গম পাহাড়ে, কোন গহিন অরণ্যে পথ হারিয়েছে। আমার ভেতরে কোনো আকুলতা নাই। নাই পিছুটান। এই বিশাল শূণ্যতায় কারো আহ্বান শোনার স্পৃহা নাই। আমি সম্পুর্ন বধির। সম্পুর্ন বোবা, অন্ধ হয়ে গেছি। এই ঘোর অমাবস্যায় মাটির পিদিম জ্বেলে কেউ বলছে না, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?
অথবা বলছে কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি না।
শুনবার চেষ্টাও করছি না।
পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যত” অনাগ্রহ ” আমাকে পেয়ে বসেছে। ধ্বসে যাক চাঁদ নক্ষত্রের আকাশ। সাগরে তুফান উঠুক । মরুভূমিতে ঝড় হোক, দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ুক সভ্যতা। কিছুতেই কিছু আসে যায়না আমার।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে অনাগ্রহী প্রাণী আমি,,,
নিরবতা ভঙ্গ করে হাজার হাজার বছরের ওপার থেকে উঁনি বললেন, আমাদের বিয়ে তো কেউ মেনে নেবে না। ওর পরিবার খুব ধনী। আমার মত চালচুলোহীন ছেলের সাথে ওদের পরিবারের কোনো মেয়ের কখনও বিয়ে হয়নি। এ বিয়েতে আমরা কারোর আশির্বাদ পাবো না। দুয়েকজন বন্ধু ছাড়া কেউ শুভাশিসও দেয় নি। অন্ততঃ
তুমি আমাদের শুভেচ্ছা জানাও।
আমি মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছি।
ভাবছি, এ কেমন আকুতি!!!
ভিখিরির কাছে এ কেমন আবেদন!!!
কাঙ্গালের কাছে এ কেমন কাঙ্গালপনা!!!
বেশ খানিকটা সময় পার হয়েছে কি হয়নি, আমি ঠিক জানিন। তখন উঁনি আঁধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসেছেন । তারপর, প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বললেন,
যাকে এতো ভালবাসলে তার সাফল্যে শুভেচ্ছা জানাবে না? না জানালে তো সে সুখী হবেনা।
আমার নিচু মুখ আরও নিচু হলো।
অস্ফুটে বললাম, কনগ্রাচ্যুলেশনস।
অনেকবছর পর আমি ট্রেনিং করছি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে । তখন একদিন কেবিনের রুগী রাউন্ড দেবার সময় করিডরে দেখা। অদ্ভুত বিষয় হলো, এতো এতো বছর পর আমিও যেমন এক মুহুর্তেই চিনেছি, উঁনিও তেমনই এক মুহুর্তেই চিনেছেন। হেপাটাইটিস বি উইথ লিভার সিরোসিস। প্রায় শেষ পর্যায়। হুইলচেয়ারে বসে আছেন আর পেছনে ওঁনার ছেলেই হবে, ছেলেই, পরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা করে কেবিনে ফিরছিলেন।
প্রতিদিন কেবিনে দেখতে যাই। খুব স্বাভাবিকভাবেই জিগেস করি, আজ কেমন আছেন? কিছুক্ষণ বসে থাকি। প্রফেসর স্যার নতুন কোনো ঔষধ দিয়েছেন কি না দেখি। ফাইল দেখে জেনে নেই শারীরিক পরিস্থিতি। একদিন বললাম, আমি কিন্তু আপনাকে সত্যি ভালবেসেছিলাম। এমনকি, আপনার ফিঁয়সে, ওয়াইফ থাকলেও আমার কোনো সমস্যা ছিলনা। নাহ, আপনাকে কখনোই জিগেস করবো না, আপনি ভালবেসেছিলেন কি না। আপনাকে আমি বিব্রত করতে চাই না। করুণ কন্ঠে বললেন, জিগেস করো, দয়া করে জিগেস করো। সময় তো খুব বেশী নাই। মরে যাবার পর তো আর জিগেস করলেও কিছু বলতে পারবো না। অথচ আমি বলতে চাই। সেই তখন থেকেই বলতে চাই।
জিগেস করলাম, কখন থেকে বলতে চেয়েছিলেন?
বললেন, যখন তোমাকে কবিতা শুনাতাম, তোমার জানা কবিতাগুলোকেও তুমি অজানা কবিতা বলে আমাকে শুনাতে বলতে, এমনকি যে কবিতাগুলো তোমার প্রায় মুখস্থ, সেই কবিতাগুলোও বারবার শুনতে চাইতে, তখন থেকেই বলতে চাইতাম।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম।
এর কয়েকদিন পর উঁনি কোমায় গেলেন।
বুকে গেঁথে থাকলো আমাকে না বলা কথাগুলো ,,,
মাথা চিনচিন করছে আমার। মাথার ভেতরে বেজে চলছে -নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর গান
“পেসমেকার ভেবো না যেটা রেখেছি তোমার বুকে,
ভেবো আমার মাথা,যেন আজও আছি মাথা রেখে।”