Homeছোটগল্পযে গল্প কবিতার মতো বেদনার

যে গল্প কবিতার মতো বেদনার

শফিক মুন্সি

তখন স্পেনে মাত্রই শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছে। একটি বন্দর নগরী ঘিরে সক্রিয় সন্ত্রাসীদের দুটি গ্যাং। সমুদ্রে চোরাচালানের রুট দখল নিয়ে তাদের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে তাণ্ডব হয়। সদ্য কৈশোর পেরুনো ডেক্সটার মেথিউ এদেরই একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শত্রুকে ঘায়েলের অসীম সাহস আর ক্ষিপ্রতা তাকে নিজ দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত করেছে। গ্যাংস্টার হিসেবে নাম ছড়িয়েছে শহরের সর্বত্র।

কিন্তু রক্তমাখা হাত, আহতর আর্তনাদ,মজলুমের জীবন ভিক্ষার কাকুতি মিনতি তাকে বারবার এটাই ভাবতে বাধ্য করে যে; সে এসব ঠিক করছে না। অপরাধ জগতের তপ্ততায় ভরা জীবনে বর্ষার শীতলতা নিয়ে আসে ইশু মোর্লে নামের একটি মেয়ের মিষ্টি হাসি।নিজের চেয়ে বয়সে বড় এই রমণীর প্রেমে পরে ডেক্সটার। কিন্তু যে হাত শত সহস্র মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে সেই হাতে কি ভালোবাসা হাত রাখতে পারে?

ডেক্সটারের অন্ধকার জগৎকে বিদায় জানাবার শর্তে ইশু তার জীবনসঙ্গী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু চাইলেই কি তা সম্ভব? এ পথ তো একরোখা, যেখান থেকে কারো ফিরবার উপায় নেই। যদিও এ জীবন তার ভালো লাগে না তবুও বাস্তবতা হচ্ছে ডেক্সটারদের ফিরবার পথ থাকে না, ছিল না কোনোকালেই। কিন্তু ইশু যে তাকে প্রতিনিয়ত  হাতছানি দিয়ে ডাকছে!

এইসব তোলপাড় করা সময়ে হঠাৎ ডেক্সটারের প্রতি নির্দেশ আসে; মরতে হবে মুনিরো ডগলাস কে।যেকিনা বিপক্ষ দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি আর শহরের সবচেয়ে বড় ধনী। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ব্যক্তিটি কদিন পরেই নির্দিষ্ট সময়ে বের হবে প্রোমোদ বিলাসে, এইতো সুযোগ। কিন্তু ইশুর দিব্যি, ‘হয় তুমি এ জগৎ ছাড়বে নয়তো আমাকে’।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবার আগেই চলে এলো কাঙ্ক্ষিত দিন, মারতে হবে মুনিরো কে।

দায়িত্ব পালনে হাজির হলো ডেক্সটার। একাই ঘায়েল করলো সঙ্গী সামন্তদের। হাঁটু গেড়ে নিজ জীবন ভিক্ষা চাইছে মধ্যবয়সী মুনিরো। তার চুলহীন মাথা বরাবর তাক করা হয়েছে রিভলবারের নল। ঠিক এই মুহূর্তে দুজনের মাঝখানে চলে এলো মুনিরোর ছোট্ট মেয়ে, বয়স বড়জোর ছয় কি সাত। অশ্রুসিক্ত চোখে বাবার জীবন ভিক্ষার ফরিয়াদ। ভয়ার্ত ছোট্ট শিশুটির এই আগমন ডেক্সটারকে দোলাচালে পরতে বাধ্য করলো। কি করবে সে এখন?

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো মুনিরোকে জীবন ভিক্ষা দেয়া হবে। তবে তাকে পরিবার নিয়ে চলে যেতে হবে অন্যত্র, থাকতে হবে আত্মগোপনে। শহরে খবর ছড়াবে আগুনে অঙ্গার হওয়া প্রোমোদ তরীতে ভস্ম হয়েছে মুনিরো সহ সবাই। ডেক্সটার দলের প্রধানের কাছে গিয়ে দেবে ইস্তফা। অবশ্য মুনিরো না থাকলে ডেক্সটারের খুব একটা প্রয়োজন নেই। তাকে ছাড়াই শহরজুড়ে একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারবে তার দল। সব ছেড়েছুড়ে নিজের গন্তব্য করবে ইশুর আলিঙ্গন।

সেইমতো সব করে ডেক্সটার ফিরলো ঘরে। টেবিলে পেলো এক চিরকুট, বার্তা ইশুর। শহর ছেড়ে চলে গেছে সে, বাধ্য হয়েছে যেতে। ডেক্সটারের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে গেছে পরিবার। মেয়ের ভবিষ্যৎ আর নিজেদের জীবনের পরোয়া করে তাকে জোর করে নিয়ে গেছে বাবা -মা। সমাপ্তিতে পুনশ্চ দিয়ে নীল কালিতে লেখা: শেষ অনুরোধ;নিজের খেয়াল রেখো, আমায় খুঁজো না আর। রাখবে তো?

এরপর কেটে গেছে কয়েক বছর। পুরো পৃথিবী ভেঙে যাওয়া জীবন নিয়ে ডেক্সটার ছেড়েছিল নিজ শহর, নিজ দেশ। তিব্বতে ডেরা পেতেছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাহচর্যে। কি মনে করে যেন আবার ফিরলো স্পেন। নিজ শহরে পৌঁছে জানতে পারলো বিস্মৃত হয়েছে তার নাম। ভাঙাচোরা শরীর, পরনে গেরুয়া, মুণ্ডিত মাথা তাকে খুব পরিচিতদের কাছেও করলো অচেনা। ভাবলো এই সুযোগে নিজ কর্মের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করা যেতে পারে। দাঁড়াবে ছিন্নমূল মানুষের পাশে৷

চেষ্টা করলো পুরনো শুভাকাঙ্ক্ষীদের খুঁজে বের করার৷ জানতে পারলো ডেক্সটারের প্রস্থানের পর গলা কে*টে মৃ*ত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে তার দলের প্রধানের, আর নিশ্চিহ্ন হয়েছে তাদের প্রভাব। পুলিশের তৎপরতায় এককালে ডেক্সটারদের বিপক্ষ দলও এখন লাপাত্তা। তবে ফিরেছে মুনিরো। তার বেঁচে থাকা নিয়ে আর কারো সমস্যা নেই বিধায় পুরনো শহরেই নতুন করে জীবন শুরু করেছে। তবে ধন – দৌলত বেড়েছে আগের চেয়েও কয়েকগুণ।

শেষমেশ সেই মুনিরোর দারস্থ হলো ডেক্সটার। একসময়ের সাক্ষাৎ মৃ*ত্যুদূতকে নতুন চেহারায় দেখে চিনতে সময় নিলো খানিকটা। কিন্তু পরিচয় নিশ্চিত হতেই চক্ষু চড়কগাছ। কি ডেক্সটার আজ কি হয়েছে! মানুষ কত বদলে যেতে পারে! এমনসব আশ্চর্যবোধক বাক্য চয়নের ফাঁকেই জানতে চাইলো আগমনের হেতু। ডেক্সটার জানালো নগরীর স্বজনহীন দুঃস্থদের জন্য গড়বে “শান্তি নিবাস”। কিছু সাহায্য কি পেতে পারে সে?

ডেক্সটারের প্রস্তাবে এক বাক্যে রাজি মুনিরো। “শান্তি নিবাস” নির্মাণের সব ব্যায় তার। যেই কথা সেই কাজ। ডেক্সটারের হলো স্বপ্নপূরণ, মহা ধুমধামে হলো শান্তি নিবাসের উদ্বোধন। আকাশকে মাথার ছাদ বানিয়ে জীবন কাটানো মানুষেরা একে একে ভীড় করতে থাকলো ডেক্সটারের কাছে৷ এভাবেই কাটছিলো দিন। স্বজনহীন প্রাণগুলোকে দুদণ্ড শান্তি দিতে রইলো “শান্তি নিবাস”।

একদিন নিবাসের দরজায় কড়া নাড়লো আকস্মিক বিপদ। পুলিশের আগমন ; খুঁজছে নিবাস প্রধান কে? নতুন রূপের ডেক্সটার সামনে আসতেই তাকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি। অপরাধ? রোজ রাতে নাকি নির্যাতন করা হয় শান্তি নিবাসের এক নিবাসীকে, ভুক্তভোগী দায়ের করেছে মামলা। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল সবাই। অগত্যা এই বদলে যাওয়া ডেক্সটারের ঠাঁই হলো থানায়।

মিথ্যা অভিযোগে হাজত বন্দী ডেক্সটার যতটা না বিব্রত তার চেয়ে ঢেড় বেশি হতবাক থানার কর্তারা৷ ডেক্সটারের নতুন জীবন, নতুন চেহারা ; কিছুটা নতুন পরিচয় তৈরিতে সফল হলেও পুরোটা নয় । এক সময়ের শহর জুড়ে নৈরাজ্যের নায়ককে, বর্তমানের ফেরারি আসামি, প্রথমে চিনতে না পারলেও জিজ্ঞাসাবাদে বেড়িয়ে এসেছে পুরনো পরিচয়। এ যে বিরোধী পক্ষের সাক্ষাৎ যমদূত ডেক্সটার, এ যে শেয়ালের বুদ্ধিধারী চোরাকারবারি ডেক্সটার, এ যে পরোয়ানাধারী পলাতক ডেক্সটার!

সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে খবরের রব উঠলো – ‘কুখ্যাত ডেক্সটার কারাগারে, বছরের পর বছর ছিলেন ছদ্মবেশে’, ‘অবশেষে জেলের চৌদ্দ শিকে সেই ডেক্সটার ‘ সহ আরো কত কি! ডেক্সটার উঠলো কাঠগড়ায়, মোকদ্দমা চললো দিনের পর দিন।একটা সময়ে শান্তি নিবাসে নির্যাতনের ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। কিন্তু…..

পুরনো মামলা, পুরনো অভিযোগ ; বিচারকের সামনে দাঁড় করালো নতুন ডেক্সটারকে। কিন্তু ডেক্সটার তাতে বিচলিত নয়। ভাগ্য তাকে হয়তো কৃতকর্মের শাস্তি দিতেই তিব্বত ছেড়ে স্পেনে নিয়ে এসেছে। এই জীবনের জমা ধুলো, শাস্তির জলে এই জীবনেই ধুয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু কাঠগড়ায় বাদীর কাষ্ঠে, সাক্ষীর জেরায় এরা কারা? মুনিরো!ইশু….!

‘ইওর অনার, আমার স্বামী মুনিরো ডগলাসকে হত্যার উদ্দেশ্যে আমাদের প্রোমোদতরীতে হামলা করে ঔ ছদ্মবেশী, ভন্ড ডেক্সটার। নিজ হাতকে খুনের রক্তে রঞ্জিত করে সে । একে একে আমাদের পাঁচ রক্ষক সিপাহি মৃত্যু বরণ করে তার অস্ত্রের আঘাতে। কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি আমি, আমার স্বামী এবং আমাদের একমাত্র মেয়ে। এরপর বছর পাঁচেক পর পুনরায় আমাদের খুঁজে বের করে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। অন্যথায় আমাদের পৃথিবী থেকে সড়িয়ে দেবার হুমকি দেয় । আমরা তার কঠিন শাস্তির দাবি জানাই। – আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারকের কাছে হাত জোর করে প্রার্থনায় ভেঙে পরে ইশু, যেমনটা পাঁচ বছর আগে ডেক্সটারের সামনে ভেঙে পরতো সে। সময়ের ব্যবধান দীর্ঘ হলেও অভিনয়ের পারদর্শিতায় ভাটা পরে নি একদম।

ফাঁসির আদেশ হয়েছে ডেক্সটারের। জেলে বসে দেখা পায় কিছু পুরনো বন্ধু-শত্রুদের। তারা জানায় ইশুর ভালোবাসায় কতটা অন্ধ ছিল ডেক্সটার! পুরোটা ছিল মুনিরোর সাজানো ফাঁদ। যেই ফাঁদে পরে শত্রুতায় নিমজ্জিত দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের সবাই হয় মরেছে নয়তো জেলে গেছে। আর সবার আগে একমাত্র পথের কাটা ডেক্সটার ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হয়েছে নিরুদ্দেশ। দল, উপদল আর দখলদারত্বের লড়াই না থাকায় নগরীর চোরাকারবারের একক নিয়ন্ত্রণ মুনিরোর। নিঃশব্দে রাজ্যদখল।

এখানেই গল্প শেষ হয়ে যাবার কথা। হয়েছেও হয়তো, আবার হয়তো হয় নি। কবিতার মতো বেদনার হতে হলে তো এখানেই শেষ করা উচিত। কিন্তু মুনিরোর অফিসে প্রেরকের নামহীন এক চিঠি এসেছে। বেদনাকে ছাপিয়ে সামনে এসেছে প্রতিশোধ। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মুনিরো তৃতীয় বারের মতো মাত্র চার লাইনের চিঠিটা পড়ছে। ‘ তুমি যত বৃদ্ধ হবে আমি তত যুবক হবো। কথায় আছে, শত্রুর প্রতি নির্মমতার বদলে সহানুভূতি দেখানো পাপ। প্রতিশোধের বদলে ক্ষমা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।তোমাকে মরতে হবে আমার হাতে, তৈরি হও মুনিরো ‘। চিঠির নিচে লাল কালিতে লেখা ‘ডেক্সটার’।

শফিক মুন্সি, বরিশাল
shafiqurrahmanbu@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

শফিক মুন্সি Shafiq Munsi
শফিক মুন্সি
নদী বয়ে যায়, উজান - ভাটির ঢেউয়ে। জলরাশীর গন্তব্য অজানা। কিন্তু নাবিক, তাকে তো খুঁজে নিতেই হয় ঠিকানা। ঝড়ো হাওয়ার মেলবন্ধনে যে পাঞ্জেরি সংগ্রাম করেছে দিগন্ত জয় করার, আমি তাকে চিনি। সেই নাবিক, সেই পাঞ্জেরি তো আমিই।

এই লেখকের আরো লেখা

এই ক্যাটাগরির সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য